আমার স্কুলের জন্যে প্রার্থনা – হোসেন আবদুল মান্নান
‘ছুটির দিনে বই’ সিরিজ লেখার ফাঁকে হঠাৎ করে
আজ একটি গ্রামীন হাইস্কুলের সাতকাহন নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করলো। এটি গ্রাম বাংলার আর দশটা স্কুল- কলেজের মতই সাধারণ ভাবে গড়ে উঠা শিক্ষায়তন। বৃটিশ ভারতে ইংরেজ শাসন আমলের শেষ দিকে বিশেষ করে বঙ্গ-ভঙ্গের পরে বাংলার নানা স্থানে একযোগে অসংখ্য ছোট বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন হতে থাকে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন খানিকটা প্রশমিত করার কৌশল হিসেবেও তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে অনেক গবেষক মনে করেন । সে সময় বিত্তবান হিন্দু জমিদার শ্রেণির প্রতিনিধিরাই এ কাজে অধিকর অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। জমি দান করা, ছাত্র- শিক্ষক সংগ্রহ করা, লজিং রাখা, সরকারি আনুকূল্য গ্রহন করা ইত্যাদি কাজ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারাই সম্পন্ন করেছেন। প্রাইমারি, এম,ই, বা জুনিয়র হাই এসব নামে বিদ্যালয়গুলো তখন যাত্রা শুরু করে।
সে প্রেক্ষাপটেই প্রতিষ্ঠিত আমাদের এলাকার বেশ ঐতিহ্য-ধারক একটি বিদ্যালয়ের নাম চাতল বাগহাটা হাইস্কুল। কিশোরগন্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলাধীন মুমুরদিয়া ইউনিয়নে এর অবস্থান।
আমার নিজের জন্ম স্হান থেকে এর দূরত্ব মাত্র দেড়
কিঃ মিঃ। একটি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য যতটুকু যোগাযোগ ব্যবস্হা প্রয়োজন বাস্তবে তার চেয়েও উন্নত পরিবেশে এর অবস্থান। এ যাবৎ এতে যৎসামান্য শ্রীবৃদ্ধি যা ঘটেছে পুরোটাই আমাদের চোখের সামনে হয়েছে।
১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত মোট এগারো বছর আমি এ স্কুলের একই আঙ্গিনায় যাতায়াত করি। প্রাথমিক থেকে হাইস্কুল। ১৯৬৭-৬৮ সালেই হাইস্কুলে রূপান্তর এবং ১৯৬৯ সালে প্রথম এস এস সি পরীক্ষা চালু হয়। আমার এগারো বছর থাকার কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে অটোপ্রমোশন না নেয়া। স্কুলটির বিদ্যমান আদল ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ধানের জমির আল থেকে বিশাল খেলার মাঠ এবং পরবর্তীতে এটি বিশেষ ক্রীড়াঙ্গন হিসেবে গোটা এলাকার এক আকর্ষণীয় স্হানে পরিনত হয়েছিল। মনে পড়ে, এ মাঠে বড় বড় কাবাডি খেলা,ফুটবল খেলা এমনকি বাউল গানের আসরও বসানো হতো। এ মাঠের কাবাডি খেলায় একবার আমার এক চাচা খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নিয়েছিল, বাবা, চাচারাসহ একসঙ্গে সে খেলাও দেখেছি। বাবা এবং সেই চাচা এখন আর নেই। মাঠটিও মনে হয় ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে বিলীন হওয়ার পথে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন আমাদের শৈশবের খেলার মাঠগুলো,আমাদের সাঁতার শেখার পুকুরগুলো, ছোট ছোট জলাশয়গুলো ক্রমেই গ্রাস করে চলেছে। থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। অদৃশ্য নানা অনুসঙ্গ জড়িয়ে আছে অক্টোপাসের মতো। অথচ হাজার হাজার বছর আগের মহাভারতেও উল্লেখ রয়েছে, জলাশয়, উপাসনালয় এবং উন্মুক্ত মাঠ সৃস্ঠির ভেতরই নিহিত আছে সভ্যতার অন্যতম প্রধান রহস্য।