বাজি – সাগর চৌধুরী

Picsart_22-07-13_19-29-26-880.jpg

বাজি – সাগর চৌধুরী

আমি স্পাইডের গোলামটা দিয়ে বললাম-ট্রাম ।
এতক্ষন মামুনের গলা একটু উপরে থাকলেও হঠাৎ যেন বরফ শীতল হয়ে গেল।

রনজু আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটু বিস্ময় প্রকাশ করলো। এরপর আশফাক ইশকাপনের টেক্কাটা ফেলে বললো-‘এই তাকাতাকি পরে কর । আগে কার্ড দে ।
আমাদের মধ্যে কার্ড খেলায় ওস্তাদ হলো মামুন আর আশফাক। আমার তেমন একটা ভালো লাগে না। কিন্তু আমাদের বন্ধুদের সিমানা ছাড়িয়ে সিনিয়রদের কানেও পৌঁছে গেছে; মামুন খুব ভালো খেলে।

গত বার সিনিয়রদের সাথে খেলে বাজি জিতেছে। এবার
আবার হায়ারে খেলতে গিয়ে আমাদের নাম উজ্জ্বল করেছে। তিন লিডের এক লিডও সে হারে নি। ফলে আমাদের মধ্যে ও এখন কার্ডের হিরো।

আশফাকের ঘটনাও এমন। একবার দুবার নয় তিন তিন বার রনি ভাইকে হারিয়েছে সে।

রনি ভাই হলো বড় ভাইদেরও বড়। একদিন সবাই আমরা বসে আছি, এমন সময় রনি ভাই আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল । বড় ভাইকে দেখে আশফাক সালাম দিল। রনি ভাই আমাদের দেখে এমন একটা ভাব করলো। যেন কোন পাত্তা নাই। আশফাকও কম যায় না । কাছে গিয়ে বললো-‘ভাই আপনারে সালাম দিছি ।’

এবার রনি ভাই বললো-— খেয়াল করি নাই বুঝছো । রাগ কইরো না। তারপর তোমরা কেমন আছো ?
ভালো।

‘মামুন এবার বললো-‘ভাই আপনার সাথে একটা কথা ছিল । রাগ না করলে বলবো ।’
‘বলো’

আশফাক বলছিল-‘আপনার সাথে একদিন খেলতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করবো। কিন্তু ভাই আমরা তো পোলাপাইন; আমাদের সাথে কি আপনি খেলবেন ?
‘আরে না খোলার কি হইলো । তোমাদের সাথে খেলতে পারলে আমার ও ভালো লাগবো ।
আইসো একদিন ।
‘আপনার কাজ আছে আজ ??
কেন বলতো ?
‘না ভাই । কাজ থাকলে দরকার নেই। তবে বলছিলাম আপনি যদি বলেন তাহলে আজই খেলতে পারতাম।

রনি ভাই । একটু সময় নিলেন। মুখটাকে সোজা করে একটা শ্বাস নিলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন-‘ দেখ আমার সাথে খেলার এখনো বয়স হয়নি তোমাদের, আরো শিখে তার পর আসো ।
19
এবার মামুন আমতা আমতা করে বললো-“ ভাই আপনার কথায় বোঝা যায় আমরা একদম পিচ্চি । তয় আমরা কিন্তু আপনারে হারাইতে পাড়ি । আমাদের সেই ক্ষমতা আছে।
রনি ভাই আগের কথায় একটু হুমকি দিলেও। পরের কথায় সামলে নিয়ে বললেন-“ঠিক আছে । আজ বিকেলেই খেলা । তোমরা এস।

সন্ধ্যার আগে আগেই এলাকার মধ্যে একটা সোরগোল পড়ে গেল। মাসুদ এসে বললো – তোরা এটা কি দেখালিরে?

বললাম ‘কোনটা ??
‘রনি ভাই আর তার পাটনার সুজন ভাইকে হারিয়ে দিলি ।’
বিজন কাকার সাথে দেখা রাস্তার মোড়ে।

বললো- কি ব্যাপার তোমরা নাকি রনিদের তিন
গোলে হারিয়েছো ?’

