আমি ছড়ার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ –
লুৎফর রহমান রিটন
কেউ কেউ ধরাকে সরা জ্ঞান করে, আর আমি ধরাকে ছড়া জ্ঞান করি।
আমার পৃথিবীটা ছড়াময়।
আমার সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে সর্বত্র ছড়ানো ছিটানো ছড়া আর ছড়া। আমি জেগে থাকি ছড়া নিয়ে। ছড়াও জেগে থাকে আমার সঙ্গে। আমি ঘুমুতে যাই ছড়া নিয়ে। ছড়াও ঘুমোয় আমার সঙ্গে। ছড়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অদ্ভুত। আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাই না। মাঝে মধ্যে খুনসুটি কিংবা অভিমান যে হয় না তাতো নয়। হয়। আমি কিছুদিন রাগ করে অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করে দিই ছড়ার সঙ্গে। ছড়াও আমার সঙ্গে রাগ করে, অভিমান করে। ছড়াও মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তখন আমাদের শুরু হয় বিরহকাল। খুবই ক্ষণকালের এই বিরহকাল, তবে এই সময়টায় আমি সবচে বেশি মিস করি ছড়াকেই। ছড়াও মিস করে আমাকেই। তখন আমাদের মধ্যে এক ধরণের সন্ধি হয়। আর সেই সন্ধি অনুযায়ী আর আমরা ঝগড়া করবো না, ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে কথা চালাচালি বন্ধ হবে না ক্ষণকালের জন্যেও—এই রকম একটা বোঝাপড়া হবার কিছুদিনের মধ্যেই যথারীতি আবারো শুরু হয় ঝামেলা। আবারো চুক্তি ভংগ। আবারো অভিমান। তবে একটা বিষয় এখানে বলে রাখা ভালো যে,আমাদের এই অভিমানকালে বা বিরহকালে আমাদের পারস্পরিক হৃদয়ের টান যায় বেড়ে। আমাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর প্রেম যায় বেড়ে। আমাদের পারস্পরিক আকর্ষণ যায় বেড়ে। ছড়ার সঙ্গে আমার কিংবা আমার সঙ্গে ছড়ার এই যে সম্পর্কটা, প্রেমিক-প্রেমিকার মতো, এই সম্পর্কটার কি নাম দেয়া যায়? অনেক ভেবেছি, কিন্তু কোনো নাম আমি খুঁজে পাই নি। অবশ্য এটাও ঠিক যে, নামের দরকারটাই বা কি? কোনো রকম নামের তোয়াক্কা না করেই যে সম্পর্কটা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে টিকে আছে তাকে হঠাৎ নাম দেবার জন্যে এতো ব্যাকুল হচ্ছি কেনো?
থাক। নামকরণের জটিলতায় না গিয়ে বরং সম্পর্কটাকে উপভোগ করা যাক।
সারা দিনমান কাজতো আমার একটাই —ছড়া পড়া, ছড়া লেখা আর ছড়া নিয়ে বিস্তর ভাবনা করা। আমি আর ছড়া হাত ধরাধরি করে হাঁটি। নির্জন কফিশপে ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতে দিতে ছড়াকে আদর করি আমি। আমাকেও আদর করে ছড়া। আমার পাশের সিটে মুভি-থিয়েটারে ছড়া এসে বসে থাকে। ছড়া আমার সঙ্গে লংড্রাইভে যায়। যেতে যেতে রবীন্দ্র-আধুনিক-ক্লাসিক্যাল-নজরুল কিংবা লালন শোনে। ল্যাপটপ খুললেই মনিটরে ছড়া এসে নাচানাচি করে। বাথটাবে উষ্ণ-শীতল জলে মিলেমিশে স্নান করি ছড়া আর আমি। আমি কখনো বিষণ্ণ হলে ছড়াও বিষ্ণণ্ণ হয়। বিষণ্ণ ছড়া এসে শুয়ে থাকে আমার শিয়রের পাশে। পার্কের বেঞ্চিতে বিকেলের মুগ্ধতা আমি আর ছড়া মিলে ভাগাভাগি করি। ঘোর লাগা সন্ধ্যায়, সূর্যাস্তের আবীর লেপ্টে থাকে আমার চিবুকে। ছড়ার চিবুকেও আমি সেই আবীরকে অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করে গুনগুনিয়ে উঠি—’তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ’!
