নিউজ – সাগর চৌধুরী

20240410_174332.jpg

নিউজ – সাগর চৌধুরী

রাত দুটায় আমাদের শেষ নিউজ। নিউজ শেষ করে, অফিসের বাকি কাজগুলো শেষ করতে করতেই আরো ঘণ্টা খানেক লেগে গেল। এখনো ডিজিটাল যন্ত্রপাতি হয়ে ওঠে নি।
হাতেই কাজ করতে হচ্ছে খুব। তবে আশ্বাস দিয়েছেন চোয়ারম্যান স্যার, আগামী মাসের মধ্যেই নতুন ডিজিটাল মেশিন নিয়ে আসবেন।

কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য যোগাযোগ করলে, আমাদের অফিসের অভ্যর্থনা বিভাগ থেকে আমাকে জানালো ‘আমার জন্য গাড়ি প্রস্তুত আছে, আমি গাড়ি চাইলে পেতে
পারি ।’

আরো একটা ফোনের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার মিনিট পাঁচেক লেট হয়েছে। বাসায় ফিরছি; ভুলো মন। গাড়ির কথা ভুলে গিয়েছি। লিফটে উঠে নিচে নেমে গেছি।

সারাটা দিন ভীষণ গরম আর রাত হলেই শুরু হয় ঠাণ্ডা বাতাস। নিচে নামতেই কেমন একটা শীতশীত অনুভব করলাম। পূর্ব পরিচিত দু-একজন মানুষের সাথেও দেখা হয়ে গেল।

একজন লিফটের সামনে পেয়েই জড়িয়ে ধরলেন। নতুন অফিসে জয়েন করেছি শুনে চা খাওয়াতে চাইলেন। এমনভাবে ধরলেন আমিও রাজি হয়ে যাই। রাজি না হয়ে উপায়
আছে। এখানে চাকরি করি বলেই তো সেই লোকটা আমাকে চা খেতে বলল।

অজানা অচেনা হলে তো আর বলত না।

আমার নতুন অফিস দশতলা একটা বিল্ডিং-এ । পুরো বিল্ডিংটার মধ্যে মাত্র দুটো ফোরে। চার এবং পাঁচ। লিফটের তিন এবং চার। গাড়ি রাখার জন্য প্রথম ফ্লোর। অফিসের চার
পাশের লোহার বেষ্টনির বাহিরে ছোট ছোট চায়ের দোকান।

চা, বিস্কুট, পানি আর রুটি,মাঝে মাঝে নেপালি কলা অথবা সবড়ি জাতীয় কলা পাওয়া যায়। তবে এসব চায়ের
দোকানে তামাক জাতীয় পণ্য সিকেরেট, পানের জরদাসহ পান, গুল, বিড়িও পাওয়া যায়।

এসব চায়ের দোকানগুলোর সামনে অফিসের সিইও থেকে শুরু করে ঝাড়ুদারেরাও চা পান খেতে আসে।

এমন একটা চায়ের টং দোকানে বসে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার সহকর্মীর ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করেই বললো-‘আসছি আমি দু মিনিট দাঁড়াও। চায়ের বিলটা
দিতে গিয়ে বললো-“তুমি আর কিছু নিবে ?’
বললাম-‘কেন ?’

‘গাড়ির ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে, বেচারা আমার সাথে সেই সকালে এসেছে। আমাকে উঠতে হবে ভাই। আবার সকালে তো আসতে হবে।

“ঠিক আছে। আমিও উঠবো।
সে চলে গেলে। আমি চায়ে চুমুক দিই আস্তে । বাতাসটা কেমন যেন ভালো লেগে গেল।

রাত অনেক হয়েছে। গাড়ির চলাচল রাস্তায় কম। রাস্তার দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবলাম সকালে অফিসে আসার সময় কি জ্যামটাই না লেগে থাকে। এমন রাস্তা ফাঁকা হলে এক
ঘণ্টা সময় বেঁচে যেত রোজ। মাঝে মাঝে এই রাস্তার জ্যাম তিন চার ঘণ্টাও থাকে। তখন কি যে অবস্থা হয়। গাড়ি থেকে নেমে এতটা পথ হেঁটে অফিসে আসতে হয়।

এরই মধ্যে ভদ্র গোছের প্যান্ট শার্ট পড়া তিন জন এলেন।এমন ভাবে আমার সামনে বসলেন আমার নাকের ঠিক সামনে। আমি উঠে তাকে জায়গা ছেড়ে দিলাম।

চায়ের দোকানের ছেলেটা তাদের দেখে সালাম দিয়ে বললো-‘ওস্তাদ আপনারা কেমন আছেন ?’

