ঢাকা দক্ষিণ বন্ডে কমিশনার মোহাম্মদ লুৎফর রহমান এর নেতৃত্বে ঘুষ বাণিজ্য; নিরব উপর মহল

Screenshot_20250412_142057_Picsart.jpg

কাস্টম বন্ড কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণের কমিশনার মোহাম্মদ লুৎফর রহমান। ফাইল ছবি।

অপরাধ প্রতিবেদকঃ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিয়ন্ত্রণাধীন কাস্টম বন্ড কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণের কমিশনার মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে চলছে দেদারছে ঘুষ বাণিজ্য।

কমিশনারসহ উর্দ্ধতন সকল কর্মকর্তারা ঘুষের রাজস্ব কায়েম করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে শতশত কোটি টাকার মালিক বনে গিয়েছেন। এমনকি অভিযোগ সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে এসেছে।

কমিশনে আসা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের বিশেষ করে গার্মেন্টস ও প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আহরণের অন্যতমখাত কাস্টম বন্ড কমিশনারেট দক্ষিণ।

পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বন্ডের বিদেশি কাপড়ের রমরমা ব্যবসা। তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগি অ্যাকসেসরিজ প্রস্তুতকারীদের অনেক প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সামগ্রী বিভিন্ন ধরনের কাগজ,প্লাস্টিক,পলিমার ইত্যাদি এনে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এদের একটি বড় মার্কেট রয়েছে ঢাকার নয়াবাজার। আর এসব অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ঢাকা কাস্টম বন্ড কমিশনারেট দক্ষিণের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, উপ-কমিশনার থেকে সহকারি কমিশনার ও নিম্নপদের সকল কর্মকর্তারা।

আর প্রতিটি অনিয়মে ঘুষ গ্রহন করে থাকে এসব কর্মকর্তারা। তাদের নির্দেশ ছাড়া কোন ফাইল এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় না।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা আমদানিকৃত কাঁচামাল বন্দরের কাস্টমস কমিশনারেটে খালাস হওয়ার পর এগুলো সরাসির নির্ধারিত বন্ডেড ওয়্যারহাউসে যাওয়ার কথা। বন্দর কাস্টমস কমিশনারের অফিস আমদানির তথ্য বন্ড কমিশনারেট অফিসে পাঠাবে। এরপর ওয়্যারহাউসের রেজিস্টার ও পাস বইতে লিপিবদ্ধ করার পর রফতানির উদ্দেশ্যে পোশাক প্রস্তুতে এসব কাঁচামাল ব্যবহার হবে। কিন্তু তা না করে অসাধু ব্যবসায়ীরা বন্দর কাস্টমস অফিস থেকে সরাসরি বাজারে এনে গোপনে বিক্রি করে দেয়। যাহাতে বন্ড কমিশনারের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার থেকে নিম্নপদের সকল কর্মকর্তারা ঘুষের বিনিময়ে চুপ থাকেন।

ইউডি ইস্যুর চেয়েও এর সংশোধনী দেয়ার কারণে অনিয়ম ও দুর্নীতি আরও বেশি হচ্ছে। বর্তমানে ইউডি প্রদান ডিজিটাল বা অনলাইনে ব্যবস্থায় করা হলেও ইউডি সংশোধন অনলাইনে করা যায় না। ফলে দুর্নীতি হচ্ছে।

এদিকে অডিট করা বা পাস বই চেক করা বা ওয়্যারহাউজ সরেজমিনে পরিদর্শন বা রফতানির উদ্দেশ্যে গার্মেন্টস প্রস্তুতে আমদানিকৃত পণ্য ব্যবহার হলো কিনা তা নিয়মিত দেখতে বা যাচাই করার কথা থাকলেও উক্ত দুর্নীতিবাজ কাস্টম কর্মকর্তারা ঘুষের মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা নিয়ে তা না করে গার্মেন্টস মালিকদের এই সুবিধা দিচ্ছেন।

অন্যদিকে লাইসেন্স প্রাপ্তি বা নবায়ন বা বাতিলের চেয়ে কাস্টম আইন অনেক কঠিন। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্মকর্তাদের যোগসাজসে কঠিন আইন লাখ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে সেটাও সহজ হয়ে যায়। যার প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে ঘুষ দিতে হয় কমিশনার থেকে সবাইকে। অতীতে এমন কোন কমিশনার সরাসরি ফাইল প্রতি ঘুষ নেননি যা বর্তমান কমিশনার নিয়ে থাকেন। এছাড়া রফতানির ভূয়া কাগজ তৈরি হয়।

