পুরনো প্রেম – সাগর চৌধুরী

PicsArt_09-17-02.17.29.jpg

পুরনো প্রেম – সাগর চৌধুরী

মানুষ আহত হলে তার সেই স্থানটাতে হাত বুলায়, আদর করে, সারানোর জন্য ওষুধ খায়। কিন্তু কিছু ব্যথা থাকে যা পুরনো ক্ষতের মতো একটু স্মরণ করে সেই ব্যথাটা একটু মধুময় করে।

সাধারণত মানুষ তার পুরনো ব্যথাটাকে ভালোবাসে হারানো কোন আপন জনের মতো। স্মৃতিটাকে রোমন্থন করে যখন সে একা থাকে। শেষ বিকেলের এই সময়ে মানুষ অফিস থেকে বের হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করে বাসায় ফেরার জন্য। শুভ এই কাজটি প্রতিদিনই করে। অবশ্য প্রতিদিনই তার একই সমস্যা হয়

অফিস শেষ করে কোথায় যাবে সে ?

বাসা আছে শুভর। প্রতিদিন সে বাসা থেকেই অফিসে আসে। রাতের বেলাতেও সে বাসায় ফিরে যায়। কিন্তু অফিস শেষ করে এই বিকেল বেলায় তার কোথাও যাবার যেন জায়গা থাকে না ।

কোথায় যাবে বন্ধুদের কাছে? বন্ধুরা অনেকেই এখনো অফিস থেকে বের হয় নি। সবাই তো আর ওর মত সকাল সালে আটটার মধ্যে অফিসে ঢুকে না যে পাঁচটা সালে পাঁচটার মধ্যে অফিস শেষ। আবিদ কাজ করে একটা টেলিভিশনে ও অফিসে যায় বিকেল ছয়টায়; ফেরে অনেক রাতে। রুমেল ব্যাংকে চাকরি করে রাত আটটার আগে ওকে কখনো বের হতে দ্যাখে নি শুভ । মুন্নার বাচ্চাটাতো সপ্তাহে একদিনও পাওয়া যায় না খুঁজে। যখনি ফোন দেই রিসিভ করে বলবে মামা এই তো একটু পরে আমি তোকে ফোন ব্যাক করছি। ও অবশ্য এরকম ছিল না। কিন্তু ইদানীং ও কেন যে এমন ছোঁচড়া হয়েছে।

হাঁটতে থাকে শুভ ফার্মগেটের ওভারব্রিজ পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। ফার্মগেটের এই খান থেকে ঢাকা শহরের সবখানে যাওয়া যায়। সব ধরনের বাহন এখানে পাওয়া যায়। বাস, মিনি বাস, সিএনজি, টেম্পু, একটু এগিয়ে গিয়ে রিকসা। কিন্তু প্রতিদিন অফিস থেকে বের হয়ে সে যেন অচেনা এক শহরের পা রাখে ।

মিরপুরের বাস ধরে ওঠে পড়ল চিড়িয়াখানার সামনে নেমে হাটতে থাকে সে। জানে না কোথায় যাবে । মিনিট দশেক হাটার পরে একটা বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ায়। আকাশে তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির কারণেই এখানে দাঁড়ানো। বৃষ্টি থামলেই সে চলে যাবে । কিন্তু ঝমঝম করে বৃষ্টির পড়াতেই সে নিজেকে বাঁচাতে বাড়িটার গেটে ঢুকে। বাড়িটা বেশ সুন্দর টাইলস করা। সামনে লম্বা একটা লোহার গেট। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই দারোয়ান গোছের একজন হেঁকে বসল-‘এই, এই কোথায় যাচ্ছেন’? পরীক্ষার হলের সেই স্যারের মত লোকটা পরখ করে নিল। কি ? কার কাছে যাবেন। ও বৃষ্টির জন্য। ঠিক আছে তা এইখানে দাঁড়ান।

