যাদুকর – সাগর চৌধুরী
বাবার কাছে অনেক দিন আগেই বায়না ধরে রেখেছিল নুহাশ। বাবা এবার জুয়েল কাকা এলে আমাকে কিন্তু তার কাছে নিয়ে যাবে। জুয়েল কাকা মানে যাদুকর জুয়েল আইচ।
বাবার এই কাজ সেই কাজ হাজারো কাজের অযুহাতে সে এড়িয়ে গেলে। নুহাশ মনে মনে বাবার উপরে বেশ রাগ হয়। বাবা এমন কেন ? সে যদি জুয়েল কাকার কাছে আমাকে নিয়ে যায়, তাহলে কি এমন কাজ বাদ পড়ে যায় তার। তাছাড়া বিকেলে পাশের বাসার কাকাদের সাথে যখন কার্ড খেলতে ক্লাবে যায়; তখন কি বাবার কাজের কোন ব্যাঘাত হয়, না ?
ইদানীং আম্মুও কেমন স্বার্থপরের মতো হয়ে গেছে । তার কোন কথার মূল্য নেই। এটা কেমন কথা; আম্মু যদি একটু বলে দেয় আব্বুকে, এবার জুয়েল কাকা বরিশালে এলে তার সাথে একটু দেখা করিয়ে দিতে।
টেলিভিশনে জুয়েল কাকা কত সুন্দর সুন্দর যাদু দেখায়। সেদিন সে দেখলো একটা মেয়ের পেটের উপর গাছ কাটার করাত দিয়ে কেটে মেয়েটিকে দু’টুকরা করে ফেলেছে।
এক ফোঁটাও রক্ত বের হয়নি । তারপর আবার কেটে ফেলার মিনিট কয়েক পরে মেয়েটাকে একসাথে জোড়া লাগিয়ে দিলেন। পরক্ষণেই মেয়েটা হেঁটে যেমনি মঞ্চে এসেছে তেমনি আবার হেঁটে চলে গেল। অবাক কাণ্ড!
তারপর আরো একটা যাদু সে দেখালো খোলা ঝুড়ির মধ্যে এক টুকরো সাদা কাগজ পুড়ে দিল। ডান হাত থেকে বা হাতে নিয়ে উপর নিচ করতেই সে বললো এবার দেখুন কেমন মজা।
ওমা একটা সাদা কবুতর উড়ে গেল। মনে হলো এ কেমন যাদু। ভাবতেই মনটা কেমন যেন শিরশির করতে লাগলো। আচ্ছা ঝুড়ির মধ্যে সাদা কাগজ কেমন করে যে
একটা কবুতর হয়ে গেল। এটা কেমন করে হয়!
তাহলে কি জুয়েল কাকা সেটাকে কবুতর না বানিয়ে অন্য কিছুও তো বানাতে পারতো !
