ঘাতক – সাগর চৌধুরী

Picsart_22-09-30_20-30-43-539-scaled.jpg

রাজনীতির মাঠ খুব গরম। সামনে এমপি নমিনেশন। মিছিল মিটিং আর অবরোধের মতো শক্ত শক্ত কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। রাজনীতির এই মাঠের অবস্থান ধরে রাখতে হলে লোকবল, অর্থবল, বাহুবল, আর ক্ষমতার বল এই কয়েকটি উপাদান খুবই জরুরি এবং একান্তই দরকারি।

এই তিন বলের সমন্বয় যার আছে সেই পাবে নমিনেশন । এমনকি সে হতে পারবে সামনে সংসদের সদস্য। সংসদ সদস্য মানেই আগামী পাঁচ বছরের জন্য এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এই ক্ষমতার জোরে থানা পুলিশ, সরকারি আদালত, এমনকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার দাপট হবে একচেটিয়া। এই ক্ষমতায় বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খাবে।

ক্ষমতার লোভ কার না আছে? আমি তুমি সে কার নাই ? সবাই ক্ষমতা চায়। সবাই চায় তার কথায় দশজন উঠুক বসুক। সরকারি অফিস আদালতে তার কথায় কাজ চলুক। পাড়ায় পাড়ায় তার নামে রাস্তা হোক। ক্লাব হোক। সংগঠন হোক। সবাই তাকে সমীহ করুক। সম্মান করুক।

এই ক্ষমতার লোভে এবার কাজে উঠে পড়ে লেগেছেন। যেভাবেই হোক তার নমিনেশন পাওয়া চাই। এই নমিনেশন পেতে যদি তার দশটা খুন করতেও হয়; তাতে কিছু যায় আসে না, সে করবে। এলাকার দাপুটে ভাবটা বজায় রাখতে হবে। এলাকার মধ্যে তার একটা প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে হবে।

এই পরিকল্পনাটা তার দলের লোক৷ জনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এমন ভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে কেউ টের না পায়। দলের ভেতরকার অবস্থার সাথে সাথে যারা নমিনেশন প্রার্থী তাদেরকেও ঘায়েল করতে হবে। ঘায়েল করতে হবে তার প্রতিপক্ষকে। কিন্তু এই ঘায়েল পর্ব কাকে নিয়ে সে করবে ? বেশ চিন্তায় পড়ে গেল কাজেম।

এর সাথে আলাপ করে ওর সাথে আলাপ করে। কিন্তু আলাপ করতে গিয়েও থমকে যায়; কেউ যদি ফাঁস করে দেয় এই গোপন কথা। গভীর রাতে বসে মিটিং করে দলের ছেলে পেলের সাথে কিন্তু পছন্দের লোক তো চাই তার ?

কাক পক্ষিও যাতে টের না পায় এমন বিশ্বস্ত লোক চাই তার। কিন্তু এমন লোক কোথায়?

এদিকে মাঠের অবস্থান নিজের দখলে নিতে হলে শক্ত অবস্থান এক্ষুণি জরুরি। দলের নীতি নির্ধারকেরা এরই মধ্যে একটা খসরা নাম প্রস্তাব তৈরিও করে ফেলেছে। এই নাম প্রস্তাবের একেবারে শেষের দিকে কাজেমের নাম আছে। শেষের দিকে মানে হলো দলের অবস্থানগত কারণে তার অবস্থান শেষের অংশে।

তবে সে এটাতে নিশ্চত হয়ে গেছে মনোনয়নের দৌড়ে সে অনেক পিছিয়ে আছে। যা খুব সহজে কাটিয়ে উঠতে পাড়া তার পক্ষে সহজ নয়।

ওদিকে তার প্রতিপক্ষ দল, নাকের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। প্রতিদিন তাদের মিছিলে হাজার হাজার লোকের সমাগম হচ্ছে। এলাকার মধ্যে তাদের অধিপত্য রোজ রোজ বেড়েই চলছে। এক কথায় বলা চলে সামনের নমিনেশন তো সে পাবেই এবং সংসদ সদস্য হতে তার ভোটের অভাব হবে না। এরই মধ্যে জনমত জরিপে সে লক্ষণই বেশ লক্ষ করা গেছে।