এসব কাজে সরাসরি কমিশনার,অতিরিক্ত কমিশনার থেকে সবার নির্দেশে এই সুবিধা বিনিময় চলে।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ফ্যাক্টরি বন্ধ, কোন প্রডাকশন নেই, অথচ বন্ধ কারখানার নামে কাঁচামাল আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন কাস্টম কর্মকর্তাদের ঘুষের বিনিময়ে। আর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ব্যাহত হচ্ছে রাজস্ব আহরণ।

এদিকে বর্তমান কমিশনার মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের রয়েছে দেশে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ। সাথে অতিরিক্ত কমিশনার মির আবু আবদ্ল্লাহ আল সাদাতের নামেও রয়েছে বিপুল সম্পদ। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিপুল পরিমাণ ঘুষ দাবি করায় সেই অভিযোগ সরাসরি এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে যায়। এরপর এনবিআর চেয়ারম্যান এই অভিযোগে অতিরিক্ত কমিশনার সাদাতকে দ্রুত বদলি করে সিলেট ভ্যাট কমিশনারেটে। এমনকি ঢাকা ও বিদেশে কমিশনার থেকে অতিরিক্ত কমিশনার শতশত কোটি টাকার সম্পদ। শেয়ার বাজারেও রয়েছে রয়েছে বিনিয়োগ।

যেভাবে চলে ঘুষের হাটঃ লাইসেন্স ইস্যুতে নেওয়া হয় প্যাকেজ ঘুষ, লাইসেন্স নবায়নে ঘুষের শুরু হয় ৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত। যেখানে কমিশনার পান ৫ লাখ, ডিসি পান ৬-৭ লাখ,আরও ২-৪ লাখ, এআরও ১০-১৫ লাখ, সিপাহী ও শাখা সহকারি ২০-৫০ হাজার।

বার্ষিক নিরীক্ষার নামে চলে প্যাকেজ ঘুষঃ বন্ডের হয়রানি আর ঘুষের আরেক স্বর্গরাজ্য হলো বার্ষিক নিরীক্ষা শাখা। বন্ড প্রতিষ্ঠানের আমদানি রফতানি নিয়ে প্রতি বছর বার্ষিক নিরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে সমস্যা না থাকলেও দিতে হয় ঘুষ। যেসকল প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করেনি তাদেরও বার্ষিক নিরীক্ষা করতে দিতে হয় ৫-৭ লাখ টাকা ঘুষ। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম থাকে তাদের দিতে হয় ৫০ লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত। সমস্যার ধরণ অনুযায়ী নিরীক্ষা শাখার এআরও ঘুষের দরদাম ঠিক করে দেন। ঘুষের টাকায় জেসি নেন লাইসেন্স প্রতি ৪-৫ লাখ, রাজস্ব কর্মকর্তা ২ লাখ, সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা ৫ লাখ, শাখা ৫০ হাজার, সিপাহী ও ফালতু নেন ১০ হাজার।

ইউপিতে ঘুষ নেওয়া হয় ডিপিএস পদ্ধতিঃ ডিপিএস পদ্ধিতে ঘুষ ভাবতে পারেন। কিন্তু ভাবনার জায়গা থেকে বেরিয়ে এবার একটু জেনে আসুন ঢাকা কাস্টম বন্ড কমশিনারেট দক্ষিণে কিভাবে ডিপিএস পদ্ধিতিতে কে কে ঘুষ নিয়ে থাকেন। এখানে ঘুষ নিয়ে থাকেন জেসি, ডিসি। প্রতিটি ফাইল স্বাক্ষর করার পর অটো টাকা চলে যায় একাউন্ড নাম্বারে। সমস্যা না থাকলে ১০ হাজার আর সমস্যা থাকলে ১০-৫ লাখ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।

এইচএসকোড অনুমোদনে দোকান বসিয়ে ঘুষ
একটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান। এইচএসকোড অনুমোদনে শাখায় ঘুষ দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। ডিসি থেকে কমিশনার পর্যন্ত ফাইল অনুমোদনে ঘুষ যায় ২ লাখ টাকা। আরও ফাইলে নোট দিতে নেন ২-১০ লাখ টাকা। আর প্যাকেজের ঘুষ পান আরও, ডিসি ও জেসি। অনেক সময় এডিসি ও কমিশনারও পান।