জুয়েল কাকার এসব যাদু দেখে দেখে নুহাশ ভাবে যে ভাবেই হোক জুয়েল কাকার কাছে সে একদিন যাবেই । তারপর তার কাছে শিখে নেবে সব যাদু গুলো । তার কাছে বাবার কথা বলবে-‘সে তোমার কেমন বন্ধু জুয়েল কাকা? তুমি যে স্কুলে পড়েছো আমার আব্বুও নাকি তোমার সাথে পড়েছে।’
সে মনে মনে আরো অনেক কথা বলে। জুয়েল কাকার সাথে বাবা পড়ে থাকলে তার কাছে।
বাবা ফোন করেই তো বলে দিতে পারে। বলে দিতে পারে নুহাশ তোর কাছে যাদু শিখতে চায়। আমাদের স্কুলের রহমান স্যারের কাছে গিয়ে বলে দিতে পারে-‘স্যার নুহাশ আপনার কাছে অংক শিখবে।
জামান স্যারের কাছে গিয়ে বলে দিতে পারে-‘স্যার আপনার কাছে নুহাশ ইংরেজি পড়বে । কিন্তু জুয়েল কাকা তার বন্ধু মানুষ সে তো খুব সহজেই রাজি হবার কথা। বন্ধু বন্ধুকে বললে কথা শুনবে না। জুয়েল কাকা অবশ্যই শুনবে। সে খুব ভালো মানুষ।
আমাদের স্কুলের হেড স্যার একদিন বলেছিল জুয়েল কাকা নাকি প্রায়ই বরিশালে আসেন।
কিন্তু স্যারের কাছে বললে হয়তো জানা যেত তিনি কবে আসবেন। কিন্তু স্যারের রুমের সামনে একটু ঘুর ঘুর করতেই পিয়ন বুড়ো রহমত বললো-এই এখানে কি? হেড স্যারের ভয় দেখিয়ে বললো-এখানে কোন রকম দুষ্টামি করলে স্যার কিন্তু জোড় বেত দিয়ে পেটাবেন।
অবশ্য বুড়ো রহমতের কথা একেবারে মিথ্যে নয়। বেশ কিছু দিন আগে ক্লাস টেনের এক৷ ছেলেকে জোড়া বেত দিয়ে পিটিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছেন।
প্রথম প্রথম হেড স্যারকে খুব একটা ভালোলোক মনে হলেও এখন আর স্যারকে ভালোলোক মনে হয় না।
হেড স্যারটা বম বদ। এবার থেকে আবার নাকি নতুন নিয়ম হয়েছে স্কুলে – কোন ছেলে দুষ্টুমি করলে তাকে টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেবে।
তার চেয়ে জিনাত ম্যাডামকে অনেক ভালো লাগে।
ম্যাডাম অনেক ভালো ।
সেদিন দুপুরে বললো -‘নুহাশ বাসা থেকে টিফিন এনেছো ? না নিয়ে আসলে আমার এখানে টিফিন আছে খেয়ে নিও। এই ম্যাডাম আম্মুর ক্লোসমেট। আম্মুর সাথে এখনো তার অনেক ভাব।
এই ম্যাডামের কাছে বললেও কি সে পারবে না জুয়েল কাকার সাথে দেখা করিয়ে দিতে?
কেমন করে যে জুয়েল কাকার সাথে দেখা করা যায় । তার বিশেষ কিছু কথা আছে সে কথাগুলো জুয়েল কাকা ছাড়া আর অন্য কারো সাথে সে কথাগুলো বলা যায় না।
তাকে পেলেই কেবল কথাগুলো বলবো।
বেশ কয়েক দিন পরে একটা পত্রিকায় দেখতে পেল। জুয়েল কাকা বরিশালে আসছে শো করার জন্য। নুহাশের মনে কি আনন্দ এবার আর মিস করা যাবে না কোনভাবেই যেভাবেই হোক তার সাথে দেখা করতে হবে।
ক্লাসের বন্ধু অয়ন সাথে তার কথা হয়েছে। কিন্তু মনিরটাও না কেমন ম্যাদা মারা। ওকে বিষয়টা বলার পরে সে এখন কেমন পিছিয়ে যাচ্ছে। বলছে-‘না ভাই আম্মু আমাকে বকা
দিবে। তুমি একা যাও।’
এটা একটা কথা হলো। তোকে সবকিছু বুজিয়ে বলার পরও এমন বাগড়া দিয়ে বসবি, জানলে তো তোর কাছে কথাটাই বলতে আসতাম না। তার সাথে কথা বলতে গেলে, দেখা করতে গেলে তোর মা জানবে কেমন করে ? এই প্রশ্নে অয়নটা একেবারে চুপ করে রইলো। যেন এমন একটা ভাব, সে এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে আসছে।
অয়ন যেহেতু রাজি হলো না। সেহেতু ওর সাথে এই বিষয়ে আর কোন কথা নেই। নুহাশ মনে মনে স্থির করলো সে একাই যাবে। সে একাই যাবে এবং একাই। সে কি পুরুষ মানুষ না। মা বলেছে পুরুষ মানুষের কিসের ভয়? পুরুষরা এই বিশ্ব জয় করেছে।