এলাকার লোকজনের মুখে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে কাজেম যে এতদিন খুব ভাব নিয়ে মিটিং মিছিল শুরু করেছিল। আসলে সে তো এবার নমিনেশন পাবে না। কথাগুলো যে একেবারে মিধ্যে নয়। তা কাজেম নিজেও বেশ ভালো করেই বুঝেছে।

ভারাক্রান্ত মনে তার নিজের দলের মধ্যে মিটিং ডাকলেন। সবাইকে বললেন এই যাত্রায় সে আর পারছে না। দলের এই পর্যায়ে শক্ত কোন ডিসিশানে যেতে পারছে না। কথা বলার সময় বার কয়েক কাঁদলেনও। মিটিংয়ে তার বক্তব্য শুনে এক যুবক উঠে দাঁড়ালো।

যুবকের ক্ররেখায় প্রচণ্ড এক আত্মবিশ্বাস। বুকে দূরন্ত সংকল্প। কথায় যেন অগ্নিদৰ্প। নিঃশ্বাসে বিজয়ের শ্বাস।

কাজেম যুবকের প্রশ্নের উত্তরে বললো-‘কি করে সম্ভব ?

যুবক বললো-‘সম্ভব।’

কাজেম এবার বললো-‘তুমি জানো না। আমি রাজনীতির মাঠে খেলেছি আমি জানি ।’

না হলে..
যুবকের দৃঢ় প্রশ্ন ‘না হলে’ ..?

‘না হলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের অবস্থা হবে গলায় শেকল পড়া কুকুরের মতো। পায়ে শেকল হবে কয়েদির মতো। নরতে গেলে আমাদের শরীরে লোহায় কাটা বিধবে ।’ বললো কাজেম।

এই জন্যই কি আমাদের ডেকেছেন ? যুবকের শান্ত কথায় শাসানোর সুর। ‘আমরা ওদের সাথে মিশে যাই। ওদের সাথে মিলে নির্বাচন করি। যাতে আগামী দিনগুলোতে আমাদের অবস্থাটা নাজুক না হয় ।’ বললো কাজেম।

‘আমাদের একবার বলুন। দেখুন আমরা আপনার জন্য কি করতে পারি। আশা করি এই দায়িত্ব আমাদের দিলে আপনি হবেন আগামী দিনের সাংসদ। বললো যুবক।

একটু আমতা আমতা করে বিষণ্ন সুরে কাজেম বললো-‘দেখ আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে লাভ হবে না। কীভাবে করবে তোমরা ?

আমরা পারবো বলেই তো বলছি। যুবকের সাথে সবাই একসুরে বলে উঠলো।

কি বলার জন্য আজকের মিটিং ডেকেছিল কাজেম। মিটিং শেষ হলো কি দিয়ে ? তবে নিয়াজের চোখে মুখে তার কথাবার্তায় অনেক মুগ্ধ হয়েছে কাজেম। ছেলেটা ভারী দৃঢ়।

এই ছেলেটা এতদিন তো চোখে পড়েনি। তবে ছেলেটার কাজের ফলে বোঝা যাবে আসলে কি সত্যিই সে পারবে। নাকি গুল মেরে গেল?

এক রাতের মধ্যেই দৃশ্যপট বদলে গেল। শহরের মেইন রোড ব্লাক করা হলো। থানার সামনে বোমবিং করা হলো। রাস্তার আনাচে কানাচে ইট পাটকেলের তোড়ে পতিপক্ষের লোকজন একেবারে ঘায়েল। নিয়াজের ত্রিসীমানার মধ্যেই ওরা কেউ আসতে পারলো না।

কি সাহসে প্রতিপক্ষের মিছিলের উপর হামলা করলো সবার চোখের সামনে। দাঁড়ালো অস্ত্র উঁচিয়ে দৌড়ে গেল তাদের দিকে। নিয়াজের সাথের অন্য ছেলেরাও ঝাঁপিয়ে পড়লো বীরদর্পে সেই মিছিলের উপর। ক্ষণিকের মধ্যেই সেই মিছিল পালিয়ে কোথায় গেল ওদের ভয়ে।

