পুরো বর্ষাকালটাই বিশু’র কষ্টে কাঁটালো। এই মেঘ তো সাথে সাথে বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে শুকায়। এই বৃষ্টির মধ্যেই সে নিজের কাজের জন্য সুযোগ খুঁজে খুঁজে যখন কাজের জন্য তৈরি হলো আর তখনি হলো বিপত্তি।
কথাটা শোনার পর মনে হলো এখুনি গিয়া বুড়ার মাথাটা ফাটিয়ে আসে কিন্তু কি করে সে এটা করে? সারা দিনের না খাওয়া।
ভেবেছিল হাতের কাছে যা পাবে তাই খাবে। হাতের কাছে
খাওয়ার জন্য একটা কিছু তো পাওয়া চাই। দিন পেড়িয়ে রাত চলে আসে কিছু সে পায় না।
চিড়া আর গুড় অবশ্য দিয়ে গিয়েছিল মাথু। সে চিড়া গুড়ে এখন লাল পিপড়ার বাসা।
বাঁশের মাচার উপর কলাপাতার বিছানা। বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তালপাতার ছাউনি। পানি খাওয়ার জন্য একটা সিলভারের জগ। চিড়া-গুড় আর পানি ভর্তি জগটা দিয়ে যাবার সময় মাথু বললো ‘থাক এই খানে আমি আজ রাইতে তোর জন্য ভাত রাইধা নিয়া আমু ।’ সে যে গেল আর দুই দিনের মধ্যেও খবর নাই।
আরে ব্যাটা এইটা কেমন কথা! দু’দিন ধইরা একটা মানুষ ভাত না খাইয়া কেমনে বাইচা থাকে। কথা গুলা নিজেই নিজের সাথে বলে আর ফোঁস ফোঁস করে।
তাল গাছের ডাল বেয়ে লাল পিপড়ার সারি বিশুর দিকে আসতে দেখে সে একটু রসিকতার সুরে বলে-‘মরার আগেই লাইন ধইরা চইলা আইছো খাওয়ার আশায় ।’
সে মনে মনে ভাবে আয় শালা একবার। তোরে আচ্ছা মতো .. .রাগের মাত্রা তার বেড়েই যায়।
পেটের ভেতরের নাড়িভুড়ি যেন সব হজম হয়ে গেল। ঝোঁপের পাশে কি যেন একটা ফল পেকে আছে দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল, অমনী ফোঁস করে একটা সাপ তার সামনে বেড়োলো। ভয়ে একটু পিছন ফিরে এল বিশু।
কিছুক্ষণ পর বাঁশের একটা খণ্ড নিয়ে সে আগের জায়গায় পাতা লতাগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলো। কই শালা সাপের বাচ্চা।
ঘণ্টা খানেক সময় সে সেখানে ব্যায় করলো কিন্তু সাপের দেখা আর পেল না।
সন্ধ্যার আগে আগেই সে ঝোপের আস্তানা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লো। মাথুরে বিশ্বাস নাই। ও হালায় পুলিশের হাতে ধরাও খাইতে পারে। ধরা খেয়ে যদি সে বলে দেয় যে, ও বনের মধ্যে লুকিয়ে আছে। তখন তো থানার পুলিশ চেং দোলা করে ধরে নিয়ে যাবে।
নিজে নিজেই বলে-‘আরে ব্যাটা তোরে কত বার কইছি সরকারি মাল ধরার দরকার নাই।
কিন্তু কে শোনে কার কথা’ ?
ধরছোস তো এখন মরছস।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মেশিন চুরি করেছে তারা দু’জন।
পুলিশের দৌড়ানির উপর আছে। বিশু বেশি দূরে না গেলেও গ্রামের শেষ মাথায় সুপারি বাগানের ঝোঁপে পালিয়ে ছিল। কিন্তু দুই দিন পরেও মাথু না আসায় সে এইবারে তার দল ত্যাগ করলো।
পালানো মানে পালোনো। কারো সামনে মুখ দেখানো যাবে না। কারণ গ্রামের মধ্যে একটা কানাগুষা সে আঁচ করতে পারছে। ধরতে পারলেই পুলিশের কাছে; রক্ষা নাই।
পাশের গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন সে যাচ্ছিল কে যেন একবার ডেকে বলছিল ‘এই বিশু মাথু কইরে! শুনছি পুলিশের কাছে ধরা খাইছে ?’
বিশু সে কথায় কান না দিয়ে সোজা চলে এসেছে মাঠের দিকে। মাঠে এক হাঁটু কাঁদার মধ্যে সে পা ফেলে এগিয়ে গেল। এই মাঠ পেরুলেই সামনে পাকা রাস্তা। রাস্তায় উঠতে পারলে কে আর বিশুরে খুঁজে পায় ?