ছড়ার কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়–‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ’……!
দুই
আমি ননস্টপ ছড়াকার। সব সময় লিখতে পারি। যখন তখন লিখতে পারি। ছড়া লিখবার জন্যে আমার রাত্রির নির্জনতার দরকার হয় না। শুনশান নিরবতার দরকার হয় না। কাজের থেকে ছুটি নেবার প্রয়োজন হয় না। উইকএন্ডের জন্যে অপেক্ষা করে থাকতে হয় না। রাত তিনটা, ভোর পাঁচটা, সকাল সাড়ে দশটা, দুপুর আড়াইটা, বিকেল চারটা কুড়ি, সন্ধ্যে সাতটা, রাত্রি নটা কোনো ব্যাপার নয়। চব্বিশ ঘন্টার প্রতিটা মুহূর্তই আমার কাছে ‘রাইম টাইম’, ছড়া লেখার উপযুক্ত সময়। ছড়া লিখবার জন্যে নির্দিষ্ট কোনো ঘর বা চেয়ার টেবিল আমার লাগে না। বাংলাদেশে থাকার সময় বেশিরভাগ ছড়াই আমি লিখেছি সোফায় বসে ক্লিপবোর্ডে, ডায়নিং টেবিলের কোণায় বসে অথবা উপুর হয়ে বিছানায় শুয়ে কিংবা ফ্লোরে কার্পেটের ওপর শুয়ে বসে। ছড়ার প্রতি আমার নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দেখে, ছড়া লিখে নামটাম করার পর আমার স্ত্রী শার্লি আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে কাঠমিস্ত্রি ডেকে এনে বিদেশী ক্যাটালগ দেখিয়ে অনেক কায়দা-কানুন সমৃদ্ধ চমৎকার একটি লেখার টেবিল বানিয়ে দিয়েছিলো। ওটায় বসে দু’চারদিন কিছু ছড়া আমি লিখেছিলাম বটে কিন্তু ওই টেবিল আমাকে খুব বেশি টানেনি। আমি যথারীতি সোফায় কিংবা বিছানায় অথবা ফ্লোরের কার্পেটে গড়াগড়ি খেতে খেতে ছড়া লিখে গেছি আগের মতো। বন্ধু সুহৃদরা দামি দামি সুন্দর সুন্দর খাতা কলম আর ডায়েরি প্রেজেন্ট করেছে কিন্তু আমি কখনোই ওইসব দামি খাতা কিংবা ডায়েরিতে ছড়া লিখে সুবিধে করতে পারিনি। এই ক্ষেত্রে আমার স্বভাবটা অভাবের কারণে একেবারেই দারিদ্র্যপীড়িত বলা চলে। আমি সব সময় ছড়া লিখেছি টুকরো কাগজে। বাজারের ফর্দ, দোকানের ঠোঙা, সিগারেটের প্যাকেটের উল্টোপিঠ, সিনেমার টিকিট, বাস টিকিট, পেট্রোল পাম্পের রশিদ, দর্জির রিসিপ্ট কিংবা সস্তা নিউজপ্রিন্টের প্যাডেই লিখেছি বেশিরভাগ ছড়া।
কানাডার বিখ্যাত শপিংমল থেকে খুব চমৎকার বাঁধাই করা দামি কাগজে রুলটানা ‘অভিজাত খাতা’ এবং ‘লেখার ডায়েরি’ কিনে জন্মদিনে উপহার দিয়েছে কোনো কোনো বন্ধু। কিন্তু এইসবে পোষায় না আমার। টুকরো কাগজ জিন্দাবাদ। যদিও এই টুকরো কাগজে লিখি বলে কতো কতো ছড়া যে হারিয়েছি এই জীবনে তার কোনো হিশেব নেই!
