মিষ্টি কুমড়ো ও হ্যালোইন – শাহানা সিরাজী

Picsart_23-11-05_08-24-38-631.jpg

মিষ্টি কুমড়ো ও হ্যালোইন – শাহানা সিরাজী

আমার আব্বা নিজের জীবনের একটা গল্প শুনিয়েছেন। গল্পটি হলো, দাদাজান আব্বাকে অনেক ছোট রেখেই মারা যান। দাদীজানের স্ট্রাগল আব্বাকে নিয়ে। আমার দাদীজান একই বছর স্বামী ও চার সন্তান হারিয়ে প্রায় পাগলিনীর বেশে ছিলেন। একমাত্র পুত্র আব্বাকে আঁকড়ে জীবনের দুই তৃতীয়াংশ বিধবা থেকেই ইন্তেকাল করেছেন। আব্বা তখন মাদ্রাসায় পড়তেন।

মাদ্রাসার কাছেই লজিং থাকতেন। বাড়িতে এসেছেন মাকে দেখতে। মা রান্না করেছেন চিংড়ি মাছ দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো। আমার আব্বা খাবে না বলে চলে গেলেন। লজিং বাড়িতে গিয়েও পেলেন মিষ্টি কুমড়াই কিন্তু চিংড়িমাছ ছাড়া কেবল পোড়া মরিচ দেয়া!

আব্বার সেই মিষ্টি কুমড়ো আমার বাসায় আমি কদাচিৎ রান্না করি। করলেও সেই রকম আয়োজন করেই করি। না হয় বাসায় কেউ খেতে চায় না।

বস্টন শহরে পা দিয়েই চমকে উঠলাম। সব বাড়ির সামনে মিষ্টি কুমড়ো,তাতে মুখোশ আঁকা, নানান রঙে ঢঙে সাজানো।
ইনারার স্কুলে ফল-ফেস্টিবলে গেলাম, ওমা সবার হাতে হাতে মিষ্টি কুমড়ো, ছোট, মাঝারি,বড়। এমন কী ইভেন্টও একটা ছিলো কে কতো ফাস্ট মিষ্টি কুমড়ো গড়িয়ে এ পাশ থেকে ওপাশ নিতে পারে।

ছেলে আপেল বাগানে নিয়ে গেলো। সেখানেই মিষ্টিকুমড়োর মাতামাতি। থরে থরে সাজানো। আমার ছেলে কিনতে চাইলো। আমি নিষেধ করলাম।এতো বড় কুমড়ো কিনে কয়দিনে খাবে,তারা দুজন মানুষ। আমাদের দেশে তরমুজের দিনে,ফুটি বাঙ্গীর দিনে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাবার পথে যেমন সাজানো থাকে ঠিক তেমনিভাবেই মিষ্টিকুমড়ো সাজানো।

আমাদের নবান্ন নিয়ে যেমন উৎসব আয়োজন হত তেমনই পামকিন তোলা নিয়েও এখানে একই রকম আয়োজন। কারণ এটা সিজন। হারভেস্টিং এর সময়। অক্টোবরের পরই শুরু হয় ঠান্ডা। সব গাছ মারা যায়। তার আগেই তারা উৎসবমুখর পরিবেশে “ফল-ফেস্টিভল” পালন করে। ছেলেরে জিজ্ঞেস করলাম এতো মিষ্টি কুমড়ো কেন? সে বললো,সামনে “হ্যালোইন”।

ফল-ফেস্টভলই “হ্যালোইন”।

হ্যালোইন কী, কেন পালিত হয় এ উৎসব?
প্রতি বছরের ৩১ অক্টোবর পালিত হয় ঐতিহ্যবাহী হ্যালোইন উৎসব। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বর্তমানে পালিত হয় দিবসটি। তবে পশ্চিমা বিশ্বে জাঁকজমকতার সঙ্গে পালন করা হয় হ্যালোইন।

জানলে অবাক হবেন, এই ভুতুড়ে উৎসবের ইতিহাস ২০০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। অনেকেই ভাবেন, এ দিনটি হয়তো ভূতের মতো সাজতেই পালন করা হয়। আসলে মৃত আত্মাদের স্মরণে পালন করা হয় দিনটি।

হ্যালোইন শব্দের উৎপত্তি ১৭৪৫ সালের দিকে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে এর উৎপত্তি। হ্যালোইন’ বা ‘হ্যালোউইন’ শব্দটি এসেছে স্কটিশ ভাষার শব্দ ‘অল হ্যালোজ’ ইভ থেকে। হ্যালোইন শব্দের অর্থ ‘শোধিত সন্ধ্যা বা পবিত্র সন্ধ্যা’।

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে ‘হ্যালোজ’ ইভ’ শব্দটি এক সময় ‘হ্যালোইন’এ রূপান্তরিত হয়। হ্যালোইন উৎসবের মূল থিম হলো, ‘হাস্যরস ও উপহাসের মাধ্যমে মৃত্যুর ক্ষমতার মুখমুখি হওয়া’।

প্রায় ২০০০ বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করতো কেল্টিক জাতি। নভেম্বরের প্রথম দিনটি তারা নববর্ষ বা ‘সাহ-উইন’ হিসেবে পালন করতো। গ্রীষ্মের শেষ ও অন্ধকার বা শীতের শুরু বলে মনে করতো তারা।

অবাক করা বিষয় হলো, কেল্টিক জাতির ধারণা ছিলো অক্টোবরের শেষ দিনের রাত সবচেয়ে খারাপ। যে রাতে সব প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মারা মানুষের ক্ষতি করতে পারে। আর তাই কেল্টিক জাতির সদস্যরা এই রাতে বিভিন্ন ধরনের ভূতের মুখোশ ও কাপড় পরতো।