তখন সারা পৃথিবী বিশুর।
হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বিশু ভুলে যায় তার ক্ষুধার কথা। তার পেটে আজ সারদিন কিছু পরে নি, ক’ফোটা জল ছাড়া। তারপরও বিশু দাঁড়ায় না।
পুলিশের ভয়ে তার হাঁটার গতি কমে না। সে যদি একবার পুলিশের হাতে ধরা খায়, তবে সাজুরে সে পাইবো ?
সাজু বার বার বিশুরে কইছিল-‘তোমার বন্ধুর নজর ভালো না। সে কিন্তু লোক ভালো না।
তুমি হের লগে হাটবা না। তারপরেও যদি হাঁটো তয় আমার কথা ভাববা না।
আজ শালা সেই মাথুর লগে হাঁটতে গিয়া। সে নিজের কাছে নিজেকে তিরস্কার করে। নিজের মাথা নিজে খোটে, কেন সে সাজুর কথা শুনলো না ?
আর বুইড়া তোমারে, হালার পো তোমারে আমি …
…মনে মনে বকতে থাকে সাজু’র বাপকে।
অনেক হাঁটার পর সে দূর থেকে গাড়ির লাইটের আলো দেখতে পেল।
কম না প্রায় নয় দশ মাইল হাঁটলো বিশু। মাঝে মাঝে হাঁটু সমান কাদা আর বুক সমান পানি পাড়ি দিয়ে তবেই রাস্তার কাছাকাছি এল। এবার কোন গাড়িতে বা লড়িতে চড়ে অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি দিতে হবে।
জীবনের এই প্রথম, গ্রামের পরিবেশ ছেড়ে বাহিরে বেরুবে বিশু। কারো জন্য মনটা তার পোড়ায় না; যদি সাজুরে সে নিয়ে আসতে পারতো।
বাবার কথা তার মনে নেই। তবে মায়ের মরার আগ পর্যন্ত সে মায়ের কাছেই ছিল। কিন্তু সাজুর কথা মনে পড়লেই মন চায়, বুড়ার মাথাটা ফাটিয়ে আসে কিন্তু কি করে সে এটা করে ?
বুড়ো মানে সাজুর বাবা। বাজার পাহারাদার। এক রাতে এক প্যাকেট বিড়ি চুড়ি করতে গিয়ে তার সামনে পড়েছিল, সেই থেকে সে যেন তার অলিখিত দুশমন। সে দিন রাতের পর যে কতবার তাকে দেখে সে সালাম দিয়েছিল কিন্তু তার সালামের কোনদিন উত্তর দেয়নি বুড়ো।
এই নিয়ে সাজুর সাথেও তার কথা হয়েছে। তবে বুড়ার মতিগতি বোজা মুশকিল। কখন যে কি করে বসে তার ঠিক নেই। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পাকা রাস্তায় ওঠে সে। চারপাশে তাকায়। এই খানে ধরা খাওয়ার আর কোন চিন্তা নেই তার। হাটতে হাটতে সে ক্লান্ত হলেও বসার জন্য মনটা ছটফট করছে না।
পাকা রাস্তায় বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে থেকে চটজলদি কোন একটা গাড়িতে উঠতে পারলেই আপাতত মুক্তি।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার পর তার মনে হলো সাজুরে নিয়া পালালেই ভালো হতো।
কিন্তু সাজু কি আর পালাইতে চাইতো ?