নিয়াজের দুঃসাহসে ও উৎসাহে জীবন মরণ তুচ্ছ করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে চললো ওরা। ওদের এই কাজে বেশ খুশি হলেও নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য দিন রাত এসব কাজের জোগান দিচ্ছে কাজেম।

এরই মধ্যে পুরো এলাকায় কাজেমের দখল কায়েম হলো। সামনে নমিনেশনের আর মাত্র অল্প কয়েক দিন বাকি আছে। এরই মধ্যে কানাগুষা শুরু হলো এবার কাজেম নমিনেশন পাচ্ছেই।

আবারো একটা খসরা তালিকা পাওয়া গেল।
শেষের দিকে।

কিন্তু এবারও কাজেমের নাম শেষের দিকে।

নিয়াজের এসব কাজের পরিধি ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগলো। শুরু হলো এবার জনগণের কাছে নমিনেশন পাবার জন্য তোড়জোড়। এবারো নিয়াজের একচেটিয়া দখল। সবার মনজয় করার একটা লক্ষ। হলোও তাই। নিয়াজের বুদ্ধিদীপ্ত গণসংযোগের কারণে এলাকার লোকজন একটা পজেটিভ দিকে অগ্রসর হলো।

প্রতিপক্ষের দুর্গে কীভাবে আঘাত হেনে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিয়ে গোল ভোটের যে ব্যাংক। এবার সেই ব্যাংক ডাকাতির মধ্যেই যেন নিজেকে নিয়োজিত রাখলো পোষ্টে গোল দিতে হয়, এটা জানু খেলোয়াড়ের মতো সে খেলা খেললো।

ফলাফল প্রতিপক্ষের ব্যূহ ভেদ করে ভোট ছিনিয়ে নিয়ে এলো। জনসাধারনের মনোরঞ্জনই এক সময় প্রতিপক্ষের চক্ষুশূল হয়ে দাড়ালো। তারা বিভিন্ন ভাবে তাকে প্রতিহত করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। তার চলার পথে তাকে বিভিন্নভাবে পরাস্ত করার জন্য হিস্র হয়ে উঠলো।

গোপনে তাকে হত্যার জন্য ওত পেতে রইলো। তারা
নিয়াজের মাথার দাম হাকালো নগদ দশ লক্ষ টাকা।অলিতে গলিতে সবার মুখে মুখে রটে গেল কেউ নিয়াজের মাথা এনে দিতে পারলে নগদ দশ লক্ষ টাকা দিবে। কিন্তু লাভ হলো কি অযথাই তার একটা দাম উঠলো কেউ তার ধারে কাছে ও পৌছাতে পারলো না।

এরই মধ্যে পিকেটিংএ বিরোধী দলের দু’জন লোক মারা
গেল। সারা শহর পুলিশের লোকজন তাকে খুঁজে বেড়ায়। সাদা পোশাকের পুলিশরা চরের কাজ শুরু করেছে তাকে ধরার জন্য। কিন্তু লোকজনের মধ্যে একটা বাড়তি উত্তেজনা বিরাজ করছে নিয়াজকে নিয়ে।

লোকজনের আড়ালে আবডালে লুকিয়ে চুকিয়ে দিন কাটছে নিয়াজের যাতে প্রতিপক্ষের লোকজনের হাতে তার ধরা না খেতে হয়। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ নিয়াজের উপস্থিতি বিরোধী পক্ষের ব্যুহ ভেদ করে নানা রকম কার্যকলাপ সেরে আবার ফসকে যায় ধরা
ছোঁয়ার বাহিরে।

যেন এখানে নিয়াজ নামে কেউ কোনদিন আসে নি ।

পুলিশের বাঘা বাঘা কর্তাদের নাকের ডগায় ঘুড়ে বেড়ায় নিয়াজ। কিন্তু তাকে ধরার জন্য পুরো এলাকা রেট হয়, কিন্তু সবকিছু তন্ন তন্ন খোঁজা হয়, তাকে আর ধরতে পারে না কেউ। মাকড়সার জালের মতো ফাঁদ পাতে বিরোধীরা তাকে ধরার জন্য কিন্তু বাতাসের মতো ফুরুৎ করে সে জালের ফাঁক গলে বেড়িয়ে যায় সে।

প্রতিপক্ষের দলের ভেতরে বাহিরে তাকে নিয়ে বেশ হুলুস্থল বেঁধে যায়। সে যেন মূর্তিমান আতঙ্ক।

গোপনে গোপনে তারা এক গভীর সরযন্ত্রে লিপ্ত হয়। তার পায়ের ছাঁপ নিয়ে তারা রাস্তায় রাস্তায় লেজার বসায়। কিন্তু কোথায় কি ? লেজার ও হার মানে!