তিন
ছড়া লিখতে বিশেষ কোনো পরিবেশ আমার দরকার পড়ে না। আমি বাড়িতে না গাড়িতে, পার্কে না সমূদ্রে, রাস্তায় না শপিংমলে, বাসস্টপে না ট্রেনে, এরোপ্লেনে না রিকশায়, আকাশে না পাতালে(বেসমেন্টে) সেটা আমার ছড়া লিখবার ক্ষেত্রে কোনো ফ্যাক্টর নয়। নো ম্যাটার হোয়েন এন্ড হয়্যার আয়েম। ছড়া লিখতে আমার কোনো এল্কোহল নিতে হয় না। নিকোটিন নিতে হয় না। ওয়াইন কিংবা হুইস্কি বা বিয়ার পান করাটা মোটেও জরুরি নয়। ছড়া লিখতে গাঁজা চরস কিংবা সিগারেট কিছুই ফুঁকতে হয় না আমার। ছড়াতে মগ্ন এবং আচ্ছন্ন থাকবার জন্যে মাদকাশ্রয়ী হতে হয় না আমাকে। ছড়াটাই তো আমার কাছে চমৎকার এক মাদকবিশেষ। এ এক অপরূপ নেশা। এই নেশার ঘোরে বুঁদ হয়েই তো কাটিয়ে দিলাম দীর্ঘ দিবস আর দীর্ঘ রজনীর প্রায় পঞ্চাশটি বছর! সুন্দরী নারীর পেছনে আমি ছুটি না। আমার সমস্ত ছোটাছুটি ছড়ার পেছনে। সেই ছেলেবেলা থেকে ছড়ার পেছনেই ছুটছি আমি নিরন্তর। নির্বোধ বালকের মতো। মুগ্ধ কিশোরের মতো। পাগল প্রেমিকের মতো। ড্রাগএডিক্ট যুবকের মতো। সম্ভবত আমার নাছোরবান্দা টাইপের লেগে থাকা ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে ছড়াও আমাকে খানিকটা ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবেসে ছড়াও ধরা দিয়েছে আমার হাতে। আমি যেমন ছড়াকে ছাড়ি না তেমনি ছড়াও ছাড়ে না আমাকে।
জীবনের নানা রকম দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জটিলতার কারণে নিয়তির দাবড়ানি খেয়ে ২০০১-এর মধ্যভাগ থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে প্রবাস জীবন বেছে নেবার পর নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষুব্ধ অভিমানে সবকিছু ছেড়ে দেবার প্ল্যান করেছিলাম। এমনকি ছড়াকেও। কিন্তু আমি ছাড়তে চাইলেও ছড়া তো আমাকে ছাড়ে না। শীত আর তুষারের দেশ কানাডায় হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ফর্টিতে ছড়াকার স্বয়ং প্রায় ফ্রোজেনফিস হয়ে গেলেও ছড়াগুলো বরফের সমুদ্রের মধ্যেও থাকে ফিটফাট। হাড্ডিজমাট শীতেও ছড়াগুলো থাকে ক্রিস্টালের মতোই ঝকঝকে, চকচকে। আমার ছড়ার ফ্যাক্টরি খোলা থাকে টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স। সেভেন ডেজ আ উইক। সপ্তাহে সাতদিন। ছড়ার পঙ্ক্তি এবং মিলগুলো দিবানিশি ঘুরে বেড়ায় আমার আশপাশ দিয়ে। হাত বাড়ালেই ধরা দেয়। কিন্তু সব সময় ওদের ধরি না বা ধরতে পারি না। কখনো কখনো ধরা পড়ার পরেও ওরা পালিয়ে যায় কিংবা হারিয়ে যায়। মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরেও অদ্ভুত সব মিল বা অন্ত্যমিল এসে কড়া নাড়ে করোটিতে। আলস্যের কারণে ঘুম থেকে উঠে সেই মিলগুলোকে আর টুকে রাখা হয় না। সকালে ঘুম ভেঙে যাবার পর স্মৃতি হাতড়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা অন্ত্যমিলকে আর উদ্ধার করা যায় না। মধ্যরাতে নাজিল হওয়া ফাজিল মিলসমূহ নিখোঁজ, চিরতরে। চলতি পথে বাসে ট্রেনে কর্মস্থলে যখন ওরা হানা দেয় তখন টুকরো কাগজে, বাস ট্রেনের টিকিটে, গ্রোসারির রশিদে ওদের টুকে রাখি। শার্ট-প্যান্ট আর জ্যাকেটের পকেটে কিংবা ওয়ালেটে থাকতে থাকতে বিরক্ত অভিমানী পঙ্ক্তি আর মিলগুলো একদিন হারিয়ে যায়। ডালাস প্রবাসী আমার এক লেখকবন্ধু মুহাম্মদ জুবায়ের একবার আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন—‘টুকরো কাগজে টুকে রাখা ছড়ার টুকরোগুলোকে যেখানে সেখানে ফেলে না রেখে একটি নির্দিষ্ট ড্রয়ারে জমা রাখুন।’ তাঁর পরামর্শও সব সময় অনুসরণ করা হয়নি আলসেমির কারণে। আজ রাখবো কাল রাখবো করে করে পকেট কিংবা ওয়ালেটেই পড়ে থাকতে থাকতে একসময় অনাবশ্যক কাগজের টুকরো হিশেবে ওরা ড্রয়ারে ঠাঁই না পেয়ে ঠাঁই পেয়েছে আবর্জনার ঝুড়িতে।
চার
টুকরো কাগজে ছড়া লিখবার যে অভ্যেস আমার দীর্ঘ দিনের, সেটা কি পরিবর্তিত হয়েছে? এক কথায় এর উত্তর—হয় নি। এখনো আগের অভ্যেসটাই বহাল আছে আমার। তবে এরমধ্যে নতুন একটা প্রযুক্তি এসে যুক্ত হয়েছে এইটুকুই যা নতুন। টুকরো কাগজকে বহাল রেখেই কম্পিউটারের স্ক্রিনেও এখন ছড়া লিখি আমি। এক্ষেত্রে টুকরো কাগজে লেখার পরিমাণ ৫০% আর ল্যাপটপে ৫০% বলা যেতে পারে। গদ্য লিখতে ল্যাপটপটেই স্বাচ্ছন্দ বেশি। এই যে এখন ছড়া ভাবনা লিখছি, এটা রচিত হচ্ছে ল্যাপটপে।
মধ্যরাতে ঘুমের ভেতরে ছড়ার যে পঙ্ক্তিগুলো করোটিতে এসে কড়া নাড়ে সেগুলো বেডসাইড টেবিলের ওপর থাকা ছোট্ট নোট বইতে টুকে রাখি। সকালে ঘুম থেকে জেগে প্রায় হিব্রু ভাষায় লেখা নোটটা উদ্ধার করি। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ছড়া চলে এলে দ্রুত ইমার্জেন্সি লাইট অন করে কাছাকাছি কোথাও গাড়িটা পার্ক করে খুব দ্রুততায় টুকে রাখি ছড়াটাকে। নইলে সেটা অভিমান করে হারিয়ে যায়। স্মৃতি থেকে কিছুতেই তাকে আর ধরতে পারি না। এই রকম বহু ছড়াকে একটু পরে লিখবো বলে উপেক্ষা করে পস্তাতে হয়েছে পরে। ছড়াগুলো এই জীবনে আর আসেনি আমার কাছে। ইদানিং আমি তাই কোনো রিস্ক নিই না। ছড়াকে অবহেলার শাস্তিটা খুবই কষ্টকর। এই শাস্তি পেতে পেতে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। ‘আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাই রে’র মতো এসে চলে যাওয়া ‘ছড়ার ছবিটা’ আর খুঁজে পাই না। এই খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা ভয়াবহ। নতুন ছড়া লিখতে গেলে হারিয়ে যাওয়া ছড়াটার আবছা ছবিটা ড্রাউজি একটা ইমেজ নিয়ে সামনে আসে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আবার আসে আবার মিলিয়ে যায়। এইভাবে একটা কেমন আউট অব ফোকাস সারফেসের মধ্যে আমাকে আটকে রাখে। আমি না পারি নতুন ছড়াটা ধরতে না পারি পুরনোটাকে ইগনোর করতে। ফলে একটা আউট অব ফোকাস নো ম্যান্স ল্যান্ডেই আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই দাঁড়িয়ে থাকাটা অস্বস্তিকর। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ একটাই। আর সেটা হচ্ছে ঝটিতি ছড়া এসে কড়া নাড়ার মুহূর্তেই, ওটাকে লিখিত অবয়বে নিয়ে আসা। সেটাই করি আমি।
আমার প্রতিটা মুহূর্তই তাই ছড়ার মুহূর্ত।
আমার পৃথিবীটা তাই ছড়াময়।
আমি ছড়ার সঙ্গে বেধেছি আমার প্রাণ……
অটোয়া ২৮ ডিসেম্বর ২০২১
[ লুৎফর রহমান রিটনের প্রতিকৃতি / শিল্পী নিয়াজ চৌধুরী তুলি]