দুঃখের গল্প – সাগর চৌধুরী

PicsArt_09-18-09.11.21.jpg

দুঃখের গল্প – সাগর চৌধুরী

আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে চালাক-চতুর, বুদ্ধিমান এবং মোধাবী প্রানী হিসাবে দাবী করি। মাঝে মাঝে আমার কাছে এই বিষয়টা গোয়ালার দুধের কথা মনে করিয়ে দেয়। কারন গোয়ালার কাছে তার দুধ কখনোই খারাপ না বরং অন্যদের চেয়ে ভালো এটাই তার দাবি। তাই মানুষ হিসেবে এই রকম দাবি আমাদের থাকতেই পারে। তবে মানুষ যে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা প্রাণী এটা কিন্তু মিথ্যে নয়। প্রমাণ চাইলে কেউ দিতে পারি!

আমাদের একটা বিষয় লক্ষ করলে সবাই ধরতে পারবেন। আমাদের জন্য যতগুলো ধর্মগ্রন্থ সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন, কোনোটায় দুঃখের বর্ণনা ছাড়া আর কি কিছু আছে? মুসলমান, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ যে ধর্মের কথাই বলুন। দুঃখের কথা ছাড়া কি কিছু আছে? আমি বিতর্ক চাই না। শুধু বলতে চাই এই কথাগুলো সত্যি কি না।

আমাদের সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন যে জীবনের কথাই বলেন না কেন। শুধু দুঃখের শোক গাথা। বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিনটি সেটিও কি কম দুঃখের?

আমাদের কাছে, পাশে, উপরে, নিচে সবখানে দুঃখের এক এলাহি কাণ্ড। দুঃখকে আমরা পরম ভালোবাসি। দুঃখকে আমরা পরম শ্রদ্ধা করি। দুঃখকে আমরা আমাদের বুকের ভিতরে লালন-পালন করি। আর যদি এই কথাগুলো মিথ্যেই হবে তবে এবার প্রশ্ন করি আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনটির কথা বলুন? কি? সেটি কি সুখের না দুখের?

যদি সুখের হয়, তবে দু’চোখ দিয়ে শ্রাবণের আকাশের মতো জল ঝরছিল কেন? আমাদের জীবনের অনেক প্রশ্নই আছে যার উত্তর আমাদের নিজেদের কাছেও নেই।

আমরা সবাই, টাকা দিয়ে টিকেট কিনে সিনেমা হলে, অন্যের অভিনয় দেখতে যাই। কিন্তু নায়িকা যখন তার প্রেমিকের জন্য বালিশ বুকে চেপে ধরে কাঁদে তখন কি আমরাও কাঁদি না? তার শোকে আমরাও চোখের জল ফেলি না? সেই চোখের জল এত আড়ালেই মুছে ফেলতে চাই যেন আমার পাশে বসা সঙ্গীটি না দেখতে পায়। কি সত্যি, নাকি মিথ্যে?

গান মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম বলা হয়। এরকম যে সুর পছন্দ করে না সে…।

কিন্তু আমার প্রশ্নটি হলো ক’জনা সুখের গান শোনেন? আমার জানা মতে পৃথিবীর যতগুলো জনপ্রিয় গান আছে তার অধিকাংশই দুঃখের। তাহলে আমরা কি দুঃখ ভালোবাসি? এবারো যদি বিশ্বাস করতে না চান তবে আপনাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন? বিয়ে যে কোন নর-নারীর জন্য আনন্দ বয়ে আনবে এটাই সবার কাম্য তাই না? অথচ বিয়ে বাড়িতে সানাই কি কান্নাটাই না কাঁদে। আমাদের জীবনটাই যেন এক দুঃখের মহা সাগর। এই পৃথিবীতে আমাদের আগমনটাই কান্না দিয়ে। কান্না দিয়ে আগমন হলেও কোন বাচ্চা যদি জন্মের পর না কাঁদে তবে ডাক্তারা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে।

