পাখির বাসা বদল – শাহানা সিরাজী

Picsart_24-04-27_22-03-48-452.jpg

পাখির বাসা বদল – শাহানা সিরাজী

মা পাখিটাকে ভীষণ চিন্তিত মনে হলো। বাচ্চারা তার স্বরে চেঁচাচ্ছে। মা, মা, মা, আগুন আগুন। তখনও গজায়নি পাখা। উড়তে পারার সম্ভাবনা নেই্। মা পাখিটা আগুনের কেয়ার না করে ঠোঁট দিয়ে ধরে বাচ্চাদের আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়ে বললো,‘এ মানুষের দুনিয়ায় আমাদের আর থাকা লাগবে না।’ তারপর শুরু করলো সার্চ করা কোথাও যদি নিরাপদে থাকা যায়!পাখি বাধ্য হয়ে বাসা বদলায়।

কখনো ঝড়ের আঘাত কখনো মানুষের তৈরি কৃত্রিম আঘাত পাখিদের নীড়হারা করে। আকাশ মুক্ত বলে পাখিরা আবার স্বপ্ন দেখে। ডানা মেলে দেয়। কোথাও ডাল পেলে আবার বাসা বাঁধে। পাখিদের সাথে মানুষের এক জায়গায় তফাৎ। পাখি অসহায় হয়ে নীড় হারায়। মানুষ লোভে লোভে নীড় বদলায়। পাখিদের মতো তারা খড়কুটোর ঘরে কখনো থাকতে চায় না। গুহা থেকে বেরিয়ে শনের ঘর তারপর টিনের ঘর তারপর ইটের ঘর। কতো ভাবেই না মানুষ নিজেকে দেখতে চায়। পাখিদের রাজ্যে শাসক নেই শোষক নেই। মানুষের রাজ্যে সবই আছে। মানুষ এক অপরের উপর ক্ষমতা বিস্তৃত করতে চায়।

কোন গোষ্ঠির উপর অথবা কোন জনপদের উপর নিদেন পক্ষে নারী-পুরুষ একে অপরের উপরের পারাকাষ্ঠ দেখিয়ে ছাড়ে!

