সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য কেন?

Picsart_23-12-06_09-33-27-849.jpg

সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য কেন?

বিশেষ প্রতিবেদকঃ দেশে প্রচলিত আইন, সরকারের সিদ্ধান্ত, সর্বোপরি উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশ তাদের সম্পদের সঠিক হিসাব বিবরণী দিচ্ছেন না। অথচ সরকারি চাকরিতে ঢোকার সময় সম্পদের হিসাব দেওয়া এবং প্রতিবছর সেটা হালনাগাদ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই অনেকেই তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশ্যে আনতে চান না। অর্জিত সম্পদ রাখতে চান আড়ালে-আবডালে। এ নিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা অনেকটাই দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু কেন, কীসের ভয়, সমস্যা কী— এসব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই।

যে সরকারি কর্মচারীরা সম্পদের বিবরণী প্রকাশ্যে আনতে চাইছেন না, তাদের বক্তব্য হচ্ছে— তারা প্রতিবছরই আয়কর রিটার্ন জমা দেন। সেখানেই তো সব সম্পদের বিবরণ দেওয়া হয়। এরপরও কেন আলাদা করে হিসাব বিবরণী দিতে হবে? অপরদিকে সরকারি কর্মচারীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ বলছেন, কেউ যদি স্বচ্ছ থাকেন, যদি দুর্নীতি না করেন, তার যদি আয়বহির্ভূত সম্পদ না থাকে; তাহলে একবার নয়, সম্পদের হিসাব বিবরণী হাজার বার দিতেও তাদের কোনও সমস্যা থাকার কথা না। প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর নিজ সম্পদ বিবরণী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এটি চাকরির আচরণ বিধির অংশ। তবে চাকরির সেই আচরণবিধি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর এবং সংস্থারও তাদের অধীনস্ত কর্মচারীদের হিসাব নেওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি তৎপরতা দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি কর্মচারীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বার্ষিক হিসাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর বা সংস্থার কাছে দাখিল বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি। কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে দেশের তথা সরকারের সুনাম নষ্ট হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই দাবি উঠেছে।

সরকারি দফতরগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান ১৯৭৯ সালে চালু হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সম্পদের হিসাব জমা দিতে কড়া নির্দেশ দেওয়া হলে সে সময় সব কর্মচারী তা দিয়েছিলেন। নানা দিকে আলোচনা উঠলে ২০১৫ সালে আরেক দফা সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দিতে সরকার থেকে বলা হলে গুটিকয়েক মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রিত সংস্থা বা দফতরের কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নিতে পারলেও অধিকাংশই ব্যর্থ হয়।

বিশেষ করে চিকিৎসকরা এর বিরোধিতা করেন, প্রতিবাদ করেন জোড়ালো ভাবে।

১৯৭৯ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৩ বিধির ১নং উপবিধিতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন শেয়ার সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি ও ১০ হাজার টাকা বা এর অধিক সর্বমোট অলঙ্কারাদিসহ সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কে সরকারের নিকট ঘোষণা দিতে হবে।

আর উপবিধি-২-এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে ১নং উপবিধির অধীন ঘোষণায় বা সর্বশেষ দাখিলকৃত বিবরণীতে প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের নিকট দাখিল করতে হবে।

দুই দশক পর সরকার ২০০২ সালের শেষদিকে উপবিধি-২-এ সংশোধনী এনে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী দাখিলের সময় ‘প্রতিবছর পর ডিসেম্বর মাস’-এর পরিবর্তে ‘প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বর মাস’ করে।

অপরদিকে সরকারি কর্মচারী আইন (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১২ ও ১৩ অনুসারে সরকারি কর্মচারীর স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রি ও সম্পদ বিবরণী জমার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ যে কোনও সম্পদ কিনতে বা বিক্রি করতেও সরকারের অনুমতি নিতে হয় তাদের। সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে টাকার উৎস সম্পর্কেও জানাতে হয়। আবার সম্পদ বিক্রি করা হলে দাম জানাতে হয়। কারণ, কমবেশি দামে সম্পদ বেচাকেনা হলো কিনা, তা যাচাই করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রত্যেক বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব দাখিলের বিধান বিষয়টির গুরুত্ব বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে এবং সরকারি চাকরিজীবীদের এ বিষয়ে অনাগ্রহী করে তুলেছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশে বড় ধরনের দুর্নীতি ঠেকাতে দেশের সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে প্রতি বছর সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। তার পরেও সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি কয়েকজন আমলা ও কর্মচারীর দুর্নীতি ও তাদের আয়বহির্ভূত সম্পদ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলে কর্মকর্তা কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিলের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরই মধ্যে উচ্চ আদালত থেকেও এ সংক্রান্ত নির্দেশনা রয়েছে।