বৃষ্টির একটা মজা আছে শুধু ঝড়তে থাকে। সন্ধ্যার এই আলো আঁধারিতে বৃষ্টির শব্দে চারদিকে কেমন যেন একটা অবহ বয়ে যাচ্ছে। দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। চারপাশের ফ্লাটের বাতিগুলো জ্বলছে। রাস্তার উপর বৃষ্টি পড়ছে অঝোড়ে। বৃষ্টির তোরে এখানেও দাঁড়ানো দায়। জুতা প্যান্ট ভিজে গেছে। একটা দরজা খোলার শব্দে তার নজর পড়ল বাঁ দিকে । একটা বাচ্চা ছেলে বলল আপনাকে ভেতরে আসতে বলছে।

এতক্ষণে তার জামাপ্যান্ট বৃষ্টির পানিতে পুরো ভিজে গেছে। মাথার চুল বেয়ে পানি ঝড়ছে। ঢুকতে গিয়ে তার একটু দ্বিধা মনে হলো। ভিতরে ঢুকার পর তার মনে হলো বেশ। পরিচ্ছন্ন, ঝঝকঝকে একটা রুম । সুন্দর সোফা সেট। সোফার উপর এক বয়স্ক মহিলা বসে আছে। হাতে একটা পত্রিকা পাশে চায়ের কাপ । মহিলা বলল কোথা থেকে ফিরছিলেন ?

অফিস থেকে।

অফিস কোথায়? ফার্মগেটের উল্টাদিকে।

নাম কি আপনার। জাকারিয়া আহম্মেদ শুভ ।

একটা তোয়ালে দিয়ে বলল, নিন মাথাটা মুছে নিন। পাশের একটা চেয়ারে বসার জন্য ব্যবস্থা করা হলো কাজের বুয়াকে দিয়ে। মিনিট পাঁচেক পড়ে একটা বড় কাপে লিকার চা এল। সাথে গরম গরম পিঠা। ভাবতে ভালোই লাগে একদম জামাই আদর। এমন জামাই আদর বহুদিন পাওয়া যায়নি। অবশ্য এই নিয়ে কখনো তার মাথা ব্যথাও ছিল না। এক কালে ভালো ছাত্র ছিল। দেখতে সুন্দর, স্বাস্থ্য ভালো। এখন ভালো একটা চাকরি করে। বন্ধুদের চেয়ে বেতনও ভালো। কিন্তু বৃষ্টির জন্য তার এই বেহাল দশা হলে মনের মাঝে একটা পুলক কাজ করছে, ঢাকা শহরে এই রকম কেউ কি আছে! পথচারীকে ডেকে এমন আপ্যায়ন করায়?

যেখানে সামান্য দু এক টাকার জন্য মারামারি কাটাকাটি হয়। মানুষ মানুষকে দিন দুপুরে খুন করে। সেখানে এই রকম জামাই আদর সেটাও কি সম্ভব? শরীরের অবস্থা একটু উন্নতির দিকে, এতক্ষণের ঠাণ্ডা ভাবটা কেটে গেছে। চা খাওয়ার পর বৃষ্টির পানিগুলো কেমন শুকিয়েছে মনে হলো। পুরো রুমটা এক রকম ফাঁকা। বুড়ো ছিল, এইতো উঠে ভিতরে চলে গেল । এদিকে বৃষ্টির চাপও কমছে না। হায়! আজ কখন বাসায় যাব।

একটু পরেই গোলাপি রংঙের শাড়ি পরা একটা মেয়ে এসে বলল স্যার কেমন আছেন ? ‘ভালো’। মাথা তুলে জবাব দিল শুভ । ‘তুমি ?

এটা আমার শশুর বাড়ি। এতক্ষণ যে মহিলার সাথে কথা বললেন তিনি আমার শাশুরি । আপনাকে বৃষ্টি পড়ার পর থেকে আমি সামনের রাস্তায় দেখি প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে যখন বুঝলাম আপনি কিন্তু যখন বুঝলাম ততক্ষণে আপনি ভিজে সারা।

সাদিয়া। আমার ইউনিভার্সিটির পড়াকালিন সময়ে টিউশনির স্টুডেন্ট। একদিন পড়া পারেনি তাই মেরেছিলাম। আমাকে মনে রেখেছে তাহলে।

স্বামী কি করে তোমার? বিমানের পাইলট। ঢাকা অফিসের কাজে তিন দিন দেশে থাকে। সপ্তাহের বাকি
দিনগুলো দেশের বাহিরে।
আজ কি ঢাকাতে ?
আজ সে ভারতে। বিকেল পাঁচটার সময় গিয়েছে। ফিরবে আগামী কাল রাতে ।

তোমার মা কেমন আছে?