কেন ? আধুনিক চিকিৎসা সেবায় মায়ের পাশে তখন ডাক্তারা ছাড়া আর কেউ থাকে না। তো বাচ্চা যখন না কাঁদে প্রথমত ডাক্তরাই চিন্তিত হয়।

এবার বাস্তব জীবনের একটা ঘটনা না বললেই নয়। আমার সেঝ খালার বাচ্চা হয়েছে। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরাই গাইনি বিভাগের সামনে অস্থির। মেডিকেলের ডাক্তার একটু পর অপারেশন রুম থেকে বের হয়ে এসে মুখ ভার করে জানাল যে, বাচ্চা কাঁদে না। আর কি করা; আমার মা খালারা সে কি কান্না!

এমন ভাবে কাঁদে কেউ যেন কারো কান্না না দেখে। আমি পড়লাম মুশকিলে, আরে বাবা বাচ্চা না কাঁদলে এরা কেঁদে কি করবে? চিন্তার বিষয় হলো এর আগে আমার এই খালার বাচ্চা নিয়েছিলেন কিন্তু সে বাচ্চা বাঁচেনি। এই ভয়েই সবাই কাঁদছে কিনা বুঝতে পারছিনা ।

তবে বাচ্চার এই না কান্নার জন্যই কি এতগুলো মানুষ কান্না করেছে? আমি এর কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা গল্পের শুরুতে কাঁদি, অর্থাৎ জন্মের শুরুতে কাঁদি, গল্পের মাঝে কাঁদি আবার গল্পের শেষেও অবোধ শিশুর মতো কেঁদে উঠি। আমাদের এই কান্না শুধু আমাদের জন্য নয় আমাদের কান্না আমাদের পৃথিবীর জন্য। সমস্ত মানুষের জন্য। এই পৃথিবী এই মানুষ কেউ একদিন থাকবে না। আমাদের কান্না হয়তো এর জন্য। কান্নাকে আমরা খুব ভালোবাসি।

কারণ আমরা খুব বোকা। আমার এক সম্পাদক বন্ধু ফোন করে বলেছে একটা দুঃখের গল্প দিতে! কোথায় পাব দুঃখের গল্প? জানি না। কারণ গল্পের নিয়ম নীতি রোজ বদলায়।

কাকন। কাকন ভারী সুন্দরী একটি মেয়ে। মেয়েদের হাতের কেমন যেন এক প্রকার কোমলতা থাকে। চোখে কেমন মায়া থাকে। চোখে চোখে পড়লেই মনের ভিতর মোচর দিয়ে ওঠে। মেয়েদের শরীরের কেমন এক প্রকার গন্ধ থাকে। সে গন্ধ নাকে লাগলেই শিহরণ লাগে। সে শিহরণ অনুভব করা যায়। কারো কাছে বলা যায় না ।

রাজন প্রশ্ন করে—’তুই আমাকে ভালোবাসিস?

‘একটুখানি’ । এই একটুখানি ভালোবাসা যায়’?

কেন ভালোবাসা যায় না?

তুই কি এটাকে চিনি বা লবণ পেয়েছিস যে একটুখানি হাতে নিবি?

রাজন। সদ্য কৈশোর পেরনো এক ছেলে। কাকনের সাথে তার অন্তরঙ্গ ভাব। যাদুঘরের পুরনো তৈজসপত্র দেখে যেমন সে সময় কালের অনেক বিষয় জেনে নেওয়া যায়। কাকনের কাছ থেকেও তেমনি প্রাথমিক ধারনা হয়েছে রাজনের নারী সম্পর্কে। চোখের সামনে এমন আচারের লোভ আর কারো দেখে নি সে। কথাচ্ছলেই বুকের ওড়নাটা সরিয়ে ভাজ করে পড়ে নিত কাকন। তারপর বুক উঁচু করে পেছনের দিকে চুলগুলো বাঁধতে বাঁধতে বলতো-‘তুই এত টাকা কোথায় পাস, রোজ রোজ আমার জন্য আচার নিয়ে আসিস যে’?