তাদের তিন জনের একজন বললো-‘ ভালো আছি । এই শোন; ভালো করে তিনটে চা দে।

দুধ চিনি বাড়ায়া দিস।

বলার ভঙ্গিটা কেমন একটু লাগলো আমার চোখে। এরপর তারা নিজেদের মধ্যে একটা আলাপ জুড়ে দিল। যার নামে আলাপ শুরু করেছে, সে আমার অফিসের ডাক সাইটে
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। একজনের সামনের দিকে পেটের অংশটা বাড়তি। বলা চলে পেট বড়। একটু ভুড়ি আছে যার সেই লোকটা তো বলেই বসলো-‘হারুন সাহেব ভালো
মানুষ। তার কথাবার্তায় চালচলনে বস বস ভাব আছে। কাজ শুরু করলে শেষ করে তবেই ছাড়ে।

আমি তার সাথে অনেক কাজ করছি। সে অনেক সময় আটকে গেলে আমার সাথে আলাপ করতো। পরামর্শ নিত।
পাশেই বসা আরেক জন বললো-‘কালামের অবস্থা মনে হয় তেমন ভালো না রে ?’

আবুল কালাম আমার ডিপার্টমেন্টের চিফ। কি বলছে তার সম্পর্কে এরা ?

কালাম তো ব্যাটা একটা জুয়াচোর। তার মুখের উপরে বলেছি সেদিন-‘না, আপনার সাথে আমি ডিউটি করবো না।’

অফিস থেকে এ্যাডমিন ফোন করেছে, বলেছি-‘ তাকে আমার সাথে যেন না দেয়।’
তাদের তিন জনের কথা শুনে ভেবেছি এরা অফিসের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা। কিন্তু কথা বলার উচ্চারণে আর তাদের পোশাকে কোথাও সেই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে মনে
হলো না। কিন্তু আমার এতটা না ভাবলেও চলে, যেহেতু এদের সাথে আমার পরিচয় নেই। তাছাড়া অফিসের সিনিয়র থাকলে সেটা অফিসে আছে চায়ের দোকানের সামনে
তো নেই। পরক্ষণেই চায়ের কাপটা সামনে এগিয়ে দিতে গিয়ে; তাদের এক জনের পায়ের সাথে একটু লাগলো। কেমন তেড়ে উঠলো। থমকে উঠলাম। এমনিতেই তাদের দিকে
আমার মনোযোগটা ছিল। এত জন তো তুই তোকারী করে বলেই বসলো -‘এই চোখে দেখ না, ফাজিল কোথাকার ।’
আমি নিজ থেকেই বললাম-‘স্যরি ভাই ।’

দ্বিতীয় জন বললো-‘কিছু হতে না হতেই স্যরি’
এই এত রাতে কি করছেন ? আপনার পরিচয় ?
এখানে নতুন জয়েন করেছি। আমার নাম … । অফিস শেষ করেছি; বাসায় ফিরবো এক্ষুণি।

আমার কথা বলার লেভেলটা সাদামাটা থাকায় লোকগুলো আমাকে ধমকের সুরে বললো-‘অফিস শেষ করেছেন বাসায় চলে যান। এখনো এখানে কি করেন ? রাতের বেলা ভয় ডর
নেই?

লোকগুলোর কথার ধমকের তোড়ে আরো মিনিট পাঁচেক দাঁড়াতাম সেটা আর হয়ে উঠলো না। কী কারণে যেন তার পাশেই একটু দাঁড়ালাম। একটু সন্দেহও হলো এরা আমার
অফিসের সিনিয়র কর্মকর্তাদের নাম ধরে ধরে কি সব বলছে। কার অফিসের অবস্থান কি তা নিয়ে আলোচনা করছে। তাহলে এরা কারা? আমার বোধগম্য হলো না।

লোকগুলোর এমন কথায় সেখানে আর থাকতে মন চাইলো না। ফিরে এলাম অফিসের নিচে। ফোন করে বললাম-‘ড্রাইভারকে আসতে বলেন, আমি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’

মিনিট পরে ফের ফোন এল- স্যার আপনি একটু অপেক্ষা করুন, চা খেয়ে ড্রাইভার আসছে। ফোনের অপর প্রান্তে কেমল স্বর।

প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সিকিউরিটি ইন চার্জ আমাকে সেলুট দিয়ে বললো-‘স্যার, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। ফোন করেছি ড্রাইভার চলে আসছে।
তারপরও আমি সামনে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসছি।

অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। জনমানবহীন। দুটো বেওয়ারিশ কুকুর শুয়ে আছে পাশাপাশি। সেই সাথে সাড়ি সাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অফিসের লোগো লাগানো গাড়িগুলো
এরই যে কোন একটা আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবে। সিকিউরিটির উঁচু গলা শুনতে পেলাম-
‘এই আলমগীর। স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রুত আসো ।