একদিন সাজু বলেছে তার এক আত্মীয়ের সাথে তার বিয়ের কথা ঠিক করে রেখেছে তার বাবা। ছেলে চটের কারখানায় কাজ করে। ভালো বেতন পায়। বেতন পেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠায়। সেই টাকা তুলতে ছেলের বাপ সাজুর বাপেকে সাথে নিয়া সদরে যায়। ছেলে বাপ মায়ের জন্য এটা সেটা পাঠায়।
মনটা বেশ মোচর দিয়ে উঠলো বিশুর। কি করে সে সাজুকে ফেলে যায়।
সাজুর জন্য তার জীবনের পুরোটা দিতেও রাজি। কিন্তু পুলিশের ভয়টাও তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
সেই সাথে আবার যোগ হয়ে আছে সাজুর বাপ সেই বুড়োটা। হাতের কাছে পেলে সেও নিশ্চয় তাকে ছেড়ে দেবে না। যেহেতু গ্রামের সবাই এখন জেনে গেছে যে মাথুর সাথে বিশুও ছিল।
টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বিশু আবার রাস্তা ধরলো গ্রামের। মনে মনে পন করলো, বুড়ো যাই করুক আর যাই বলুক, সে সাজুর বাবা তাকে সে কিছুই করবে না, তবে সাজুকে নিয়েই আজ সে পালাবে।
সাজুর জন্য মনটা কেমন যেন পেড়ায়।
এখন রাত অনেক। সাজুর বাপ বুড়োটা এখন বাজারে। পাহারাদার হিসাবে তার একটা সুনাম আছে এলাকায়। নিজের কাজের অবেহেলা করে বাসায় শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া তার স্বভাব নয়।
বাজারের রাস্তায় তাকে দেখতে পেলে সাজুর বাবা তাকে সন্দেহ করতে পারে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া বাজারে টহল পুলিশও থাকতে পারে।
এই সময়ে খুব সাবধানে চলাচল করতে হবে না হলে শেষ। বাজারের পেছনের রাস্তা দিয়ে বিশু সাজুদের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। এই রাস্তাটায় রাতের বেলা লোকজন চলাচল কম করে। তাছাড়া রাস্তাটা পুরোটাই ভুতুরে।
বাড়ির সামনে গিয়ে বিশু পাখির ডাকের মতো শিস দেয় দু’ঠোঠ সুচালো করে।
একবার দু’বার তিন বার কিন্তু সাজুর কোন খবর নেই। এই ডাকেই সাজু বুঝতে পারতো বিশু তাকে ডাকে।
ঘর থেকে সাজু বেড়িয়ে আসতো কিন্তু আজ সে কেন আসছে না? বিশু নিঃশব্দে এগিয়ে যায় বাড়ির পেছনের বাবলা গাছটার নিচে। সেখানে গিয়ে গাছের একটা ডাল ধরে দাঁড়ায়। তার পর ঠোঁট দু’টোকে সুচালো করে আবার পাখির মতো ডাক দেয়।
কিন্তু কোন কাজ হয় না।
বিশু ভেবে পাচ্ছে না, সাজু কেন কোন সারা শব্দ করছে না তার ডাকে।
আস্তে আস্তে হেঁটে যায় সে ঘড়ের পেঁছনে। বাঁশের বেড়ায় হাত রাখতেই হাঁক দিয়ে উঠলো-‘কে ওখানে?
বিশু ভয় পেয়ে গেল। একটুও নড়লো না, নরলেই ধরা খাওয়ার জোগার। গলা শুনে মনে হলো সাজুর বাপের গলা ওটা। কিন্তু বুড়ো আজ ঘরে কি করছে ?
বাঁশের বেড়ার উপর থেকে হাত নামিয়ে যখন ভেতরে একটু উঁকি দিয়ে দেখতে গেল।
অমনি সাজুর বাবা হুড়মুড় করে দরজা খুলে চোর চোর বলে চিৎকার করতে করতে বাহিরে বেড়িয়ে এল। বিশু আর কি করবে উপায়ন্তর না পেয়ে বাড়ির পেছনে নেমে দিল এক দৌড়। দৌড়ে গেল বেশ কয়েকটুকু পথ।
তারপর একটু আড়ালে গিয়ে পেছন ফিরে
দেখলো, তার পেছনে কেউ কি আছে; নাকি সে শুধু দৌড়াচ্ছে।
তার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। আজ আর সাজুর সাথে দেখা হবার কোন সুজোগই রইলো না। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলো অন্ধকারের মধ্যে আবছা আলোয় কে একজন হেঁটে সামনের দিকে আসছে।
বিশু একটু আড়ালে নিজেকে লুকালো। লোকটা আসতে আসতে একেবারে তুলা গাছটার নিচে এসে বললো- ‘এই বিশু আমি মতি। ভয় পাইস না। বের হ।’
মতির গলার সুর শুনে চিনতে পারলো তারে। বললো বিশু -এই সাজুর কি হলোরে ?
তার তো বিয়ে হয়ে গেছে গত পরশু রাতে। আর মাথুরে পুলিশে ধরছে। তোর তো সাহস কম নারে বিশু। তোরে পুলিশ হন্যে হয়ে খোঁজে আর তুই কিনা গ্রামে? জানের ভয় ডর কিছুই নাই তোর ?
বিশু প্রথম সংবাদটা শুনেই কেমন নিথর হয়ে গেছে।
পরের সংবাদগুলো তাই তার কাছে মূল্য পেল না। খুব সহজেই বিশু বুঝতে পেরেছে বুড়ো সেই ছেলেটার সাথেই সাজুর বিয়ে দিয়েছে।
আহা সাজু…
কার জন্য এত দূর আসা। না হলে সে এতক্ষণে কোথায় চলে যেত। কোন এক অচেনা শহর পার হয়ে আরেক শহরে গিয়ে পৌঁছাত। আসলে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
পৃথিবীটাই এমন।
সাগর চৌধুরী
সম্পাদক ও প্রকাশক।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।