মিউজিয়াম অব সায়েন্স,দারুণ এক অভিজ্ঞতা – শাহানা সিরাজী
আমি জীবন শুরু করেছি সায়েন্স নিয়ে। কিন্তু আমাদের স্কুল সায়েন্স এর উপযুক্ত ছিলো না। কারণ না ছিলো ল্যাবরেটরি, না ছিলো শিক্ষা উপকরণ না ছিলো প্রকৃতার্থে শিক্ষক। বইগুলো ছিলো ব্যবহারিক ইকুইপমেন্ট না থাকায় “তারে নারে বন্ধুরে,কোমড়া কাটে ইন্দুরে” করতে করতে পাশ করেছি লেটার মার্ক্স নিয়ে। কারণ প্র্যাক্টিক্যালে ২৫ এর ভেতর ২৩ দিয়েছিলো! যাই হোক যা বলার জন্য এতো কথা তা হলো- দুনিয়াটা টিকেই আছে সায়েন্স এর উপর। যে দিন চাকা আবিষ্কার হলো মূলত সেদিনই পৃথিবী সভ্যতার দেখা পেল।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে চাকা আবিষ্কৃত হয়। শুরুতে কুমোরদের কাজে এটির ব্যবহার ছিলো। ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেয়া হয়েছে। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ নাগাদ চাকার ব্যবহার ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে। চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, যখন চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন হয়। তবে বারবিয়েরি-লো (২০০০) এর মতে আরো পূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের দিকে চীনে চাকার প্রচলন ছিলো।
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন সভ্যতায় চাকার ব্যবহার দেখা যায় না। তবে অলমেক ও অন্যান্য কিছু আমেরিকার সভ্যতার নিদর্শনের মধ্যে শিশুদের খেলনা হিসাবে চাকাযুক্ত গাড়ি পাওয়া গেছে। প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এসব খেলনাতে চাকার ব্যবহার থাকলেও আমেরিকার সভ্যতাগুলোতে যানবাহনের যন্ত্রাংশ হিসাবে চাকার প্রচলন ছিলো না।
প্রাচীন নুবিয়াতে চাকা ব্যবহার করা হতো মাটির হাড়ি ও পাত্র তৈরিতে, এবং পানি উত্তোলনে। নুবিয়ার পানি উত্তোলনে ব্যবহৃত চাকাগুলো ঘুরানো হতো গবাদিপশু দিয়ে। নুবিয়ার অধিবাসীরা মিশর থেকে আনা অশ্বচালিত রথ ব্যবহার করতো।
চাকা ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত সমতল বা মসৃন রাস্তা না থাকায় চাকার প্রচলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। যেসব এলাকায় রাস্তা ছিলোনা এবং অসমতল ভূমির উপর দিয়ে চলতে হয়েছে, সেসব এলাকায় চাকা-যুক্ত যানবাহনের বদলে মানুষের কিংবা পশুর পিঠে করে মাল বহন করা হতো। এমনকি বিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বের অনুন্নত এলাকাগুলোতে ভালো রাস্তাঘাটের অভাবে চাকাযুক্ত যানবাহনের ব্যবহার কম ছিলো।
শুরুতে চাকা নির্মাণ করা হতো কাঠের চাকতি দিয়ে, যার কেন্দ্রে অক্ষদণ্ডের জন্য একটি গর্ত করা হতো।
স্পোকযুক্ত চাকা অনেক পরে উদ্ভাবিত হয়। এই রকমের চাকার ব্যবহার গাড়ির ওজন কমিয়ে আনে, যার ফলে দ্রুতগতির বাহন তৈরি করা সম্ভব হয়। প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সমকালীন আন্দ্রোনভ সংস্কৃতিতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার পাওয়া যায়। এর অল্প পড়েই ককেসাস এলাকার অধিবাসীরা অশ্বচালিত বাহনে স্পোকযুক্ত চাকা ব্যবহার করে। মূলত যুদ্ধে ব্যবহৃত রথে এধরনের চাকা তারা ব্যবহার করতো।
এখান থেকে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার গ্রিক উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। চাকাযুক্ত বাহনের ব্যবহার গ্রিক সভ্যতার বিকাশে সহায়তা করে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দ নাগাদ কেল্টিকদের রথগুলোতে এমন চাকা ব্যবহার করা যেতো, যার পরিধি বরাবর লোহার বেষ্টনি দেয়া থাকতো। ফলে এ ধরনের চাকাগুলো অনেক মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হতো। স্পোকযুক্ত চাকা এভাবেই প্রায় অপরিবপর্তিত অবস্থাতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্যবহৃত হয়ে আসে। ১৮৭০ খ্রিঃ এর দিকে চাকায় নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার করা শুরু হয়।
