সন্তান – সাগর চৌধুরী
পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি চাকুরি করছি। জুনিয়র অফিসারদের অবস্থা যা হয় আমার অবস্থা তাই। সারাদিন সহকর্মীদের সাথে বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত থাকা। অফিসে এসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট করা।
বেশ ভালোই আছি সরকারি চাকরি তার উপরে সরকারি কোয়াটারে থাকতে পারছি। আত্মবিশ্বাসের ডেকুর তুলে কাজে মনোযোগী হয়েছি বলেই সবার কাছেই আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেল দিন দিন। কাজের মানুষ সবাই পছন্দ করেন। এ একটা সত্যি কথা হলেও অনেকের জন্য সেটা খারাপ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন আমার জন্য। অফিসের বড় স্যার বললেন – কাজ করে যাও এর মূল্যায়ন একদিন না একদিন পাবেই।
এই আশার বালি বুকে ধরে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছি। ইয়া মোটা মোটা ফাইল দু’চার দিনের মধ্যেই রেডি করে দিচ্ছি। সকালে সবার আগে অফিসে ঢুকতে হয় আর বের হতে হয় সবার পরে। তাছাড়া নতুন বলে অনেকের কাছেই কাজ বুজে নিতে হচ্ছে। পুরনোরা কত রকম ছুতোয় যে কাজ ফেলে রাখে। তা ভেতরে না গেলে বোঝা যায় না। সেদিন বড় স্যার ডেকে বললেন— শুনেছি কম্পিউটার বিষয়ে আপনি ভালো জানেন। আমাকে একটা পুরো ফাইল রেডি করে দিতে পারেন?
‘স্যার কবে নাগাদ কাজ শুরু করবো ?
‘আগামী কাল থেকেই শুরু করেন।’ শুরু হয়ে গেল বড় স্যারের কাজ। তার টেবিলের এক পাশে একটা মনিটরের সাথে সংযোগ দিয়ে বসে গেলাম। একটানা দেড় মাস পর আমার মুক্তি হলো। স্যারের ফাইল রেডি হবার পর।
এত কাজের পেশার যে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধকল শরীরের উপর বইতে শুরু হলো। এবার বুঝলাম কাজ জেনে লাভের অংশে একটা ঘোড়ার ডিম পেলাম । অন্যেরা যখন অফিসের কেন্টিনে বসে চা পান খেয়ে সময় ব্যয় করে তখন আমার বিভিন্ন কাজে নাভিশ্বাস বের হতে লাগলো। এর হাত থেকে মুক্তি চাই। অনেকের সাথে আলাপ আলোচনার পরে একটা বিষয়ে একমত হলাম। এখানে থাকলে কাজের চাপে মরেই যাবো ।
আবেদন করলাম বদলি হতে চাই। বিভিন্ন শহরে এখান থেকে কাজ করে বেশি মজা পাওয়া যাবে। সুতরাং ঘটলোও তাই। নতুন বছরের শুরুতেই আমার বদলির কাগজ হাতে পেলাম।
জেলা সদরে গিয়ে জয়েন করলাম। পরের মাসেই নিজের পাওয়া কোয়াটারে গিয়ে উঠলাম। নতুন অফিসের কাজ বুঝে উঠতে আবার সময় লাগলো। মাস কয়েকের মধ্যেই কাজ আয়ত্তে চলে এল। ফিল্ডে সহকর্মীদের সাথে সমান তালে কাজ করার জন্য নেমে পড়লাম ।
কিন্তু আমার এক সহকর্মীর কাছে একটা এলাকার নাম শুনলাম। আগামীকাল সে এলাকায় আমাকে এসাইনমেন্টে পাঠানো হবে বলে আগের দিনই বলা হলো। এমন রোজ রোজ এক একটি এলাকায় আমাকে যেতে হয়।
সেখানকার জনসংখ্যার সাথে পরিবেশের প্রভাবসহ তাদের শিশু জন্মেও হার কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তার একটা খসরা তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্রামীণ এলাকায় এখনো অতি মাত্রায় শিশু জন্মের হার বেশী।
সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। সেখানকার অবস্থা নিজ চোখে দেখার জন্য। গ্রামের চেহারা দেখে আমি নিজেই আধা বোকা বনে গেলাম। এখানে আবার মানুষ বাস করে নাকি। সাথে থাকা সহকর্মীর কাছে এই প্রশ্ন রাখতেই; সে তার কপালে এমন এক চিন্তার ভাঁজ দেখালেন যে, আমি তাকে আর কিছু বলার সাহস পেলাম না।