কাজেম গোপনে নিয়াজকে ডেকে আনে তার একান্ত বসার ঘড়ে। বিশেষ প্রয়োজনে পরামর্শেও জন্য এই ডাক। এর আগেও বহুবার তার ডাকে তাকে যেতে হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজেম তার সাথে পরামর্শ করে। সবাই জানে এই বৈঠক গোপন
বৈঠক।

এবার নিয়াজকে দেখা মাত্রই কাজেম বললো-কি এসেছো নিয়াজ ?

নিয়াজ প্রতিবারের মতই সালাম জানিয়ে জানতে চাইলো-‘লিডার কেমন আছেন ?

ভালো আছি বলার পর। নিয়াজের খেয়াল হলো না, এই ভালো আছি বলার পেছনে তার আসল চোহারাটা কতো বীভৎস। কত কুটিল। কত হিংস্ৰ।

তোমাকে ডেকেছি কয়েকটা কথা বলার জন্য। তুমি যে পন্থায় আমার উপকারে নেমেছো
আমাকে সংসদ সদস্য করার প্রকাশ করেছো তা নিছক ছেলে মানুষি। ঠিকই আছে তুমি তো একটা ডাকু। যার তার বুকে গুলি চালাও যার প্রমান তোমাকে আর দিতে হবে না। যা তুমি নিজেই জানো কিন্তু আমার ভয় হয় কবে তুমি আমার বুকে গুলি চালিয়ে বসো।

এটা আপনি কি বলেন লিডার?

হ্যাঁ। এটাই সত্যি। তোমার এই সন্ত্রাসী কার্যকলাপে আমাকে সংসদ সদস্য করতে পারবে না।

পারবে? অবশ্যই না।

এটা কেমন কথা।

শোন… প্রতিপক্ষের আমার কথা হয়েছে। তারাই আমাকে সংসদ সদস্য করে দেবে বিনা বাঁধায়। তোমাকে আর দরকার হবে না। কিন্তু আমি যদি…..

এরই মধ্যে আজম পকেট থেকে অস্ত্র বের করে নিজের হাতে নিজেই গুলি করে।

এটা কি করলেন লিডার?

দলের সবাই তো বিষয়টা বিশ্বাস করতে হবে; যে, তুমি আমাকে গুলি আগে করেছ। তারপর আমি তোমাকে। এরপর নিয়াজ কিছু বুঝি ওঠার আগেই গুলি শুরু হলো তার বুকের উপর।

এই ঘটনাটা অনেকের কাছেই কেমন যেন ঠেকলো। কেউ কেউ বিশ্বাসও করলো আবার কেউ কেউ অবিশ্বাস করলেও আজমের কাছে দ্বিতীয় বার বলার সাহস কেউ করে নি। কারণ, ততদিনে সে সংসদ সদস্য।

এই বছরই আজম সংসদ সদস্য হলো। এলাকায় তার প্রভাব প্রতিপত্তি হলো। সমাজের সকল স্তরে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা হল। এভাবেই বছর গেল। তারপরের বছরও গেল। গেল আরো মাস দুই। একদিন সকালে রাস্তার পাশে তার চলাচলের গাড়িসহ তার ডেটবডি পাওয়া গেল। গাড়ির উপরে একটা চিরকুটে লেখা – ‘ঘাতকের জন্য নিশ্চয় কারো চোখে জল জমে নেই’।

আরও লেখা পড়ুন।

লুকোচুরি – সাগর চৌধুরী

আরও লেখা পড়ুন।

হস্তরেখা – সাগর চৌধুরী

আরও লেখা পড়ুন।

কাক ও কোকিল – সাগর চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top