সামগ্রিক ভাবে চাকার আবিষ্কার কেবল পরিবহন ব্যবস্থায় নয়, বরং প্রযুক্তির নানা দিকে নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চাকা ব্যবহার করে জল চক্র (পানি তোলার এবং পানি হতে শক্তি আহরণের চাকা), গিয়ার চাকা, চরকা, ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সাম্প্রতিক কালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপ, এবং টারবাইন—এর সবই চাকারই পরিবর্তিত রূপ।
চাকা অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে এবং কে তার আবিষ্কারক তা বলা যায়না এবং সেসব চাকা ছিল লোহার যা শুধু ওয়াগন নামের বাহনে কিংবা রেলগাড়ীতে ব্যবহার হত। এরপর ১৮৮৭ সালে স্কটিস নাগরিক জন বয়ড ডানলপ, তার ছেলের বাই সাইকেলের জন্য প্রথম টায়ার চাকা উদ্ভাবন করেন। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, যিশুখৃষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগে তথা আজ থেকে ৭০০০ বছরেরও বেশি আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় চাকা আবিষ্কৃত হয়।
মেসোপটেমিয়া হচ্ছে ইরাক অঞ্চলের প্রাচীন এক সভ্যতার নাম।
চাকা কাহিনী বলার একটা কারণ আছে। মিউজিয়াম অব সায়েন্স, বস্টন,ম্যাসাচুসেটস দেখতে গিয়েছিলাম। আমি আমার ছেলের পরিবার এবং আবার ভায়ের পরিবার।মোট দশ জনের টিম।সকালে নাস্তা করে বস্টন থেকেই যাত্রা করলাম।প্রথমবার বস্টন শহরে যাচ্ছি।
দুপাশের গাছ-পালার রঙেই আমি মুগ্ধ। আমার ছেলে হাসে। রঙ দেখে মুগ্ধ হলেও দুদিন বাদেই দেখবেন সব গাছ ন্যাড়া দাঁড়িয়ে আছে। সে ব্যাখ্যা করায় ব্যস্ত আমি ছবি তোলায়। বিশাল এক টানেলের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা প্যাঁচানো এক পথ। উপরে ট্রেন নিচে টানেল, আবার ফ্লাই ওভার। সে এক ঝমেলার ইঞ্জিনিয়ারিং! জানতে চাইলাম – এই শহরের প্ল্যানার কে? উনাকে আমাদের দেশ হলে একুশে পদক দিতো!
বস্টন শহরটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত অনুরাগ অনেক আগ থেকেই। ১৯৯১-৯২ সালে প্রথম হার্ভাড ইউনিভার্সিটির নাম শুনি। তখন থেকেই কেমন যেন মনে হতো ওখানে যদি পড়তে পারতাম! কিন্তু আমি গাঁয়ের মেয়ে, গাঁয়ে সে সব কালচার তখনো চর্চা শুরু হয়নি। কাউকে বলার মতোও কেউ ছিল না।
নিজের সন্তানদের ভেতর তা দেখতে পাওয়ার স্কোপ ছিলো। ছোট ছেলে চান্সও পেয়েছিলো।কিন্তু মহামারী করোনা তার ভাগ্যকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয় কিন্তু সে অনলাইনেই হার্ভাড ইউনিভার্সিটির সাথে কাজ করেছে, এখনো যোগাযোগ আছে। যাই হোক,সেই বস্টনে যাচ্ছি। পৃথিবী বিখ্যাত মিউজিয়াম
কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। আমার ছেলে বকবক করেই যাচ্ছে, বস্টন আমেরিকার একটি পুরাতন পৌরসভা, এটি ১৬৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমেরিকান রেভ্যুলেশনের সময় বস্টনে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে -বস্টন গণহত্যা, বস্টন টি পার্টি,ওল্ড নর্থ চার্চে পল রেভারের লণ্ঠন সংকেত ঝুলানো, বাঙ্কার হিলের যুদ্ধ এবং বোস্টনের অবরোধসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গ্রেট ব্রিটেন থেকে আমেরিকার স্বাধীনতার পর, বস্টন -একটি বন্দর, উৎপাদন কেন্দ্র এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভূমি পুনরুদ্ধার এবং পৌরসভা সংযুক্তির মাধ্যমে শহরটি মূল উপদ্বীপের বাইরে বিস্তৃত হয়েছে। এটি এখন অনেক পর্যটকদের আকর্ষণ করে, শুধুমাত্র ফ্যানুইল হল প্রতি বছর ২০ মিলিয়নেরও বেশি দর্শক আকর্ষণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পাবলিক পার্ক (বোস্টন কমন, ১৬৩৪, প্রথম পাবলিক স্কুল (বোস্টন ল্যাটিন স্কুল, ১৬৩৫),প্রথম পাতাল রেল ব্যবস্থা (ট্রেমন্ট স্ট্রিট পাতাল রেল, ১৮৯৭), এবং প্রথম বড় পাবলিক লাইব্রেরি (বোস্টন পাবলিক লাইব্রেরি, ১৮৪৮)।