আমি একেবারে চুপ। কারণ খেলাটা আমি এখনো ভালো করে বুঝি না। কি বলতে কি বলে ফেলবো ঠিক নেই। মামুন বললো-‘ হেরেছে এটা ঠিক। কিন্তু তারা আমদের পিচ্চি বলে খেলায় তেমন মনোযোগি ছিল না। এটাই তাদের হারের কারণ।

পরে রনি ভাইদের সাথে আমাদের দেখা হলে বেশ সমীহ করে কথা বলতেন । তার যে দাম্ভিকতা ছিল সেটা পরে আর দেখা যায় নি । কিন্তু এলাকায় মামুন আর আশফাকের নাম এমনভাবে ছড়ালো তারা রীতিমত ট্রাম কার্ড।

ছোট কাকা আমার বন্ধুদের এমন ইতিহাস গড়ার কথা শুনে একদিন বললো-“তোরা ভালোই করেছিস। রনিটা খুব ভাব নিত। বেশি ভাব ভালো না । দেখেছো; হেরেছে তো একেবারে হাঁটুর বয়সিদের সাথে হেরেছে!’

এরপর ওদের সাথে খেলতে এলে অনেক সিনিয়রাও হিমশিম খেত । মনু কাকাদের একটা গ্রুপ ছিল। তারা বেশ একদিন ওদের হায়ার করলো এলাকার সবাই সেই খেলা দেখতে জড়ো হলো। কিন্তু খেলার সময় যত বাড়তে লাগলো মনু কাকার চেহারা ততই খারাপের দিকে যেতে লাগলো।

একটা পর্যায়ে এসে তারা হেরেই বসলো।

হায়রে ! তখন তারা সে লজ্জা থেকে রেহাই পেতে আমাদের সবাইকে খাওয়ালো আর বলে বেড়ালো-‘ওরা খুব ভালো খেলে তো তাই ওদের খেলাটাকে আরো উৎসাহ দেবার জন্য আমরাও ওদের সাথে খেলেছি ।’

মনু কাকা যখন সবার কাছে এসব কথা বলে বেড়াত, আমরা তখন সবাই মিটিমিটি হাসতাম । আর ভাবতাম কাকারা হেরেছে বলে এমন কথা বলছে । যদি তারা জিতে যেত তাহলে ….

মিন্টু কাকা একদিন এসে ধরলো- শোন ! আমার এক ভাই আসছে খুব ভালো খেলে; তোরা না হলে আমার আর মান বাঁচে না। তোরা সন্ধ্যায় আয়।’

সন্ধ্যায় আমরা তিন চার বন্ধু গিয়ে হাজির। মামুন আর আশফাক খেলবে। আমি আর রনজু ওদের সাথে গিয়েছি সঙ্গ দেবার জন্য।

ভদ্রলোক আমাদের দেখে ভুরু কুচকালেন। তার অত্মসম্মানে লেগেছে । আমাদের মতো জুনিয়দের সাথে খেলবে ?

মিন্টু কাকা আমাদের কথাটা বেশ ভালো করেই জানেন । তার মেহমানকে ইশারা করে বললেন-‘এরাই খুব ভালো খেলে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। তিনি আমাদের সাথে খেলতে রাজি হলেন না। এক পর্যায়ে তিনি আমাদের না বলে দিলেন। কিন্তু আমাদের জেদ চাপলো। খেলে না জিততে পারলে?

মিন্টু কাকা এবার ত্রাতার ভূমিকা পালন করলেন । বললেন-‘ওরা যদি না জিততে পারে । তবে এই খেলা যত মিনিট চলবে তার তিন গুন টাকা আমি দেব।’
কথা পাক্কা। এবার ভদ্রলোক একটা হাসি দিয়ে বললো-‘মিন্টু ভাই এতটা রিস্ক কেন নিলেন?