রাজু লেখাপড়ায় দুর্দান্ত ।বিনয়ী। ঝগড়া ফ্যাসাদ তার ভালো লাগে না। বাইপাস রোডে সে নিজেকে সংসারের খাঁচায় মানিয়ে নিয়ে চলছে দীর্ঘ আটবছর যাবৎ। রাজুর বিবাহিত স্ত্রী অরনি। দেখতেও খুব আহা মরি সুন্দরী নয়, লেখাপড়ায় মোটামুটি। চাকুরিও করে না। অথচ সে রাজুকে উঠতে বসতে পিঞ্চ করে কথা বলে। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে ভীমরুলের মতো হূলফোটায়। রাজু চুপ থেকে চুপ। অরণি ভাবে এই তো পেয়েছি। সব ক্ষমতা আমার সব আয় রোজগার আমার। আমার কথায় উঠতে হবে বসতে হবে। রাজুর এখন বাসায় আসতে ভালো লাগে না। অফিস শেষে সে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। নিজের হাতে তৈরি বাসাটি তার কাছে দিন দিন জেল মনে হয়। এ কারাগার থেকে সে মুক্তি চায়। সে মা-বাবা-ভাই- বোন কাউকে তার বাসায় প্রত্যাশা করতে পারে না। অরণি সহ্য করে না। সে তার বাচ্চাদেরকেও নার্সিং করবে না। বাচ্চারা বাবা বলতে অজ্ঞান। এ কারণে রাজু বাসায় না ফিরে পারেও না। অথচ রাজু চায় অফিস থেকে ফেরার পর অরণি তার সাথে বসবে , চা করবে, নাস্তা বানাবে বাচ্চারাসহ একসাথে উপভোগ করবে। রাজুকে রোজ দরজা খুলে দেয় কাজের মেয়ে পন্টি। তার নাম কেন পন্টি রাজু অনেক ভেবেও ক‚ল পায়নি। চমৎকার মেয়ে এক হাতে সংসার সামলাচ্ছে। বাচ্চাদের সারা দিনের সব চাহিদা পন্টিকেই পূরণ করতে হয়। রাজু বাসায় ফিরলে সব রাজুই করে। পন্টি তখন কিছুটা রিলাক্স পায়।-কি রে পন্টি,সাজু খেয়েছে?
-জ্বী স্যার।
-গোসলের পর চুলগুলো ভালো করে মুছে দিয়েছিস?
-দিয়েছে। এমন কান্না শুরু করেছে যে থামাতে অনেক কষ্ট হয়েছে।
-ওর মা তো বাসায় ছিলো।
পন্টি কোন কথা না বলে চলে গেলো। ফিরে এলো শরবতের গøাস হাতে নিয়ে।
-কি রে, শরবত কেন? আমি তো চাইনি। সাজু কোথায়?
– নেন স্যার, যে গরম পড়ছে, ঘেমে আপনি একাকার হয়ে গেছেন। সাজু ঘুমাচ্ছে। কান্নাকাটি করে সেই যে ঘুম দিয়েছে এখনো ওঠেনি। অরণি তার স্বরে চেঁচায় এই পইন্টা, তুই কই রে? ও! সাহেব ঘরে ফিরেছে তাই পাখা গজিয়েছে? বাবুর ফিডার ধোয়া হয়েছে নাকি সাহেবের সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে চলছে সব? বাজে কথার ইঙ্গিত। এ ইঙ্গিত সব সময় চলতেই থাকে। সে দিন রাজু হালকা এক্সিডেন্ট করে বাসায় ফিরেছে। রাজুকে দেখেই পন্টি এগিয়ে আসে, স্যার কী হয়েছে, খোঁড়াচ্ছেন কেন?
-এক্সিডেন্ট করেছি। ম্যাডাম কোথায়?
-রুমেই আছে। ডাকবো?

কী ভেবে রাজু বললো, না থাক। একটু গরম পানি সেভলন আর তুলার বাক্সটা নিয়ে আয়। পন্টির চোখ ভেজা। রাজুর এক্সিডেন্ট আরো কঠিন ভাবে হতে পারতো! রাজু মারা যেতে পারতো। এসব ভেবে পন্টি কান্না জুড়ে দিয়েছে। তড়িৎ গতিতে সে পানি নিয়ে আসে। পানিতে লবণ মিশিয়ে দিয়েছে। তার দাদী কাটা ছেঁড়ায় লবণ পানি ব্যবহার করতো সে দেখেছে। রাজু পানি দিয়ে নিজের পা নিজেই পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পায়ের পেছনের অংশ একা একা পরিষ্কার করা কঠিন। পন্টি এগিয়ে আসে, ‘স্যার, দেন আমি ঠিক করে দিই।’ রাজু ব্যথায় মুখ কুচকে আছে। পন্টি কাঁদছে আর তুলা দিয়ে নিবিড় পরিচর্যা করছে। সব শেষে ব্যান্ডেজ দিয়ে বলে ‘আপনি বসুন, দুধ গরম করে নিয়ে আসি।’