ভালো, আমার এখানে এসেছিল দিন কয়েক আগে।তোমার সেই আগের মত পাগলামি আছে ?
কথাটা এড়িয়ে গিয়ে সাদিয়া বললো-‘ স্যার আপনি আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে গেছেন। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না’? বিয়ে করেছেন? ‘না, বিয়ে করিনি’।

কারো মুখেই কোন কথা নেই । সাদিয়া যেন কি বলতে গিয়ে থেমে গেল। এখন সময় শুভ বলল-‘আচ্ছা ছেলেদের বিয়ের বয়স কত বলো তো? সাদিয়া চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো—“মা আমাকে অনেক বকাঝকা করেছেন সেদিন’।

ঠিকই তো আছে। তুমি যে আমার কাছে আসতে চাইছিলে আমি তখন তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতাম বলো? আমি তখন মাত্র থার্ডইয়ারে পড়ি। তোমাকে নিয়ে গিয়ে আমি আমার পারিবারিক স্টাটাজ জানো? একমাত্র ছেলে পুরো পরিবারে যে নাকি কলেজ পাস করছে। বাবা-মা থাকে গ্রামে, যারা এখনো সরাসরি কৃষির

কথাটা এড়িয়ে গিয়ে সাদিয়া বললো-‘ স্যার আপনি আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে গেছেন । ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না’ ? বিয়ে করেছেন ? ‘না, বিয়ে করিনি’ ।

কারো মুখেই কোন কথা নেই । সাদিয়া যেন কি বলতে গিয়ে থেমে গেল । এখন সময় শুভ বলল-‘আচ্ছা ছেলেদের বিয়ের বয়স কত বলো তো ? সাদিয়া চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো—“মা আমাকে অনেক বকাঝকা করেছেন সেদিন’।

ঠিকই তো আছে । তুমি যে আমার কাছে আসতে চাইছিলে আমি তখন তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতাম বলো? আমি তখন মাত্র থার্ডইয়ারে পড়ি। তোমাকে নিয়ে গিয়ে কি করব আমি? আমার পারিবারিক স্টাটাজ জানো? একমাত্র ছেলে পুরো পরিবারে যে নাকি কলেজ পাস করছে। বাবা-মা থাকে গ্রামে, যারা এখনো সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত। তুমি পারতে গিয়ে থাকতে সেখানে?

এই শহরে তিনটে বাড়ির মালিক তোমার বাবা আবার সে সরকারি চাকরি করে। আর আমি? সব কিছুরই একটা ভালো খারাপ দিক থাকে বুঝলে। কিছু মনে করো না, আমি উঠি; সকালে অফিস আছে ।

বাহিরে তো এখনো বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় যাবেন? একটু চুপ করে বসেন।

আবারো বললো–‘আপনি সেদিন ও কথা শেষ না করে চলে গেছেন’।

যে কথায় মানুষ কোন শান্তনার ‘শ’ পায় না তার শুরুই কি আর শেষই বা কি।

তোমার এই অতিথিয়তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আশা করি ভালো থাকবে। পৃথিবী গোলাকার আবার দেখা হবে।

পেছনের দিকে আর তাকানোর মত সময় থাকলেও সে তাকায় নি। সে জানে মানুষের জীবনের কিছু ঘটনা, দুর্ঘটনা থাকে যা সে নিজেও কামনা করে না।

জানালার ফাঁক দিয়ে সাদিয়া তাকিয়ে থাকবে শুভ জানে সেটা। প্রাইভেট পড়িয়ে আসার সময় সে এই কাজটাই করতো। কিন্তু শুভ এটা পছন্দ করতো না।

সাদিয়ার মা মেয়ের এই কাণ্ড দেখে শুভকে বলেছিল—’বাবা আমার একটা মাত্র মেয়ে শুধু তোমাকে চেয়েছে। মা হয়ে তোমার কাছে কি আর বলার আছে বল? কিন্তু শুভ রাজি হয় নি। প্রত্যেকেরই তো একটা আত্মসম্মানবোধ থাকে, তাই না ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top