রাজন আবিষ্কার করে কাকনকে। একা এক ঘরে। চারদিকে ঝুম ঝুম বৃষ্টির মধ্যে । ঘরে আর কেউ নেই। একা সে আর কাকন । কাছে কেউ নেই। পাশে কেউ নেই। এই মহাজগতে আর কেউ নেই।

রাজন কাকনকে ভালোবাসে ঠিক তার নিজের মতো করে। সন্ধ্যাকে যেমন ভালোবাসে ঝিঝি পোঁকা। আকাশকে ভালোবাসে যেমন তার চন্দ্রতারা। ফুলকে ভালোবাসে যেমন তার সৌরভ। ডালকে ভালোবাসে যেমন তার পাতা।

একদিন কাকন খপ করে রাজনের হাত ধরে বলে-‘তুই না পুরুষ মানুষ। কত দেখিস, কত জানিস, কত কি বুঝিস। আমার কথা কি কিছুই বুঝিস না’। কেন কাকন আজ দিশেহারা? কিসের ক্ষেভে? রাজন চুপ করে থাকে।

তারপরও রাজন তার জন্য ছটফট করে। কাকনের কথাগুলো রাজনের বুকে তাঁত বোনে।

কেমন যেন নিজের কাছে ধড়ফড় লাগে। হৃদয়ের কপাট খোলে, কপাট বন্ধ হয়। মুখে তার

কোন কথা বের হয় না।

কাকন’?

এই দুনিয়ার কোন কথা ভালো লাগে না রাজনের। ঘুমাতে গিয়ে মনে হলো তার ভীষণ জ্বর হয়েছে। সারা শরীর ভারী হয়ে গেছে। শরীরের তাপে তার বিছানার চাদর পুরে যাচ্ছে। তেষ্টায় তার গলা শুকিয়ে গেছে, এক ফোঁটা পানির জন্য ভিতরে হাহাকার বয়ে যাচ্ছে কিন্তু উঠে গিয়ে পানি খাবে এরকম শক্তি তার যেন নেই।

আসলে কাকনের ভিতরের কথাগুলোই তার কছে এই জ্বরের মতো মনে হলো। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর কোনো জ্বরের আলামতই পাওয়া যায় নি। রাজন বুঝলো এই তার মনের গোলমাল। এটা কাকনের মনের বিষয়। সকাল হতে না হতেই রাজন কাকনের আশায় বসে থাকে কাকন আসবে। কিন্তু কাকন আর আসে না। এক সময় সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে কাকনের বিয়ে।

আজ তার বর আসবে। তাদের বাড়িতে এই নিয়ে হুলুস্থুল।

কাকন কেন সেই দিন ঐ সব কথা বলেছে রাজন বুঝতে পারে। কোনভাবেই কাকনের সাথে তার দেখা করা সম্ভব না জেনেও রাজন কাকনের সাথে দেখা করে। দু’জনের মনের কথাগুলো বলে। তারপর তারা দু’জন মিলে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। আজ তারা নিজেদের খুশি মত হাঁটবে, কথা বলবে।

সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা দু’জন বেরিয়ে আসে। এদিকে কাকনের বিয়ের বরপক্ষের লোকজন আসতে শুরু করেছে। বাড়ির ভেতরেও বাইরে আলোময়। নতুন বর রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে ঐ বাড়িতে এতো আলো কেন? কে যেন বললো—’বাড়িতে মহা উৎসব তো, তাই’।

বরপক্ষের লোকজন বলাবলি করতে লাগল এতো চকচকে আলো কিসের? এই কান সেই কান করতে করতে সবার মধ্যে জানাজানি হলো আসল কথা। কাছে গিয়ে দেখতে পেল । দু’জন মানুষ জড়াজড়ি করে এক সাথে আগুনে পুড়ছে। তাদের পাশেই কেরোসিনের একটা কন্টেনার পড়ে আছে।

রাজন আর কাকনই যে পুড়ে যাচ্ছে তাই নয়, পুড়ে যাচ্ছে নতুন বরের হৃদয়। সে এই আশা করেই কি আজ এসেছিল? নাকি কারো কাছে সে শুনেছে এই গল্প ।

আসলেই মানুষ বোকা খুব বোকা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top