রাজু দুধের গøাস হাতে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায়। তার মা তাকে এভাবে যতœ করতো। ছোট বেলায় খেলতে গিয়ে কতো যে আঘাত খেয়েছে, কেটেছে ছিঁড়েছে, মা কখনো বিরক্ত হতো না। ফার্স্ট এইড বক্স মা রেডি করেই বসে থাকতেন। যেন তিনি নিশ্চিত ছেলে হাত পা ছিঁড়ে বাসায় ফিরবে। তার মায়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো, কি রে খোকা, কখনো বড়ো হবি না? রোজ হাত-পা কাটা লাগে কেন? রাজু মুখ বাঁকিয়ে বললো, মা, জানো বাদল ইচ্ছে করে আমাকে ফেলে দিয়েছে নইলে আজ কিছুতেই পা ছিঁড়তো না! মা হাসে। মায়ের হাসিই রাজুর অভয়। সেও হাসে। রাজুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। পন্টি দিশেহারা হয়ে যায়। স্যার ব্যথা বেশি পাচ্ছেন? ডাক্তার দেখাতে হবে? সাজুকে আমি দেখছি আপনি যান ডাক্তার দেখিয়ে আসুন। রাজু চোখ মুছে বলে, না সেরে যাবে। একটা পেইন কিলার খাবো। পন্টি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ম্যাডামকে বলি ঔষধ দিতে? রাজু খুব ধীরে ধীরে বললো, না থাক, আমিই নিয়ে নেবো।

স্যার আমি নিয়ে আসি বলেই পন্টি দৌাড় দেয়। এতোক্ষণে অরণি উঠে আসলো, দেখলো পন্টি রাজুকে এক হাতে পানি অন্য হাতে ঔষধ দিচ্ছে। সে তার স্বরে চিৎকার শুরু করে, অফিস ফেরৎ স্যারের সাথে ঢলাঢলি না করলে হয় না, কাজের বেটি? রাজুকে ফালতু ইঙ্গিত দিয়ে বলে, কাজের বেটির সাথে এতো কি ঘষাঘষি করছো? এ জন্যই তো বলি সে কখন বাসায় ফিরলো কিন্তু সাড়া শব্দ নেই কেন? রাজু চোখ ফিরিয়ে নেয়। চিৎকার করতে চায় না, অরণির খারাপ ব্যবহার তার বাচ্চারা শুনে ফেলবে। তাদের মা সম্পর্কে খারাপ ধারণা হবে। শুধু তাই নয় রাজুর মাকে নিয়েও ইঙ্গিত করে। যেমন মা খানকি তেমন ছেলে! রাজুর মেজাজ খারাপ হয়। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়। রাজু ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চায়। অরণি উত্যক্ত করতেই থাকে। কাজের মেয়ের সাথে এতো কীসের হাসাহাসি ? এতো কিসের পিরিতি? যত্তোসব পষ্টিনষ্টি! রাজুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। স্থির হয়ে অরণির দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। যে তার স্বামীকে সম্মান করে না সে কী ভাবে স্ত্রী হবে!

অরণিকে আমি বিয়ে করেছি ভালো থাকার জন্য কিন্তু সে আমার মা বাবা ভাই- বোন সব কেড়ে নিয়েছে। কাজের মেয়ে তার দায়িত্ব পালন করছে সেখানেও তার সমস্যা! রাজু ঘুরে দাঁড়ায়। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। অরণির সম্মুখেই সে পন্টিকে নিয়ে বের হয়ে যায়।

ফিরে আসে তিনদিন পরে। খালি হাতে। অরণি রাজুকে দেখেই তেড়ে আসে। রাজু সরে যায়। সামি-সাজুকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে যায়। সাজু কথা বলতে পারে না এখনো। সামি বকবক করেই যাচ্ছে। বাবা তুমি কোথায় ছিলে? আম্মু অনেক মেরেছে। রাজুর চোখ থেকে জলে গড়িয়ে পড়ল্।ো সামি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো, বাবা, তুমি কাঁদছো কেন? রাজু সামিকে টেনে কোলে নিলো। রাজু চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সংসার জুটিয়ে দিয়েছে মা। অরণির সাথে আমার প্রেম ছিলো না । মায়ের পছন্দে। কী এক অজানা কারণে সে আমার মা-বাবা,ভাই-বোন কাউকে পছন্দ করে না। সুতরাং তাকেও আমার পছন্দের দরকার নেই। আমার খেয়ে আমার পরে আমার সাথে এতো অশান্তি! এ অশান্তিতে আমি কেন থাকবো! বাচ্চাদের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সেই যে রাজু হারিয়ে গেলো আর ফিরলো না। অরণি অনেক সন্ধান করেও রাজুর খোঁজ পেলো না। অরণির একাউন্টে প্রতিমাসেই রাজু তার লিভিং কস্ট পাঠিয়ে দিয়েছে বটে কোথা থেকে কে পাঠাচ্ছে অরণি তার সন্ধান করতে পারেনি।
রাজুর বাসা বদল মানুষের অত্যাচারেই হয়েছে। স্ত্রী, শ^শুর-শ^াশুড়ির সীমাহীন অত্যাচার তাকে বাধ্য করেছে বাসা বদল করতে। রাজু ভাবে অরণিকে নিয়ে জীবন শুরু করেছি এক সাথে হাসি আনন্দে থাকবো কিন্তু সে কেন এমন বাজে বিহেভ করতো? কেন তার বাবা-মা চাইতো না আমার বাবা মা আসুক আমার কাছে ?