২১ শতকে, বোস্টন উচ্চ শিক্ষা এবং একাডেমিক গবেষণায় বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বে চলে আসে। গ্রেটার বোস্টনের অনেক কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে রয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমআইটি, উভয়ই প্রতিবেশী কেমব্রিজে অবস্থিত এবং অপ্রতিরোধ্য ভাবে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ র্যাঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সেরা।
বস্টন বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আইন, চিকিৎসা, প্রকৌশল এবং ব্যবসায় শীর্ষে। প্রায় ৫০০০ স্টার্টআপ কোম্পানির সাথে, শহরটিকে উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা,এবং সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অগ্রগামী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বোস্টনের অর্থনৈতিক ভিত্তির মধ্যে রয়েছে অর্থ, পেশাদার এবং ব্যবসায়িক পরিষেবা, জৈবপ্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি, এবং সরকারী কার্যক্রম। টেকসই পরিবেশ এবং নতুন বিনিয়োগের জন্য বোস্টন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের শীর্ষে রয়েছে।
মোটের উপর বস্টন একটি এডুকেশনাল হাব হিসেবে বিবেচিত।
কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনছি অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কারণ আমার ছেলের সাথে আমার সাত/আট বছর পরে দেখা। এ সময়ের ভেতর তার চিন্তা ভাবনা প্রকাশভঙ্গী সবই চেইঞ্জ। দেখতে দেখতে মিউজিয়ামের পার্কে প্রবেশ করলাম। পার্ক তিনতলা বিশিষ্ট। আমার ছেলে তিনতলায় উঠেই পার্ক পেয়েছে। পার্কিং এর জন্য আগেই টাকা দিতে হল।গাড়ি থেকে নেমে আমি হা করে তাকিয়ে আছি। ভিজিটরেরা আসছে যাচ্ছে।
একজোড়া নারী পুরুষকে দেখলাম জড়িয়ে ধরেই চুমু খাচ্ছে। আমার চোখ আমেরিকাকে ইগনোর করে আমাদের দেশে চলে এসেছে। আমার ছেলে আমাকে বললো,আম্মু তাকাবেন না। আমি তো তাকাইনি,কিছু মনেও করিনি। আমার দাদু ইনারা আমাকে হাত ধরে ধরে এগিয়ে চলছে। সে এখানে আগেও এসেছে।
এখানে তার ভালো লাগে। নোরাহ কান্নাকাটি করছে ইতিমধ্যে ভায়ের গাড়িও পৌঁছে গিয়েছে। জান্নাত, সামিরা, সাদি, সাবিত, সাফির, ইনারা নোরাহ, আমি, শবনম আমার ছেলে এবং ভাই দল বেঁধেই চললাম। টিকেট আগেই অপু কিনেছে অনলাইন থেকে। বাসায় দিয়ে গেছে।
সভ্যতার শুরু চাকা দিয়ে আগেই বলেছি সেখান থেকে বর্তমান আর্টিফিশিয়াল এন্টিলিজেন্স সবই সেখানে সাজানো। শুধু সাজানো নয় এক্টিভিটি আছে। কোন যন্ত্র কী ভাবে কাজ করে সব। আমাদের বাচ্চারা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইনারা-সাদি সমবয়সী। তাদের ভাব বেশি। নোরাহ সামিরাকে এতো পছন্দ করেছে যে তার কোলে কোলেই আছে। সাফিরকে নিয়ে তার মা জান্নাত একটা জায়গায় বসেছে।
সাফির খেলছে। আমার ভাইও তাদের সাথে রয়েছে। আমি দেখছি আর ভাবছি – এমন একটি প্রতিষ্ঠান যে দেশে আছে সে দেশের শিশুরা বিজ্ঞানের প্রতি, প্রযুক্তির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না!