তবে এ প্রসঙ্গে চলতি বছরের জুনে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পত্তির যথাযথ হিসেব পেতে প্রচলিত নিয়মের বাইরে নতুন আইনের প্রয়োজন নেই।

জানা গেছে, গত ২ জুলাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল ও প্রকাশ সংক্রান্ত কর্মচারী বিধিমালা (আচরণ বিধিমালা) বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে আগামী ৩ মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

একজন আইনজীবীর ওই আবেদনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুদকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ১০ জনকে বিবাদী করা হয়েছে। আবেদনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব আইনে উল্লিখিত যথাযথ নিয়মে কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিলের পাশাপাশি ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

একজন জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশে অনীহা ব্যক্ত করে বলেছেন, ১৯৭৯ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৩ বিধির ১নং উপ-বিধিতে উল্লিখিত বিধান মতো প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন শেয়ার সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বীমা পলিসি ও ৫০ হাজার টাকা বা এর বেশি মোট অলংকারাদিসহ সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কে সরকারের কাছে ঘোষণা দেওয়ার কথা বলা আছে। সেটি কড়াকড়িভাবে সচল করা প্রয়োজন, একই সঙ্গে পরবর্তীতে প্রতি ৫ বছর পর পর সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিলের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নিজেরা স্বচ্ছ থাকলে এতে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়।

সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সরকারি চাকরিজীবী (আচরণ) বিধিমালার প্রস্তাবিত সংশোধনী সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার ও শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণার ঠিক উল্টো। প্রথমে প্রতিবছর সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও সরকারি কর্মচারীদের অনীহার মুখে পরবর্তী সময়ে শিথিল করে তা পাঁচ বছর পর পর দেওয়ার বিধান করা হয়। সেই বিধানও সঠিকভাবে পালনে অনাগ্রহ ছিল। চাকরির শুরুতে সম্পদের বিবরণী দিলেও পাঁচ বছর পরপর হিসাব হালনাগাদের বাধ্যবাধকতার গুরুত্বই দেন না সরকারি কর্মচারীরা। এখন এই বাধ্যবাধকতা সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো প্রকারান্তরে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠতে ব্যাপক উৎসাহ দেওয়া। কেননা, সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার মতো কোনও বিধান না থাকলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নির্ভয়ে দুর্নীতি, এর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুযোগ বাড়বে।

একইসঙ্গে প্রাপ্য সেবা পেতে সরকারি অফিসে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে। অবৈধ অর্থ লেনদেন বহুগুণে বাড়বে।

আরও সংবাদ পড়ুন।

সরকারী কর্মচারী (আচারণ) বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে : মন্ত্রিপরিষদ সচিব

আরও সংবাদ পড়ুন।

সরকারী কর্মচারী (আচারণ) বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে : মন্ত্রিপরিষদ সচিব

আরও সংবাদ পড়ুন।

সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রতি বছর দাখিলের নির্দেশ

আরও সংবাদ পড়ুন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব-উপসচিব পদে বড় পদোন্নতি আসছে

আরও সংবাদ পড়ুন।

৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭টি সরকারি পদ খালি – জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন

আরও সংবাদ পড়ুন।

রদবদল আসছে জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে

আরও সংবাদ পড়ুন।

ইউএনও এবং এসি ল্যান্ড’রা কাউকেই আমলে নিচ্ছেন না; মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত সরকার

আরও সংবাদ পড়ুন।

১২৭ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি

আরও সংবাদ পড়ুন।

ডিসি সম্মেলন উদ্বোধন করেছেন – প্রধানমন্ত্রী

আরও সংবাদ পড়ুন।

প্রশাসন ক্যাডারের পদ বেড়ে দ্বিগুণ;সিভিল সার্ভিস(প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার আদেশ-২০২৪ জারি

আরও সংবাদ পড়ুন।

চুক্তি থেকে কবে মুক্তি মিলবে পাঞ্জেরী? ক্ষোভ, দুঃখ ও কষ্টে চাপা পড়েছে জনপ্রশাসন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top