কেন সে আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে বাঁধা দিতো? আমার চোখের সামনে আমার মা বিনা চিকিৎসায় মরেছে। বাবা ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। ভাই – বোন কাউকে আজ অবধি পারিনি একটি বস্ত্র উপহার দিতে। ভায়ের পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। আমার তো অভাব ছিলো না। যা আয় করেছি তা দিয়েই সবাইকে নিয়ে চলতে পারতাম। মা , মা গো আমাকে ক্ষমা করিও। কে বানিয়েছে বিবাহ নামক এ নিয়ম? কেন আমাকেই সব বহন করতে হবে? কেন ওই এক নারীর জন্যই সব করতে হবে?

অরণির জন্য মায়া হওয়া সত্তে¡ও রাজু অরণির সাথে থাকেনি।

অনেক দিনপর জোছনার সাথে পন্টির দেখা হয়। জোছনা এক নিবেদিত প্রাণ সংসারী মানুষ। সরকারি চাকুরি করে। জোছনার স্বামী লোকমান। ইবলিসের ইবলিস। বেতন পাওয়ার আগেই জোছনার অফিসে গিয়ে বসে থাকবে। সব টাকা তাকে দিতে হবে। রোজ তার থেকে চেয়ে চেয়ে গাড়ি ভাড়া নিতে হয় । জোছনা খুশি মনে তা মেনে নেয় কারণ সংসার তো দুজনেরই। ইনকাম যেই করি না কেন এক হাতে সংসার চললে আয় উন্নতি হয়। কিস্তু দিনে দিনে লোকমানের বদ চলাচল সে টের পায়। এখনো বাচ্চা হয়নি। বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। জোছনা মরিয়া হয়ে তাকে ফেরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু না লোকমান ভিন্ন রুচির মানুষ। রোজ রাতে তার ভিন্ন নারী লাগবেই। জোছনা বিরক্ত হয়ে একদিন ঘর ছাড়ে। নতুন করে সংসার করার রুচি তার হয়নি। লোকমানকে ডিভোর্স দিয়ে নিজে মুক্ত হয়। এখন সে শান্তিতে ঘুমায়। ইচ্ছা হয় রান্না করে ইচ্ছা না হলে পেট বেঁধে শুয়ে থাকে। জীবনের বিচিত্র রঙে জোছনা রঙিন!

পন্টি জোছনাকে দেখে চিনতে পারেনি। এরই মাঝে বহুদিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু জোছনা পন্টিকে চিনতে পারে। সেই আগের মতোই গায়ের রঙ দুধে আলতায় মেশানো। হাসি যেন মুখ থেকে সরছে না। জোছনা জানে পন্টি ছিলো অরণির বাসায় কাজের লোক। তাই দূর থেকে তাকে অবজারভ করছে। জোছনা জানে না পন্টির সাথেই রাজু আবার ঘর বেঁধেছে। রাজু মানসিক ভাবে পর্যুদস্ত ছিলো। অরণির আঘাতগুলে সে নিতে পারেনি তাই সুইসাইড না করে আলাদা ভাবে নতুন সংসার করেছে। এখন তারা কেমন আছে? একটু পরেই রাজু এসে দাঁড়ায় পন্টির পাশে। দুজনেই হাসছে।

