খাদ্য বিভাগের তিন কর্মচারী’র অনিয়ম ও দুর্নীতি
অপরাধ প্রতিবেদকঃ খাদ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িয়ে পড়েছেন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে। তাদের কেউ সরকারি গুদামের চাল ও গম বিক্রি করে পালিয়েছেন। কেউ পরিচিতজনকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে আত্মসাৎ করেছেন লাখ লাখ টাকা। কেউ বা আবার কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন সরকারি গাড়ি, এ গাড়ি চাপা দিয়ে ঘটিয়েছেন হত্যাকাণ্ড। এসব অপরাধের বিষয়ে বিগত সরকারের সময় তদন্ত হয়েছে। তবে আইন অনুসারে পর্যাপ্ত শাস্তি হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
গুদামের চাল ও গম বিক্রি করে পালিয়ে যাওয়া কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি বলে জানা গেছে। চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে প্রমাণ হয়নি বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এছাড়া সরকারি গাড়ি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করে হতাকাণ্ডের ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য উপ-পরিদর্শক কানিজ ফাতেমা রংপুর সদর উপজেলা খাদ্য গুদামের ইনচার্জ হিসাবে বছর খানেক আগে পোস্টিং পেয়েছেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. মিজানুর রহমানের আত্মীয় কানিজ ফাতিমাকে তার সুপারিশেই রংপুরে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে কানিজ ফাতেমা পলাতক। তিনি প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার খাদ্যশস্য বিক্রি করে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হলেও তিনি গ্রেফতার হননি বলে জানা গেছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, কানিজ ফাতিমার মতো কয়েকজন মাঠপর্যায়ের কর্মচারীর জন্য খাদ্য বিভাগের দুর্নাম হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কানিজ ফাতেমা পিও মিজানের আত্মীয় বলে আমরা জেনেছি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মচারী জানান, পিও মিজান কানিজ ফাতিমাকে বাঁচাতে এখনও তৎপর। তিনি সাবেক মন্ত্রীর সময় অফিসে হাজির থেকে কয়েক লাখ টাকার ভ্রমণ বিল নিয়েছেন।
পিও মিজানুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, কানিজ ফাতেমা আমার আত্মীয় নন। আমি সাবেক সরকারের সময় ভুয়া বিল গ্রহণ করিনি। এগুলো মানুষ শত্রুতা করে বলে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনার মহেশ্বরপাশা সিএসডির উপ-খাদ্য পরিদর্শক মো. শাহদৎ হোসেনের বিরুদ্ধে পরিচিত একজনকে চাকরি দেওয়ার নামে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। চাকরি প্রত্যাশী মজনু আলম মনিরের কাছ থেকে নগদ টাকা গ্রহণ করেন, চাকরি দিতে ব্যর্থ হলে সব টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিশ্বস্ততা অর্জনে শাহদৎ নিজ নামের প্রাইম ব্যাংকের ৫টি চেক ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মজনু আলম মনিরের আত্মীয় নাজমুল হাসানের নামে দিয়ে রাখেন। টাকা লেনদেনের বিষয়ে একটি স্ট্যাম্পও লিখিত ডকুমেন্ট হিসাবে রাখেন নাজমুল।
একপর্যায়ে চাকরি দিতে ব্যর্থ হলে শাহদতের কাছে টাকা দাবি করলে তিনি আজ না কাল বলে ঘোরাতে থাকেন। যেহেতু লেনদেন হয়েছে নাজমুল হাসানের সঙ্গে তাই তিনি খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজির কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন। টাকা নেওয়ার সময় প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী নূরে আলম যুগান্তরকে বলেন, টাকা সাড়ে ১৫ লাখ নিয়েছে সত্য। কিন্তু টাকা ফেরত দিচ্ছে না। নাজমুলের অভিযোগ তদন্তে সাতক্ষীরার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে (ডিসি-ফুড) তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার ডিসি ফুড রিয়াদ কামাল গণমাধ্যমে বলেন, অনেক দিন আগের কথা, সব মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে খাদ্য বিভাগে চাকরিতে আসার আগে শাহদৎ প্রাইম ব্যাংকে চাকরি করতেন। ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একজনের কাছ থেকে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে তার নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাঁচটি চেক দিয়েছেন। বিষয়টি যেহেতু শাহদতের ব্যক্তিগত লেনদেন সে কারণে আমরা এতে নিয়মের বাইরে গিয়ে দেখিনি। তারপরও আমরা প্রাইম ব্যাংকের চেকগুলো যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই জানায়নি।
খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, টাকা নেওয়ার ঘটনা সত্য এবং শাহদৎ আগে ওই ব্যাংকে চাকরি করায় প্রভাব খাটিয়ে চেকের সত্যতা যাছাই সংক্রান্ত আবেদনের জবাব পাঠাতে বারণ করেছেন।
অভিযোগকারী নাজমুল হাসান গণমাধ্যমে বলেন, চেক শাহদতের নামে থাকা প্রাইম ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের এমআইসিআর চেক। পাঁচটি চেক দিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন তারিখে। কিন্তু স্ট্যাম্প একটি। তদন্ত কর্মকর্তা নামকাওয়াস্তে একপেশে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। আমি বিষয়টি পুনঃতদন্ত ও ভুক্তভোগীর টাকা ফেরত চাই।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নেত্রকোনার ডিসি ফুড মো. মিজানুর রহমান গত বছর ১৩ জানুয়ারি কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ব্যক্তিগত কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। তিনি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-১৩-৯৩৩০) নিয়ে টাঙ্গাইল যাওয়ার সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে দুর্ঘটনায় দুজন মানুষ মারা যান। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি বিষয়টিকে নিতান্তই দুর্ঘটনা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। ডিসি ফুড মিজানুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, আমি মৌখিক অনুমোদন নিয়ে গাড়িটি ব্যবহার করেছি। দুর্ঘটনা শিকার হয়ে আমার হাত ভেঙে গেছে। দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। এখানে আমার তো কোনো অবহেলা ছিল না।
পরিচালক মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়াই গাড়ি ব্যবহার করেছেন। তদন্তে তাকে দোষীও করা হয়েছে এবং তার বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছে। তবে যে দুজন নিরীহ মানুষ মারা গেছেন, সে বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধ এবং সে বিষয়ে শুধু (নিহত ব্যক্তির) তাদের পরিবারের সদস্যরা আলাদা মামলা করতে পারেন। সেই মামলার সঙ্গে খাদ্য বিভাগের মামলা ও তদন্তের মিল থাকবে না। কারণ সেটি ফৌজদারি মামলা।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্ঘটনায় শিকার গাড়িটি খাদ্য গুদাম নির্মাণ প্রকল্পের গাড়ি। ডিসি ফুড সেই গাড়ি ব্যবহারের কথা না। সেই গাড়ি মেরামতের লাখ লাখ টাকা কে দেবে বা দিয়েছেন। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মীমাংসা হয়েছে। একজন ডিসি-ফুড এত কিছু কি করে প্রভাব খাটিয়ে ম্যানেজ করলেন? বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে।
সাবেক খাদ্য সচিব (বর্তমান সমাজকল্যাণ সচিব) মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিগত সরকারের সময়ের নানান অপরাধ ও দুর্নীতির হালনাগাদ তথ্য চেয়ে খাদ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে ৫ আগস্টের আগে সংগঠিত অপরাধ-দুর্নীতির যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার তালিকা, অপরাধের ধরন, যথাযথ তদন্ত হয়েছে কিনা, না হলে কেন হয়নি, যথাযথ শাস্তি হয়েছে কিনা, না হলে কেন হয়নি-এ সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে প্রয়োজনে অপরাধ ও দুর্নীতির বিষয়গুলো ফের তদন্ত হবে।
আরও সংবাদ পড়ুন।
খাদ্য বিভাগের মাঠ কর্মকর্তা কর্মচারীদের রুখবে কে! অবৈধ মজুতে অসাধু কর্মকর্তাদের হাত
আরও সংবাদ পড়ুন।
ভোলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পায়নি ৫৪ হাজার দরিদ্র পরিবার; অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক খাদ্য কর্মকর্তা শেখ মঈন উল ইসলামের বিরুদ্ধে – দুদকের মামলা
আরও সংবাদ পড়ুন।
উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার চাল চুরি! হাতে নাতে ধরেন ভ্রাম্যমান আদালত
আরও সংবাদ পড়ুন।
ফরিদপুরে উপ-খাদ্য কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন দুদকের হাতে গ্রেফতার
আরও সংবাদ পড়ুন।
সংসদে উত্থাপন – অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য মজুতের শাস্তি; কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক খাদ্য সচিব বরুণ দেব মিত্রের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জব্দ