মনে মনে ভাবে সেও একদিন এই বিশ্ব জয় করবে।
পত্রিকায় যে তারিখ দেওয়া আছে সে তারিখ আসতে এখনো বিশ দিন বাকি। এমন একটি দিনের জন্য তার কি প্রতীক্ষা। রাতদিন তার কি উত্তেজনা মনের ভেতর । তার কাছে যাদুর মন্ত্র শিখে সবার সামনে হিরোর মত যাদু দেখাবে।
সারা দেশের মানুষ তার হাতের কারিশমা দেখে অন্ধ হয়ে যাবে । যাদুর ছোঁয়ায় সব কিছু সে বিমোহিত করে তুলবে।
তার অটোগ্রাফ নেবার জন্য মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়াবে । মহল্লার বাচ্চার মায়েরা তাকে দেখিয়ে বাচ্চাদের বলবে- ওযে দেখ শোনা মানিক যাদুকর নুহাশ যাচ্ছে।
দিন আসে দিন যায়। তার চোখে মুখে আলোর ছটা। নান রকম কলা কৌশল এটে রাখে সে। যাদুর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর জন্য আলাদা একটা খাতা বানাতে হবে।
সেই খাতায় তার গোপন সূত্রগুলো লিখে রাখতে হবে। ভুলে গেলে যাতে আবার দেখে নিতে পারে।
তাছাড়া জুয়েল কাকা তো শুধু দেশের হিরো তা নয়। আব্বু বলেছে বিদেশেও তার অনেক ভক্ত আছে।বিদেশের অনেক দেশে সে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়।
ইংলেন্ডের রানি পর্যন্ত তার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরস্কার দিয়েছে। এমনি করে সে আরো কত পুরস্কার যে
পেল । কত দেশে যে তার যাদু দেখালো।
একটা সাদা কাগজের পৃষ্ঠা জুড়ে সে কতগুলোর খেলার নাম লিখে রেখেছে। জুয়েল কাকাকে সামনে পেলে যদি, তাকে দেখে সে খেলা গুলোর নাম ভুলে যায়। এই ভয়েই সে এগুলোর নাম আগে থেকে লিখে রেখেছে। তাছাড়া কোন কোন খেলা আগে শিখবে তার একটা তালিকাও সে করে রেখেছে ।
প্রথম শিখবে সেই খেলাটা যে খেলাটাতে এক টুকরো কাগজ দিয়েই একটা কবুতর বানানো যায়। এই খেলাটা বেশ মনে ধরেছে তার । তারপর পুতুল বানালো খেলাটাও বেশ ভালো লেগেছে । কিন্তু মেয়ের বুকে করাত চালিয়ে দুভাগ করা খেলাটা ভালো লাগেনি তার। সেটা দেখার সময় কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে গেল । এমন দম বন্ধ হওয়া খেলা খেলতে গিয়ে যদি তার নিজেরই দম বন্ধ হয়ে যায় তবে বিষয়টা কেমন হবে ? লোকজন তার খেলা দেখবে ? তাই এই খেলাটা শেখার দরকার নেই । অন্য খেলা গুলো শিখবো।
বিশ দিনের আর মাত্র আর চারদিন বাকি । পত্রিকায় আবারো একটা বিজ্ঞাপন দেখতে পেল সে । কোন এক কারণে এবারে অনুষ্ঠানটি আর হলো না । কি কারণে হলো না সেটা পত্রিকায় আর লিখেনি । নুহাশ আশা ভঙ্গের জন্য মন খারাপ করে রইলো ।
ওর খুব মন খারাপও হলো । এত কষ্ট করে সাদা কাগজে বিষয়গুলো পরিষ্কার করে সাজিয়ে লেখা হলো। আর কত রকমের ভাবনাচিন্তা ছিল। কিন্তু সে সব ভেস্তে গেল । এজন্য সে কাকে কি বলবে; এটাও বুঝে উঠতে পারছে না।
তবে রাগ, অভিমান যাই হোক; একটা
বিষয় তার কাছে পরিষ্কার, জুয়েল কাকা এবার বরিশালে আসছে না। আর এজন্যই চূড়ান্তভাবে নুহাশের মনটা খারাপ।
দিন কয়েক যাবার পর, একদিন রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেলে স্বপ্নের ভেতর দেখলো জুয়েল কাকা এসে তার হাত দুটো ধরে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
তারপর সবাইকে বললেন- ‘এতদিন আপনারা সবাই আমার যাদু দেখেছেন। এবারে আপনাদের সামনে যাদু
দেখাবেন আমাদের নুহাশ। সবাই করতালি দিল। রকমারী লাইটের আলোতে আলোকিত। মনে হচ্ছে দিনের আলোকেও হার মানায়। এত সুন্দর পরিবেশ ।
নুহাশের কি আনন্দ!