আগোরা সুপার শপিংমল থেকে তারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কেনা কাটা করছে আর হাসছে। দুজনেই হাত লাগাচ্ছে এটা ওটা গুছাাচ্ছে। জোছনা এগিয়ে এসে এবার কথা বলে, রাজুভাই কেমন আছেন? খুব চেনা স্বর! জোছনা আর অরণি বান্ধবী ছিলো কিন্তু স্বভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজু ধরা দিতে চায় না। সে ভালো আছে। আবার কোন ঝুটঝামেলা সে চায় না। পাশ কাটিয়ে যেতেই পন্টি বললো জোছনা ম্যাডাম। তার পূর্বের কথা মনে রয়েছে। রাজু বললো,নাউ ইউ আর মাই ওয়াইফ। সি ইজ অনলি জোছনা। পন্টি হাসে। তুমিই আমাকে শিখিয়েছো মানুষকে কী ভাবে সম্মান করতে হয় ডক্টর রাজু!

জোছনা তাদের দুজনের বাক্যালাপে মুগ্ধ হয়। সামি-রাজু তারা কেমন আছে জানতে চায়। পন্টিই ঝটপট উত্তর দেয়। তারা দুজনেই কমনওয়েলথ স্কলারসীপে পিএইচডি করছে অস্ট্রেলিয়ায়। ধ্রæবর কথা বলছো না কেন? শ্রাগ করে রাজু। পন্টি একটু কী লজ্জা পেলো! রাজু বললো আমাদের আর একটি সন্তান আছে ধ্রæব। সে ইন্ডিয়ান মিউজিকের উপর পড়াশোনা করছে রবীন্দ্রভারতীতে। জোছনা অবাক হয়ে যায়। ভালোবাসা মানুষকে কতোদূর নিয়ে যায়! পন্টি জানতে চায় আপনার বাচ্চারা? তার চোখে জল। এবার রাজুর অবাক হবার পালা। আপনার বর একটা খারাপ লোক ছিলো তখনই জানতাম। কিছু বলিনি কারণ সবারই লাইফস্টাইল আলাদা।

আপনি হয়তো মেনে নিয়েছেন। জোছনা বললো, মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু সে শেষ পযর্ন্ত আমার টাকা আমাকে ব্যয় করতে দিতো না। বাসায় ফিরতো না। নেশা করতো। কাউকে যদি ভালোবাসতো সে না হয় এক কথা ছিলো। আজ এখানে কাল সেখানে। বাসায় এসে মারপিট করতো। আমার অফিসে যাবার উপায় ছিলো না। খুব কষ্ট হতো। চলতে পারতাম না। পরে ভেবেছি কেন এ জীবন? একসাথে জোড় বেঁধেছি ভালো থাকার জন্য। যদি ভালো না থাকি নিজেও নিজেকে চালাতে পারি না। তবে তার সাথে কেন থাকবো! উপরন্তু তার রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক নানান সমস্যা। রোজ তার জন্য মামলা-মকদ্দমা থেকে ধর্ষণ সব অভিযোগ আসে। এ ধরণের ব্যক্তির সাথে অনেকগুলো বছর থেকেছি। বাচ্চা পযর্šÍ নিতে দেয়নি। কেন তার সাথে আর। তাই ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছি। পন্টি তাকে বাসায় নিমন্ত্রণ জানায়। জোছনা আসবে বলে বিদায় নেয়।