একটা বল লিভারের মাধ্যমে কী ভাবে বাঁধা অতিক্রম করছে, নিউটনের গতিসূত্র সেখানে হাতে-কলমে দেখানো হয়েছে। প্লেন কী ভাবে উড়ে, শক্তি কী ভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে,
চাকার প্রাথমিক থেকে বর্তমান অবস্থা, বিশাল অবস্থা সৌরজগত। এক দিকে সূর্য অন্যদিকে তার গ্রহগুলোর অবস্থান,নিহারিকা,ধুমকেতু,গ্যালাক্সি বিশাল হল রুমে দেখানো হয়েছে। আলো-আঁধারির একটা এনভায়রনমেন্ট।
নীল আর্ম স্ট্রং এর চন্দ্রযান রাখা আছে। গায়ে বড় বড় করে লেখা United States, মার্কিন পতাকা আঁকা। অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। আমরা ছোটবেলায় সমাজ বই এ পড়েছি কে কে চন্দ্র অভিযানে গিয়েছেন, প্রথম চাঁদের পিঠে অবতরণের সেই মুগ্ধ কাহিনী। আজ কত কাছ থেকে দেখছি সেই চন্দ্রযান। আমার ছেলেই আমাকে দেখালো।
এই মিউজিয়ামের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন কোম্পানী স্পন্সর করেছে। একটি অংশ আমার ছেলে ও বউমা‘র কোম্পানী ম্যাথ ওর্য়াক স্পন্সর করেছে। তারা আমাকে দেখালো। নিয়ে গেলো। প্রতিটি ইভেন্ট এর কাছে একজন করে লোক নিয়োগ করা। না বুঝলে তারা বুঝিয়ে বলছে। শিশুদের আনন্দকে তারা একধাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নোরাহ এখানে বেশ ভালো আছে। কারণ সে একটিভিটি পছন্দ করে । এখানে তাকে বিজি রাখার ইভেন্ট রয়েছে। তবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া তার জন্য ভীষণ মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইনারাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সেও সেখানেই যাচ্ছে সবগুলো ইভেন্ট এ হাত লাগাচ্ছে। প্লেনে প্রাথমিক অবস্থা হতে বর্তমান অবস্থায় কীভাবে এলো , সে বার বার ট্রাই করছে। প্রতিবারই সে আরো বেশি উপরে নিতে পারলো তার লক্ষ্য বস্তু।
আমেরিকার প্রথম রকেট। তারপর কী ভাবে বিবর্তন হলো।
এক জায়গায় Particle Mirror দেয়া অনেক বলের ভেতর প্রতিকৃতি ভেসে ওঠে। দারুণ! আমি নিজেই ওখান থেকে সরতে পারছিলাম না।
আর এক জায়গায় একজন থাকে বৃত্তের ভেতর অন্য জন বাইরে থেকে মেশিনের ডিরেকশন অনুযায়ী ডিকটেশন দিচ্ছে সেখানে সামিরা মাঠে নেমেছে, তার মা ডিকটেশন দিয়েছে , সে বাঁধা পেরিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে পেরেছে। এটা এক ধরণের শিক্ষাও। কোণায় কোণায় রোগব্যাধি হতে কত সহজেই মুক্তি পেতে পারি, আপেল থেকেই কী ভাবে জুস হচ্ছে আবার কী ভাবে কম্পোস্ট হচ্ছে তা দেখানো হচ্ছে।
আমাদের দেশের মিউজিয়ামে কেবল দেখি, না ছোঁয়ার আদেশ দেয়া । তাই এই মিউজিয়াম দেখে মন ভালো হওয়ার সাথে সাথে খারাপও হয়েছে। আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকেরা তো হামেশাই উন্নত বিশ্ব ঘুরে, তাঁরা এ রকম কোন উদ্যোগ কেন নেয় না। যদি বলে টাকা নেই তা বিশ্বাস করি না। কারণ সবারই সম্পদের পরিসীমা বেড়ে যায় কিন্তু জাতির উন্নতি হয় না! খুব লজ্জা লাগছিলো। আমরাও মানুষ তারাও মানুষ অথচ তাদের শিশুদেরকে শেখানোর জন্য কত সহজ কত জয়ফুল আয়োজন করে রেখেছে।
একদিকে দেখছে কী ভাবে বিশ্ব আজকের অবস্থায় এসেছে, আটিফিশিয়াল ইন্টিলিটজেন্স কী ভাবে এলো, কী ভাবে কাজ করছে, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, শুক্রগ্রহ সকালে বিকালে নাম পাল্টায় কেন-মহাকাশ, মহাবিশ্ব শিশুদের সামনে জ্বলজ্বল করছে। আমার নাতনী ইনারা মহাখুশি।
এক জায়গায় লেখা Build your own museum . শিশুরা নিজেরাই নিজেদের মিউজিয়াম তৈরি করছে। দারুণ না!