প্রিভেনটিভের নামে চলে ঘুষ বাণিজ্যঃ বন্ড সুবিধার কাঁচামাল যেন খোলা বাজারে বিক্রি না হয় সেজন্য প্রিভেনটিভ টিম কাজ করেন। রাতে বিভিন্ন সড়কে, মহাসড়কে, বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালানোর কথা এই টিমের। পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে রয়েছে বিশাল একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সাথে রয়েছে প্রিভেনটিভের বিশাল এক যোগসূত্র। এমন কি এই পণ্য কোথায় যাবে সেখানে পাহারা পর্যন্ত দিয়ে থাকে প্রিভেনটিভ টিম। যার বিনিময়ে নেন লাখ লাখ টাকা ঘুষ।

অপরদিকে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধায় আমদানি করা বেশিরভাগ মদ চলে যায় খোলাবাজারে। যেখানে সরাসরি জড়িত কমিশনার পর্যন্ত।

এ বিষয়ে জানতে কাস্টম বন্ড কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণের কমিশনার মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনবিআর) মো আবদুর রহমান খান গণমাধ্যমে বলেন, আমার কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে দুর্নীতি অভিযোগ উঠা বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো। আমি সেবা দিতে সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু সেবার পরিবর্তে যদি দুর্নীতিতে ভরে যায় তাহলে সেটা সমস্যা। আমি বিষয়টি দেখবো এবং কি হচ্ছে সেটা যারা দায়িত্বে রয়েছেন তলব করা হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন গণমাধ্যমে বলেন, কমিশনে প্রতিদিন শতশত অভিযোগ আসে। কাস্টম নিয়ে অভিযোগ ইদানিং বেড়েছে। আমি কমিশনার অনুসন্ধানকে ও তদন্তকে জানাবো যেন কাস্টম বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

তবে এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংষ্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, এনবিআরকে উচিত এগুলোর বিষয়ে নিজেদের আরও সচেষ্ট হওয়া। দুর্নীতি যারা করছে তাদেরকে রক্ষা করা হচ্ছে। উপযুক্ত শাস্তি হলে কখনো এটা বারবার হতো না। দুদকেরও উচিত যারা দুর্নীতি করছে তাদেরকে শক্তভাবে ধরা। তাহলে দুর্নীতি কমে আসবে।

আরও সংবাদ পড়ুন।

এনবিআরের সাবেক দুই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা

আরও সংবাদ পড়ুন।

অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক হচ্ছে

আরও সংবাদ পড়ুন।

ঘুষের বিনিময়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি – রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে

আরও সংবাদ পড়ুন।

সাভার ইয়ারপুর সার্কেলের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ দাবীর অভিযোগে দুদকের অভিযান

আরও সংবাদ পড়ুন।

কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক এর পৌনে ১০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ

আরও সংবাদ পড়ুন।

পোশাক রপ্তানির আড়ালে ১০ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার

আরও সংবাদ পড়ুন।

১০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অপরাধে উপ-কর কমিশনার মহিবুল ইসলামকে আটক করেছে দুদক

আরও সংবাদ পড়ুন।

ঘুষ দাবি কোটি টাকা; ভ্যাট অফিসের বাহারুল ইসলাম ও আল মনছুর সাময়িক বরখাস্ত

আরও সংবাদ পড়ুন।

বেনাপোল কাস্টমস হাউজের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা খন্দকার মুকুলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

আরও সংবাদ পড়ুন।

চারবার দুদকের ‘ক্লিন’ সার্টিফিকেট পান মতিউর! কিন্তু কেন?

আরও সংবাদ পড়ুন।

স্ত্রীসহ কাস্টমস কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন এর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

আরও সংবাদ পড়ুন।

ঘুস গ্রহন; শুল্ক ফাঁকি; দায়িত্বে অবহেলা – অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চলছে তদন্ত

আরও সংবাদ পড়ুন।

এনবিআর চেয়ারম্যান নিজেকে কি সম্রাট ভাবেন – হাইকোর্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top