মিন্টু কাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো-‘ ওরা পারবে তো তাই। প্রথম একলিড হেরে গেলে । মামুন একটু গাবড়ে গেল । কিন্তু আশফাকের চমৎকার বুদ্ধিদিপ্ত খেলায় পরের দুই লিড তারা হেরে গেল। এবার তিন লিডের ফলাফলে আশফাক আর মামুন জিতে গেল ।

মিন্টু কাকা এসে বললো-“কি বলছিলাম না ।’ ভদ্রলোক মুখে কথাই বললেন না । লজ্জায় কেমন কাচুমাচু করতে লাগলেন।

কার্ডগুলো সোজা ভাজ দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে মামুন বললো-‘নে তোর কার্ড।
বললাম- আগে কথা ঠিক করে নাও । তারপর ।
‘টাকা নাই আমার কাছে!
‘নাই তো কি হয়েছে । অন্য কি কিছু নাই ?’
‘অন্য কি আছে ? বল তো ।’
রনজু বললো- টাকা নাই তো কি হয়েছে । তোর গার্ল ফ্রেন্ড বাজি ।

আমি এবার থমকে গিয়ে বললাম-‘এটা কোমন কথা ? কার্ড খেলতে এসে গার্লফ্রেন্ড বাজি।

ওদের কথার চাপে আমার কথা ধেপে টিকলো না। আমি বার বার নিষেধ করতে লাগলাম । এটা হয় না।
‘কি হয় না ?’

এখন এই খেলায় যদি মামুন হেরে যায়। তবে সকাল বেলা ওর গার্লফ্রেন্ড রনজুর হাতে তুলে দিবে । কি মামুন রাজি ?’ আশফাকের প্রশ্ন ।
‘রাজি।’

মামুন খুবই সিরিয়াস । আমি আর রনজু একজুটি । মামুন আর আশফাক অন্যজুটি।

সেই দুপুর থেকে খেলা চলছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। রাত গড়িয়ে ভোর ভোর হচ্ছে। কিন্তু কারোই ওঠার নাম নেই। মামুন আর আশফাকের সাথে প্রথমে বিকেলের নাস্তা বাজি ছিল।

আমরা হেরেছি । নাস্তা খেতে গিয়ে মামুন বললো-‘তিন শো করে বাজি।

রনজু রাজি হয়ে গেল । ফিরে এসে আবার খেলা । এবার এই লিডের টাকা আমরা পেয়ে গেলাম। মামুন হেরে গেল। এভাবে চললো একের পর এক। এরই মাঝে আমরা বেশ
কয়েক বার হারলাম । মামুন আর আশফাকও হারলো ।

শেষ বার এসে মামুন বললো- আমরা আর পারছি না। আমাদের হাতে আর টাকা নেই । তারপর রনজু যা বলার বললো, আশফাক রনজুর কথায় শায় দিয়ে বললো, হেরে গেলে ওর গার্লফ্রেন্ড সকালে রনজুর হাতে তুলে দিবে ।’

আমি কার্ডগুলো গুছাতে গুছাতে মামুনকে বললাম-‘দেখ এটা কিন্তু খুব বেশি বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। খেলার কথা বলা যায় না। সকালে কিন্তু এটা নিয়ে হৈচৈ বেধে যাবে । মুখ লুকানোর জায়গা পাবি না।’

আমার কথাটাকে সে কোন কেয়ারই করলো না। এমন একটা ভাব নিল। রনজুর মত ছেলে ওকে কোন ভাবেই হারাতে পারবে না। আমি ওর মধ্যে রনি ভাইয়ের প্রতিছবি
দেখতে পেলাম। তার যেমন একটা ভাব ছিল ‘ড্যাম কেয়ার’ সেই ভাবটা ওর মধ্যে।

কার্ড ফেলার আগে মামুনকে আরো একবার বললাম- দোস্ত এই বাজিটা না খেললে হয় না ?’