আরেক জায়গায় লেখা Program & Collect তার উল্টা পাশে লেখা Engineering Design workshop . নানান যন্ত্রপাতি। এবার যাও নিজেরা দেখাও নিজেদের কাজ। এটাও খেলার ছলে। আবার শেখাচ্ছে Engineering for reuse .
নিচ থেকে তিনতলা পর্যত বিশাল এক বাঁধা-অতিক্রম আঁকা-বাঁকা পথ। বল কী বাঁধ পেরিয়ে উপর থেকে নিচে নামছে আবার নিচ থেকে উপরে যাচ্ছে দেখানো হয়েছে। এই পথ বেয়ে উপরে ওঠা যায়। কিন্তু তা কঠিন। ইনারা আর সাদী কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। আমি উঠতে দিলাম না। বাপ রে! যদি পড়ে যায়!
এক পাশে আবার বিভিন্ন জীবজন্তু কী ভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকে তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, মথ, মথ থেকে প্রজাপতির জীবন, অনেক ছাত্র -ছাত্রী দেখলাম, দেখছে আর লিখছে।
আমি ভাবছি আমরা তো মুখস্ত করাই এরা দেখে শুনে বুঝে প্রজেক্ট করে শিখে।
এরই মাঝে নোরাহ প্রাকৃতিক কাজ সেরে দিয়েছে। তার মা তাকে নিয়ে ব্যস্ত। আমরা লিফটের সামনে। আমি চিন্তাশূন্য অপদার্থের মতো তাকিয়ে আছি আমার ছেলে- ভাই, তারা কখন আসবে! কোন দিকে যাবো! সময়ের অভাবে তিনতলা পর্যন্ত যেতে পারিনি।
আমরা এবার খাবারের সন্ধানে গেলাম।
হায়! হায়! তেমন খাবার নেই। কাউন্টার ক্লোজ। বিশাল সাইজের সাগর কলা, কেক আর কফি মিললো যার কোনটাই আমার খাবারের উপযুক্ত নয়।
আমার নাতনী ইনারা এসেই আমাকে সতর্ক করছে করছে,all are sungari food. তুমি খেয়ো না,মরে যাবে! তার বাংলা একেবারেই বিশুদ্ধ। আমার জন্য তার চিন্তার অন্ত নেই। তাকে বুঝিয়ে বললাম, খুব সামান্য খাবার এখন আমার প্রয়োজন।কারণ আমরা রেস্টুরেন্টে যেতে সময় লাগবে। তাতে সুগার ফল করতে পারে! আমি একটু খানি কেক ভেঙে খেলাম, সে অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো, তার দাদী সুগারিফুড খাচ্ছে!