আজ সে সবার সামনে যাদু দেখাবে । হাজার হাজার লোক তার সামনে। এই লোকগুলোকে যাদু দেখিয়ে মন ভরিয়ে দিতে হবে।
সবাই যেন বলে; না ছেলেটা ভালো খেলোয়ার। ভালো যাদু জানে। চোখের নিমেষেই জুয়েল কাকা মঞ্চ থেকে
হাওয়া হয়ে গেলেন। আহা ! পুরো মঞ্চে সে এখন একা।
সামনের লোকগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে। যেন তার খেলা দেখার জন্য সবাই উদগ্রীব।
এবার খেলা দেখানোর পালা। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে গিয়ে একটা বক্স বের করে সবাইকে দেখালো এর মধ্যে কিছু নেই। সত্যি এর মধ্যে কিছু নেই। হাত নেড়ে নেড়ে
বোঝালো সবাইকে।
তারপর জুয়েল কাকার মত বা হাতের তালুতে বক্সটা নিয়ে ডান হাতে নিয়ে আলতো করে বক্সটার ভেতরে একটা লাল কাগজ রেখে, সবাইকে দেখালো এর মধ্যে শুধু একটা লাল কাগজ ।
মুখে বললো -‘দেখুন এটা একটা লাল কাগজ । আর কিছু কি এর মধ্যে আছে ? ‘
উৎসুক জনতা সমস্বরে বললো-‘না’।
তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে নুহাশ বললো-‘আপনাদের সবাইকে আজ একটা করে লাল গোলাপ দেব । সত্যি আপনারা রাজি আছেন তো ?
উৎসুখ জনতা সমস্বরে বললো- হ্যাঁ।
এবার নুহাশ মঞ্চের একেবারে সামনে চলে এল । তারপর কৌশলি হাতে বক্সটার মুখে একটা লাল টকটকে কাপড় রাখলো একপাশ খালি রেখে । উৎসুখ জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। যেন সে ত্রাতা ।
এবার শুরু হলো গোলাপ বিতরণ। প্রথমে একটা । তারপর আরো একটা।
উৎসুক জনতা করতালিতে মাতিয়ে তুললো। তারপর আরো একটা এভাবে আরো একটা । এমন করতে
করতে মঞ্চের সামনে শুধু গোলাপ আর গোলাপ।
এবার সবার হাতে হাতে গোলাপের ছড়াছড়ি। সবার হাতে। একেবারে সবার হাতেই গোলাপের ছড়াছড়ি । সবার মধ্যে একটা অন্য রকম উত্তেজনা। কার আগে কে গোলাপ নেবে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। সবার একই ইচ্ছা। একটা গোলাপ চাই।
বেশ রাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নের কথা ভেবে নিজেই কেমন একটা লজ্জা পেল। নিজে নিজেই ভাবলো এটা কি করে সম্ভব? তারপর মনে মনে বললো-জুয়েল কাকা,
তোমার সাথে আমার দেখা হবে?
এই ছোট গল্পটি লেখকের বাজী বইয়ের একটি গল্প। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সনে ২১ শে বই মেলায়।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।