পন্টি চিন্তিত হয়ে পড়ে। জোছনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে রাজু উদগ্রীব থাকে। অরণির কী অবস্থা কে জানে! রাজু এখনো তার একাউন্টে টাকা পাঠায়। এ সব সামি-সাজু জানে। কিন্তু তারা যেহেতু পন্টির সাথেই ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছে এবং পন্টি তাদের মাতৃ¯েœহ দিতে কাপর্ণ্য করেনি সেহেতু তারা মায়ের অভাব কখনো বোধ করেনি। মায়ের জন্য আলাদা কোন অনুভ‚তি তাদের নেই। সব আবদার সব অভিযোগ পন্টির কছে। তাদের জন্য পন্টি বাচ্চা নিতে চায়নি। রাজু জোর করে সন্তান নিয়েছে। কারণ রাজুর অনুপস্থিতিতে পন্টি যাতে বিপদে না পড়ে। তার নিজের সন্তান থাকা দরকার।

রাজু-পন্টি-অরণি, জোছনা-লোকমান কারো মনেই বস্তুতঃ কোন সুখ নেই। সবাই দারুণ অভিনয় করে যাচ্ছে। অরণি আর বিয়েই করেনি। বাপের বাড়ির এক কোণে পড়ে থেকে রাজুর পাঠানো টাকায় চলে। যে ঝামটি দিয়ে সে রাজুর সাথে কথা বলতো, র্জাুর মনোজগতকে তছনছ করে দিতো সে ঝামটি এখন রোজ নিজে খায়। ভাই, ভায়ের বউ পাড়া প্রতিবেশি এদের থেকে। চাকুরি করার মতো মানসিক জোর তার ছিলো না। শেষে বাপের বাড়ির এক কোণে শেড তুলে নিজের মতো করে থাকার চেষ্টা করে। আর চেয়ে থাকে কোন একদিন তার সন্তানেরা আসবে তার কাছে। রাজুর সাথে উদ্ভট আচরণের জন্য সে তার মা-বাবাকে এখন দায়ী করে। সেই দুষ্টু মা এখন আর মেয়ের জন্য চিন্তা করে না। মাঝে মাঝে বিয়ের পয়গাম নিয়ে আসতো । অরণির হাতে ঝামটি খেয়ে তা বন্ধ করেছে। সময়ের পরিক্রমায় সে মা এখন বিছানায় অরণি ভুল করেও তার কাছে যায় না। তার স্বামী তার সন্তান কোথায় হারিয়ে গেছে! তার শ্বাশুড়ি তাকে অদ্ভুত ভালোবাসতো। সে বুঝেও না বোঝার ভান করতো। কতো কষ্টই না তাকে দিয়েছে! খাবার পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। শুধু মাত্র মায়ের বাবার কুটকাচালির জন্য। অরণি মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদে। মানসিক রোগীর মতো হয়ে গেছে। রাজুর টাকা এলেই সে কাঁদতে বসে। তুমি কোথায়?

এতো জেদ এতো অভিমান করেছো যে আর ফিরে চাইলে না। সে কান্নায় আশপাশের লোক জড়ো হয় । সে সবাইকে পুণঃ পুণঃ বলতে থাকে তার সোনার সংসার তার ময়ের জন্য ভেঙেছে। অর্ধ-উন্মাদ অরণির ঠাঁই কোথায়? ওদিকে লোকমান আর বিয়ে করতে পারেনি। তার বদ স্বভাবের জন্য হেপাটাইটিস বি পজেটিভ এবং একটিভ ধরা পড়েছে। চিকিৎসার টাকা যোগাতে যোগাতে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখন সে অনুতপ্ত। জোছনা কী পারবে তার কাছে ফিরে যেতে !