এরই মাঝে এনাউন্স হচ্ছে,” পাঁচটা বেজে গিয়েছে, সবাইকে বের হবার অনুরোধ করছি। ”
বের হবার সময় লাগলো বিপত্তি। সে যে পথে প্রবেশ করেছি সে পথেই হাঁটা শুরু করলো। সে ছিলো আমার হাতেই ছিলো। গাড়ি নিয়ে আমার ছেলে এবং ভাই নিচতলায় রাস্তার পাশে চলে আসবে, আমরা নিচতলা থেকেই এক্সিট করবো। কিন্তু দরজা এক হাত দিয়ে কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না। তাই দুহাত লাগালাম। মুহূর্তেই সে অন্যদিকে চলে গেলো। আসলে সে দেখছিলো আর দেখছিলো। দেখতে দেখতেই এগিয়ে গিয়েছে।
দরজা খোলার সাথে সাথে দূরে অপু আর খসরুকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, সাবিত-সাদী তাদের বাবাকে দেখে এক দৌড় দিলো।
ইনারা কোথায়? ওকে দেখা যাচ্ছে না। সাদীর সাথে গেলো কি না তাকাচ্ছিলাম, পেলাম না। নোরাহ হাতেই আছে। শবনম ভেতরের দিকে এক দৌড় দিলো, দেখতে পেলো ইনারা সামনের দিকেই হাঁটছে। বাঁক পেরোলেই তাকে খুঁজে পেতে অনেক ঝামেলা হতো। যদি আমেরিকার সিস্টেমে শিশু হারানোর সুযোগ নেই। যার সন্তান হোক তাদের কাছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক। তারা শিশুদের খুব ভালোবাসে। তথাপিও নানান হেসেল তো হতোই!
এ জন্য আমার ছেলে এবং বউ তাকে প্রচন্ড বকাঝকা করেছে। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। সে বার বার বলার চেষ্টা করেছে, I have something to tell you. কিন্তু বাবা- মা তার কথা শোনেইনি। সে কাঁদতে কাঁদতে অধীর হয়েছে। তার কান্না দেখে সারাদিনের সব আনন্দই যেন মাটি হয়ে গেলো। অবশেষে তাদেরকে বললাম, তোমরা আমাকে বকা দাও, ভুল তো আমারই হয়েছে। সেতো আমার হাতেই ছিলো।
ইনারার সাথে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করা হয় যেন সে বড় মানুষ। তার মনটা তুলোর মতো। অল্পতেই দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কাউকে কিছুই বলে না, চুপচাপ কাঁদতে থাকে।
পরে ভাবলাম, আমি তো দাদী,তাদের সন্তান তারা তো টেন্স হবেই। কিন্তু কষ্টটা আমার কলিজায় গেঁথে আছে। দেশে থাকলে আমি হয়তো চাকুরিই ছেড়ে দিতাম। চাকুরি করি পরিবারের জন্য। আমার সন্তানেরা বড় হয়েছে, আয় রোজগার করে, আমার কেন আরো চাকুরি লাগবে! কিন্তু ওদেশের সিস্টেমের সাথে আমি মানিয়ে চলা আমার জন্য কঠিন। তাই বুকটা পাথর বানিয়ে চলে এলাম!
এরপর গেলাম রেস্টুরেন্টে। পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট। মালিক পাকিস্তানি এক মহিলা।
মনে মনে বিরক্ত হলাম, এরাই আমাদেরকে বঞ্চিত করেছে, আমরা এদের সাথেই যুদ্ধ করেছি। আমাদের দেশকে পঙ্গু এরাই বানিয়েছে। তারপর ভাবলাম, এ দেশে আমরা যা তারাও তা বাঁচার সংগ্রাম করছে। মহিলার সাথে কথা বললাম। তারা তিন বন্ধু মিলে রেস্টুরেন্টটি চালায়। আমাদের দেশ বন্যায় ডুবে যায়, ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেয়া হয় ইত্যাদি সমস্যা মহিলা বেশ ভালো জানে। পেশায় সাংবাদিক আবার। তিন বন্ধুর একজন আলজেরিয়ার, একজন ইতালির। তারা কথা বলছিলো। মহিলা আগেই আমাকে সালাম দেয়ায় আমিও এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম।
তারপর হইহই করে সবাই মিলে খেলাম। বাসায় ফিরে আসলাম। সে রাতেই আমার ভায়েরা নিউইয়র্ক ফিরে গেলো। মনটা খারাপ হলেও মেনেই নিতে হবে। মেনেই নিলাম।
ইনারা-নোরাহ আমার ভায়ের ছেলে মেয়ে মিলে দুদিন যেন চাঁদের হাট বসিয়ে ছিলো। এই ট্রিপের যাবতীয় ব্যয় আমার ছেলেই বহন করেছে। মা হিসেবে নিজেকে অনেক সার্থক মনে হয়েছে।
শাহানা সিরাজী
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।