হন্তদন্ত হয়ে আলমগীর ছুটে এল। চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া সেই তিন জনের একজন। সিকিউরিটি আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললো- তুমি চা খাওয়ার আর
সময় পাও না ? সেই কখন থেকে স্যার দাঁড়িয়ে আছে ।

এবার আমার দিকে তাকিয়ে আলমগীর সালাম দিয়ে বললো-স্যার এখানেই ছিলাম এতক্ষণ। একটু চা খাওয়ার জন্য পাশের দোকানে গিয়েছি ।

বুঝলাম সে আমাকে আলো আধারিতে চিনতে পারেনি। যদি বুঝতো একটু আগে আমাকেই চায়ের দোকানে দেখেছে। তাহলে এমন স্যার বলার কথা না। আমি তাকে
দেখা মাত্রই চিনতে পেরেছি। চায়ের দোকানে কি হয়েছে সেটা আর বলার দরকার নেই।

কারণ সেসময় আমি কেবল মাত্র সামান্য ক্রেতা ছিলাম বা চায়ের খরিদ্দার ছিলাম। এখন আমি ওদের বস।

সিকিউরিটি হেরে গলায় বললো-‘এই রাখ তোমার কথা। এখন গাড়ি বের কর ।

আলমগীর হস্তদন্ত হয়ে গাড়ির কাছে ছুটে গেল । দরজা খুলে গাড়ি স্ট্রাট করে যেই লাইট জ্বালালো, সামনের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা শব্দ করে বললো-‘সামনের গাড়িটা না
সরালে বের হওয়া যাবে না ।’

পাশ ফিরে দেখি বাকি দুজন ফিরে এসেছে। তার মধ্যে ভুরিওয়ালা আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। ভাবলাম সে বুঝি আমাকে চিনতে পেরেছে।

এরই মধ্যে আলমগীর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বললো-‘স্যার সামনের গাড়িটার জন্য বের হতে পারছি না।

আলমগীর আমাকে স্যার বলাতে এবার ভুরিওয়ালা আর তার সাথের লোকটা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।

এবার আলমগীর হেরে গলায় বললো-এই জসিম
তোর গাড়ি সামনে নে। আমি বের হতে পারছি না।

আলমগীরের কথায় বুজলাম এই তিন জনই পেশায় ড্রাইভার। কিন্তু চায়ের দোকানে যেভাবে অফিসের সিনিয়রদের সম্পর্কে কথা বলেছে। যে কেউ শুনলে বুঝবে এরা অফিসের প্রধান হর্তাকর্তা।

এবার বুঝলাম সবার মনোযোগের বিষয় আমি। পকেট থেকে হাত বের করে গাড়ির দরজা খুলতে যাবো, এমন সময় আলমগীর এসে দরজা খুলে দিল। তখনো বাকি দুই ড্রাইভার
আমার দিকে তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে। তারা বেশ ভালো করেই চিনতে পেরেছে আমাকে।

কিন্তু এতক্ষণে আমারও লজ্জা পেল অফিসের ড্রাইভারদের দেখে ভাব নেবার কি আছে ? না হয় ওরা ভুল করেছে।

গাড়িতে উঠে গাড়ির জানালার গ্লাস নামিয়ে বললাম সিকিউরিটির দিকে তাকিয়ে-‘আজকের নাইট কার ?

‘স্যার । এহসান স্যারের নাইট।

তাকে ফোন করে বলবেন-আমি বাসায় গেলাম। ফোন খোলা আছে কিছু হলে ফোন করতে বলো।

সিকিউরিটি চিফ বললো-ঠিক আছে স্যার।

তারপর একটা সেলুট দিল। হাত কপালের কাছে নিয়ে। পুলিশের লোকরা যেমন করে সেলুট করে।

গাড়ি চলতে শুরু করলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি দুজন আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। সিকিউরিটি চিফ ফোন হাতে নিয়েছে এহসানকে ফোন করার জন্য যে,
আমি অফিস লিভ করছি। কোন ইনফরমেশন থাকলে আমাকে জানাতে।

হয়তো ফোন করা শেষ হলে। দুই ড্রাইভার সিকিউরিটির কাছে জানতে চাইবে। আমি কে ? সিকিউরিটি যখন বলবে-‘ওনি নিবাহী কর্মকর্তা। তখন কি লজ্জাটাই না পাবে।

তবে ওদের এই ব্যবহারে আমিও যে লজ্জাটা পেলাম।

আরও লেখা পড়ুন।

গণমাধ্যমের ছুটি হয় না – সাগর চৌধুরী

আরও লেখা পড়ুন।

ঘড়-সংসার – সাগর চৌধুরী

আরও লেখা পড়ুন।

হস্তরেখা – সাগর চৌধুরী

আরও লেখা পড়ুন।

ঘাতক – সাগর চৌধুরী

আরও লেখা পড়ুন।

লুকোচুরি – সাগর চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top