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ কালে স্কুলে অসাধারণ মানসম্মত, মেধাবী, মননশীল একদল শিক্ষক পেয়েছিলাম আমরা। যাঁরা শিক্ষকতার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসেন। যাঁরা সংকটেও পেশাদারিত্ব আগলে ধরে শুধু দিয়েই গেছেন অকাতরে। নেওয়ার ভাবনা তো দূরের কথা। লেখা পড়ার বাইরে তাঁদের অন্য কোন জগৎ ছিল না। ছিল না দলাদলি বা দুর্নীতির অন্ধকার হিসাব নিকাশ। আজকের গ্রাম্য রাজনীতির নোংরা মানসিকতা ও পঙ্কিলতা এঁদের কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। এঁরা অন্যায়ের কাছে নত হতেন না। তাঁরা সত্যের সারথী। তখন আবালবৃদ্ধবনিতা জনসমক্ষে অবনতমস্তকে ওনাদের সম্মান প্রদর্শনে মোটেই কুন্ঠিত হতো না। তাঁরা বংশ পরম্পরায় সকলেরই যেন শিক্ষক। এবং এটি সত্য যে,আমার বাবার শিক্ষক স্হানীয় হেমাদপ্রসাদ ঘোষকে একই স্কুলে আমিও আমার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। আহ্! কী চমৎকার প্রজন্মের বন্ধন ও মধুর পরম্পরা।
যতদূর জানি, সেই মানের শিক্ষকগন এখন আর কোথাও নেই। একেবারেই হারিয়ে গেছেন তাঁরা। নতুন নতুন অট্টালিকা, দালান ঘর প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কতকিছু উঠেছে। অথচ ভেতরের মানুষগুলো সে ভাবে তাল রেখে যোগ্যতায় বলীয়ান হয়ে ব্যক্তিত্ববান হতে পারছেন না। তাঁরা ঐক্যবদ্ধ নন। বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত,কখনো বা সংক্ষুুব্ধ। মনে হয়,তাঁরা অস্তিত্বের সংকটে পড়ে আছেন।
ন্যায় অন্যায়, সত্য মিথ্যা, সাদা কালো, ভালো মন্দ কোন কিছুই বিচার করে বলতে পারছেন না। যেন একটি গুমোট, দুর্বিষহ অবস্থায় পড়ে কেবল সময় ক্ষেপন করে চলেছেন।
আমার খুব কষ্ট হয়। কারণ, আমি আমার স্কুলটির কাছে সর্বদা ঋণী। আড়ালে থেকেও কিছুটা ঋণশোধ করার আপ্রাণ চেষ্ঠা করে যাই। এ প্রচেষ্ঠায় কোন খাদ নেই। কৃত্রিমতাও নেই। একেবারে খাঁটি সোনা। বিশ্বাস করুন,আমার শিক্ষা-বান্ধব আজকের প্রজন্ম, এই আমি প্রায়শই ভাবি, তৎকালীন সময়ে আমাদের এলাকার এই স্কুল না থাকলে আজ আমি কোথায় না থাকতাম? আদৌ কি আমি হয়ে উঠতে পারতাম?
মাঝে মধ্যে এও ভাবি, এই কী তাহলে সারা দেশের চিত্র ? এই কী আমার জন্মভূমি ; আমার বর্ণমালার প্রথম হাতেখড়ি? এভাবে চলতে থাকলে আমরা কী সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো? দেখে যেতে পারবো জাতির পিতার স্বপ্নের মাতৃভাষার বহুমাত্রিক রূপ ও সোনার বাংলাদেশ? কী হবে আমাদের মতো অজ পাড়া-গাঁয়ে বেড়ে উঠা সন্তানদের?
হোসেন আবদুল মান্নান
লেখক ও সরকারী চাকুরীজীবি
০৯ অগহায়ণ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।