প্রথমত নেংরা একটা এলাকা। শহরের সব ময়লা-আবর্জনা মনে হয় এখানে ফেলা হয়। দুর্গন্ধময় পরিবেশ। নাকে রুমার চেপে আছি তারপরও গন্ধে বমি আসছে। পানি আর কাঁদায় মিলিত হয়ে একটা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। তার উপরে আশপাশের দিকে তাকিয়ে দেখি খোলা বাথরুম। এজন্যই এত গন্ধ। আশপাশের লোকজনদের ডেকে জানতে চাইলাম, কারো সাথে একটু কথা বলা যায়? সারা শরীলে ময়লা;একটা লোক এসে বললো-‘আমার ঘরে আসেন। বসবেন। তারপর আপনারা কি জানতে চান সেসব বিষয়ে কথা বলবো।’ এদের নিয়েই আমাকে কাজ করতে হবে। তাই লেট না করে তার কাছে জানতে চাইলাম ‘আপনাদের এখানে সবচেয়ে সন্তান বেশি কার তার সাথে একটু কথা বলতে চাই।’ লোকটা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো-‘জনার ছেলে পেলে বেশি। ছয় ছেলে চার মেয়ে।’ কিন্তু তার বাড়ি যেতে হলে তো স্যার আপনাদের কষ্ট করতে হবে।’
সহকর্মী বললো— করবো। কষ্ট করার জন্যই তো জীবন । চলেন।
এবার লোকটা হাতের কাছে একটা গামছা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বললো—’আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
‘সরকারি লোক। পরিবার পরিকল্পনা অফিসার। আপনাদের ছেলেপেলে বেশি না নেয়ার জন্য পরামর্শ দেবার জন্য এসেছি।’ বললো আমার সহকর্মী এবার আমি চাচাকে আমার কথাগুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে বললাম।
তারপর বললাম—’দেশের জনসংখ্যা দিন দিন যে হারে বেড়েছে সেই হারে কি আমাদের কৃষি জমি বেড়েছে? বাড়ে নি, কিন্তু এভাবে জনসংখ্যা বেড়ে চললে পুরো দেশের জন্য, জাতির জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে। চাচা আমার কথা শুনে বললো-‘তাই তো।’
কাঁদা আর পানি পেড়িয়ে আমরা জনার দেখা পেলাম। ছোট্ট একটা ঘর। তার মধ্যেই এতগুলো বাচ্চা নিয়ে তার বসবাস। আশপাশের পরিবেশের কথা আগেই বলেছি। তার চেয়েও এখানকার অবস্থা খারাপ।
জনার বড় ছেলেটা আমাদের দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। প্রশ্ন করতে সে ভয়ে আঁতকে উঠলো। তার ছোটটাকেও দেখলাম। পেটে কৃমি। কলসির মত পেটটা বের হয়ে আছে। আমাদের দেখে ছেলেপেলেগুলো কিলবিল করতে লাগলো। সে কি অবস্থা। এক পাল বাচ্চা। হঠাৎ কেউ দেখলে সত্যি ভয় পাবে। জনাকে পরিবারের বিভিন্ন বিষয়ে বোঝালাম। আসার পথে বুড়ো চাচাকে বলে এলাম এলাকার সবাইকে যেন বোঝায়। তাকে একটা ছড়া শিখিয়ে দিলাম। বলে এলাম ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট।
বছর পনেরো পর আমাকে আবার সেখানেই বদলি করা হলো। তবে এবারে সেই জুনিয়র পদে নয়। এবার আমার পদ জেলাপ্রধান মন্ত্রণালয় এমন একজন ঐ এলাকায় পাঠাতে চেয়েছিল যার সেখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া বছর দুই প্রমোশন পেয়ে বসে আছি। কিন্তু কাজ করছি জুনিয়র পদেই। তাই ব্যাটে বলে মিলে গেলে মন্ত্রণালয় আমাকেই এখানে পাঠায়।
জয়েন করার বছরের মধ্যেও মাঠে নামি নি। এখন আর এই বুড়ো বয়সে মাঠে নামতেও হয় না। জুনিয়ররাই মূলত মাঠের কাজগুলো করে। তাছাড়া আর চার বছর চাকরির মেয়াদ আছে, তাহলেই পেনশন। এতকিছু নিয়ে চিন্তা করে মাথা নষ্ট করে লাভ নেই।
একদিন সকালে এক জুনিয়র বললো-‘স্যার আমড়াতলা নামে একটা এলাকা আছে, সেখানে একদিন সময় করে আপনাকে যেতে হয়। এ এলাকার অবস্থা খুবই বিপদজনক।
আমাদের এক সহকর্মীর সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে।’
আমড়াতলায় গিয়ে আমি কেমন যেন একটু ভরকে গেলাম। আরে এ এলাকা এত উন্নত হয়েছে। রাস্তাঘাট পাকা। চারদিকে ধবধবে পরিষ্কার। এখানে জনা নামের এক লোক আছে খোঁজ নিলে পাওয়া যেতে পারে। খুঁজতেই তাকে পাওয়া গেল। লোকটা এখনো বেঁচে আছে।
বললো— স্যার কেমন আছেন? বললাম- তোমার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে?