এবার মামুন আমার উপর ক্ষেপে গেল । এই ব্যাটা আমি তোর চেয়ে কম বুজি… এ্যাঁ।

গার্লফ্রেন্ড আমার, তোর তো না, তোর ? তাহলে এত ঘ্যানর ঘ্যানর করস ক্যাঁ।

মামুনের এমন কথায় আমি শান্ত দিঘির জলের মতো চুপ করে খেলতে লাগলাম।
প্রথম লিড হারতে হারতেও জিতে গেল মামুন। এবার রনজু আমাকে কষে চড় দিয়ে বললো, এখানে খেলতে বসছি। কে কার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে গেল ভাবতে বসি নাই। ভালো করে না খেললে তোর খবর আছে ? পরক্ষণেই আমরা হেরে গেছি বলে মামুন বেশ উঁচু গলায় কি সব বললো।

পরের লিডে আমি স্পাইডের গোলাম দিয়ে ট্রাম করলে। আশফাক ইশকাপনের টেক্কা খেলে। মামুন তাতে ইশকাপনের গেলাম দেয়। লাষ্ট হাত রনজুর। সে এবার স্পাইডের দশ দিয়ে ট্রাম করে। ফলাফল আমরা দুই কোর্টে বারো তুলে ফেলছি। আঠারোর ডাক
মরে গেছে। টুয়েনটি নাইনের খেলায় এত তারাতাড়ি কোর্ট ওঠে না। কিন্তু আমাদের উঠলো।

এবার আমরা এক একে সমতা নিয়ে এলাম। রনজুর চোখে মুখে কেমন এক অচেনা নেশা। তাছাড়া আমি মামুন আর আশফাকের সামনে ভালো খেলতে পারিনা । খেলবো কি করে, আমি তো ওদের কাছেই খেলা শিখেছি। ওরাই আমার টু এনটি নাইন খেলার গুরু।

শেষ লিডে আমরা তেমন একটা ভালো করতে পারিনি। কারনটা ছিল আমাদের হাতে ভালো কার্ড ছিল কিন্তু রং কম পরাতে আমাদের কার্ড গুলো আমরা বাঁচাতে পারিনি।
একুশের ডাক । কত আর লাগে ? ফোটা গুনতে গিয়ে রনজু লাফিয়ে উঠলো । চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। হায় এটা কি হলো !

মামুন ‘থ’ । এক ফোটার জন্য খেলা মরে গেছে।

রনজু লাফিয়ে উঠলো। আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না।

সোমা এটা শুনলে কি বলবে। আমাদের নৈতিক অধঃপতনের একটা পথ তৈরী হয়ে গেল।

আশফাক শুধু বললো- কাল সকালে দেখা যাবে কি হবে। এখন সবাই যে যার মত যেতে পার।

আমি আমার বাসায় ফিরে বিষয়টা নিয়ে আর ভাবতে গেলাম না। খেলার আগেই আমি নিষেধ করেছি। রনজু যেই বান্দরের বান্দর, ও এটা সবার কাছে বলে বেড়াবে । আর সোমার কাছে এই খবর তো এতক্ষনেই পৌঁছে যাবার কথা।

পরের দিন আশফাকের ফোন পেয়ে বের হলাম। রনজু আর আশফাক এক সাথে আছে।
মামুনের কাছে ফোন করেছে সেও আসছে।

আমি আশফাককে বললাম-‘এটা গতকালই
আমি নিষেধ করেছি। এর মধ্যে আমি আর নেই। মানুষ শুনলে কি বলবে, ছেলেরা খেলতে গিয়ে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বাজি ধরেছে। সে খেলায় আবার একজন গার্লফ্রেন্ড জিতেও নিয়েছে!
ছি!
সোমা পুরো ঘটনাটা শুনে কাউকে কিছু বললো না। মামুনকে বললো-‘যা শুনলাম তা কি সত্যি ??
‘হা’। বললো মামুন।

সোমা আমার পাশেই বসে ছিল। মামুনের মুখ থেকে হ্যাঁ শোনার পর উঠে দাঁড়ালো। তারপর এগিয়ে গেল মামুনের দিকে। সে সামনের দিকে এগুলোর মধ্যে কোন রকম র‍্যাস্ত
তা ছিল না। রাগের কোন রেশ ছিল না। একদম শান্ত । কুল।

মামুনের সামনে গিয়ে পা থেকে জুতা খুললো সোমা। ঠিক মামুনের গালে জুতা দিয়ে মারলো এক গা, আর বললো-‘আমি তোর বাজি ধরার বস্তু? শুয়ার কোথাকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top