তারা নির্ঘুম রাত কাটাতে আগুন জ্বালিয়ে মুখোশ পরে বৃত্তাকারে একসঙ্গে ঘুরতেন ও মন্ত্র যপতেন। আর সময়ের পরিক্রমায় কেল্টিক জাতির ‘সাহ-উইন’ উৎসবই বর্তমানে ‘হ্যালোইন’ উৎসব হিসেবে পালিত হচ্ছে। হ্যালোইনের রাত নিয়ে অনেক ধরনের মিথ আছে।

তেমনই এক প্রচলিত মিথ হলো, এই রাতে দেবতা সামান সব মৃত আত্মাদের পৃথিবীতে আহ্বান জানান। উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোইন ডাইনি উড়ে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। কখনো বা তিনি কড়া নাড়েন বিভিন্ন বাড়ির দরজায়।

কবে থেকে শুরু হয়েছে হ্যালোইন?

জানা যায়, মধ্যযুগ থেকেই হ্যালোইন উৎসব পালিত হয়ে আসছে। আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ডের উচ্চ ভূমি ও ফ্রান্সের উওর অংশ জুড়ে তখন কেল্টিক সভ্যতার বিস্তার ছিলো। প্রাচীন কেল্টদের পালিত ‘সাহ উইন’ উৎসব থেকেই মূলত হ্যালোইনের সূত্রপাত।

১৮০০ দশকের শেষের দিকে আমেরিকায় হ্যালোইন ছুটির দিনে পরিণত হয়। শতাব্দীর শুরুতেই শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক সবাই ঘটা করে হ্যালোইন উদযাপন শুরু করে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, মৌসুমী খাবার ও উৎসবমুখর পোশাক পরা হতো।

বর্তমানেও হ্যালোইন পালন করা নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় মাতামাতির শেষ নেই। রাতটি উদযাপন করতে সেখানে প্রস্তুতি চলে মাসজুড়েই। এ ছাড়াও কানাডা, আয়ারল্যান্ড, পুয়ের্তো রিকোসহ এশিয়ার জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডেও হ্যালোইন পালিত হয়। এমনকি বাংলাদেশেও পালিত হয় হ্যালোইন উৎসব।

এই উৎসবে হ্যালোইন পোশাক পরে পার্টিতে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে কুমড়ো খোদাই করা, মুখোশ পরা, ভয় দেখানো, ভুতুড়ে গল্প বলা, ভৌতিক সিনেমা দেখা ও ভুতুড়ে সাজসজ্জায় সবাই ব্যস্ত থাকে।
(তথ্যসূত্র ইন্টারনেট)

এ দিনে স্কুলে শিক্ষার্থীরা নানান সাজে সজ্জিত হয়ে স্কুলে যায়, প্রতিবেশীদের দরজায় নক করে, চকলেট দেয় নেয়, মুখোশ পরে, আনন্দ উৎসবে মুখরিত থাকে।

ইনারার স্কুল থেকে বলা হলো তিন ধরণের খাবার স্কুল টিফিনে দেয়ার জন্য। এটাই তার জন্য সারপ্রাইজ খাবার। সুন্দর পোশাক পরার বলা হলো। হ্যালোইনের আদি বৈশিষ্ট্য এখন আছে কি না জানি না তবে একে ঘিরে ব্যস্ত জীবনে খানিকটা আনন্দঘন সময় কাটাতে অনেকেই ভালোবাসে। গোড়া ধার্মিকেরা হ্যালোইন পালন করে না। আমাদের পহেলা বৈশাখের মতো ফসলতোলাকে ঘিরে হইচই একটি অনুষ্ঠান এখানেও কারো কাছে পাপের কারো কাছে আনন্দের!

আসলে মানুষ তো আদমের তৃতীয় সন্তান শীষ (আ) এর বংশধর৷ রুট এক জায়গায়। নানান মতাদর্শে বিভাজিত হলেও জীবন-যাপন,বিশ্বাস-অবিশ্বাস সব কিছুতেই উত্তরমেরু দক্ষিণ মেরুতে একই রকম।

কেউ কেউ আইনের প্রয়োগের জন্য খুব নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে। কেউ কেউ স্বেচ্ছাচারী! ইন্ডিয়ান সাব কন্টেন্ট এর মানুষগুলো এখানে এসে মাইনকাচিপায় আঁটকা। না পারে বোয়ালের মতো হা করতে না পারে শোলের মতো লাফ দিতে।

এরাই নিজেদের সংস্কৃতি হারিয়ে অরিজিনাল শ্বেতাঙ্গদের না বুঝে আমাদের মতো হাওয়াই মিঠাই খাওয়াদের হইহই রই রই গ্রহণ করে টিকে আছে জাস্ট।

এখানে অনেক স্বাধীনতা আছে এটা ঠিক, বনেদি শ্বেতাঙ্গরা ঠিকই তাদের ঐতিহ্য পোশাকে আশাকে ধরে রেখেছে।

এখানে মানুষ শ্রমের মর্যাদা দেয়, যে কাজই করুক মানুষ মানুষের মর্যাদা মানুষের মতোই- এ কারণেই আমরা রাফ এন্ড টাফ হওয়া সত্ত্বেও এখানে টিকে আছি। রাস্তায় বের হলেই বোঝা যায় আমাদের তাকানোই জটিল প্রকৃতির।
আমাদের দেশে যদি হঠকারিতা না থাকতো, বাটপার না থাকতো!

শাহানা সিরাজী
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন।

ঘুরে এলাম স্ট্যাচু অব লিবার্টি – শাহানা সিরাজী

আরও পড়ুন।

পরদেশ – শাহানা সিরাজী

আরও পড়ুন।

ভালোবাসার গল্প – শাহানা সিরাজী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top