আমাকে সালাম দিয়ে বলল- ভালো স্যার। বড়টা সেনাবাহিনীতে চাকুরি করছে। তার পরেরটা এবার এই এলাকা থেকে কমিশনার নির্বাচিত হয়েছে। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়েছে। আর বাকি গুলো পড়াশুনা করছে। একদম ছোটটা এসে আমার সামনেই দাঁড়ালো। বললাম বেশ ভালোই আছো তাহলে। তোমার স্ত্রী কেমন আছে? ‘ভালো স্যার।’
অফিসিয়াল কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে এলাম। এসে দেখি স্ত্রীর কালো মুখ করে বসে আছে। কাজের মেয়েটাকে ডেকে বললাম-চা দে একটু। আর শোন, তোর খালা এমন চুপ করে বসে আছে কেন বলতে পারিস? কোন উত্তর না করেই মেয়েটি চলে গেল। চা নিয়ে ফিরে এসে বললো-‘আন্টিকেও চা দিয়েছি। আপনাকে বিস্কুট দিয়ে যাবো? না । দেখ তোর আন্টি বিস্কুট খাবে নাকি।
চায়ের কাপটা নিয়ে স্ত্রীর কাছে গিয়ে বসলাম। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম ‘তোমার কি মন খারাপ?
স্ত্রী হুহু করে কেঁদে উঠলো। তারপর বললো-‘ সারা জীবন তুমি চাকরি নিয়েই ব্যাস্ত ছিলে আমার কোন খোঁজখবর নিয়েছো। বুঝলাম এই বুড়ো বয়সে তার এই কান্নার কোন মানে হয় না। তারপরও কাছের মানুষ
বলতে বাসায় কেউ নেই। তাই সারাদিন পর আমাকে পেয়ে তার এই কান্না। একটু থুতনিতে হাত দিয়ে বললাম ‘কেন কিছু হয়েছে? ‘আজ রিফাতের মৃত্যুবার্ষিকী। সেটাও তোমার মনে নেই।’ স্ত্রীকে কি বলে সান্ত্বনা দেব ভেবে পাচ্ছি না।
আমাদের একমাত্র সন্তান রিফাদ। এয়ার পাইলট। আরো বছর পাঁচেক আগে বিদেশে বিমান দূর্ঘটনায় মারা গেছে। এই একটি মাত্র সন্তান ছিল। সারা জীবন মানুষকে সন্তান কম নেবার তাগিদ দিয়েছি। সরকারি চাকরির সুবাধে হাজারো জনপদে ঘুরে ঘুরে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছি কিন্তু শেষ জীবনে এসে সন্তান হারা স্ত্রীর চোখের কান্না দেখে মনটা খুব খারাপ হয়।
মনে হয় জনাই ভালো করেছে।
সে বয়স থাকতেই অনেকগুলো বাচ্চা নিয়েছে। এই বুড়ো বয়সে তাকে আর স্ত্রীর চোখে পানি দেখতে হবে না। সত্যি সন্তান হারা বাবা-মায়ের কষ্টের ভার সহ্য করা খুব কঠিন। রিফাতের মৃত্যুর পর স্ত্রীর চোখে কখনো পানি শুকাতে দেখি নি।