রাজু সে রাতে ভালো ঘুমাতে পারেনি। পারেনি পন্টিও। অরণির কথা বার বার মনে পড়ছে রাজুর। কেমন আছে সে? পন্টি ভাবছে এ সংসার তাকে কী ছাড়তে হবে? নাস্তার টেবিলও তারা অন্য দিনের মতো প্রাণবন্ত ছিলো না। পন্টিই কথাটি তুলেছে,চলো যাই ম্যাডামকে দেখে আসি। অনেক হয়েছে। রাজুর মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। এমন হোক তা আমি চেয়েছিলাম? পন্টি আবার মুখ খোলে এতো বড়ো বাড়ি খালি পড়ে আছে। উনাকে নিয়ে আসি। রাজু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আবার বাসা পাল্টাতে হবে! পন্টি বলে , না। বাসায় একজন শুধু যোগ হবে। রাজুর চোখ ভিজে ওঠে, তবু সে স্থির তাকিয়ে থাকে যে শর অন্তরে অরণি গেঁথে দিয়েছে তাতো আজো খুলিনি।

খুলতে গেলেই রক্তপাত হবে। আবার রক্তপাত চাই না। ঠিক সে সময় হাঁফাতে হাঁফাতে জোছনা এলো। লোকমান মারা গেছে। তার চোখে জল। বুক পিঠ বারবার দুলে উঠছে। এলামেলো চুল আঁচল বাতসে উড়ছে। উ™£ান্ত। আমি তো তাকে ভালোবাসতাম। এমন হবে তাতো ভাবিনি!

রাজুর অন্তরে অরণি জোছনার অন্তরে লোকমান। অথচ তারা ছিলো আজীবন বিচ্ছিন্ন। এর জন্য দায়ী কারা?

পন্টি উঠে জানালার পাশে দাঁড়ায় তবে কী সারাজীবন আমি অরণি হয়েই ছিলাম। রাজুর অন্তরে পন্টির জায়গা কোথায়? আমার মাঝে রাজু অরণিকেই লালন করেছে।? এতোকাল এতো দিন পর কোথা থেকে জোছনার উদয় হলো যে অরণি জীবন্ত হয়ে উঠেছে! আমি পন্টি কাজের লোকই ছিলাম? আমার প্রেম-ভালোবাসা সবই অরণির প্রেম ছিলো? রাজু অরণির সাথে জেদ করে আমাকে বিয়ে করেছে, ভালো কী কখনোই বাসেনি?

সামি-সাজু-ধ্রæবর মাঝে অরণি এক দেয়াল। যেখানে পন্টি ছিলো কেবল নার্স। তবু সে সামি-সাজুকে ভালোবাসে। এসব ভাবনায় যখন অরণি ক্লান্ত তখনই রাজু পন্টি পন্টি বলে ডাক দেয়। পন্টি ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। এক কাপ চা হবে?
হ্যাঁ, হবে। বলে কিচেনে যায়।

ইজি চেয়ারে হেলানরত রাজু চোখ বুজে আছে। জীবনের হিসেব মেলানো যায় না। চেয়েছি কী ! হয়েছে কী! পেয়েছি কী! এ জায়গা সম্পূর্ণ ছিলো অরণির। আজ অরণি কোথায় আমি কোথায় ! কোথায় আমাদের সন্তান! সেদিন যদি অরণি এমন ব্যবহার না করতো পন্টিকে নিয়ে বের হতে হতো না। মানুষকে মর্যাদা দিতে শিখতে হয়। পন্টি তা সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছে আমাকে সুখি করতে । আমি পেরেছি তাকে আজও মন থেকে মেনে নিতে! হায় জীবন!

চা নাও। রাজু হাত বাড়িয়ে চা নেয়। চায়ের স্বাদ ভিন্ন। চোখ মেলে দেখে আউলা ঝাউলা চুলের, রঙপোড়া এক মধ্যবয়স উত্তীর্ণ নারী ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে আছে। কপালে অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। রাজুকে চিনতে পারছে না। রাজু উঠে দাঁড়ায় । কে কে?

মা পাখিটা আবারো ব্যতিব্যস্ত ! আবার লেগেছে আগুন! তার সন্তানেরা আসি আসি করছে। এবার সে কী করে তাদের রক্ষা করবে!

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর সাধারণ
কবি, প্রাবন্ধিক, ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top