ভালোবাসার গল্প – শাহানা সিরাজী

Picsart_22-11-11_04-36-11-035.jpg

ভালোবাসার গল্প

আজ পহেলা ফাল্গুন
আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।

সকাল থেকেই মনের ভেতর নানান জল্পনা কল্পনা চলছে-রুনুর বাপটা একেবারেই বেরসিক। কখনোই অনুরাগের চোখে তাকায় না, মিষ্টি করে কথা বলে না। রুটিন মাফিক চলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা। বেড়াতে নিয়ে যায় না, কখনো কোন কাজের প্রশংসা করে না,
চুপি চুপি অনেক কেঁদেছি,এ কেমন মানুষ! টাইমলি খাওয়া,নাওয়া অফিসে যাওয়া সবই হয় কিন্তু আমার সাথে দুদন্ড আলাপ করে না।
এসব ভাবছি আর মনটা বিষিয়ে উঠছে। ইস, আজ হয়তো এক গুচ্ছ ফুল এনে ডাকবে,কই গো রুনুর মা, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। হয়তো জড়িয়ে ধরবে, আলতো চুমু দেবে, কাছে টানবে।
হয়তো গাঢ় চোখে তাকাবে – ভাবছি আর রান্না করছি, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো রুনুর বাবার ফেরার সময় হলো…

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। হাঁটুর ব্যথা ভুলে দৌড় দিলাম দরজা খুলতে। দরজা খোলার সাথে সাথেই সেই গুরুগম্ভীর মুখ, সেই প্রতিদিনের চেনা অভিব্যক্তি! একটি ঠোঙা হাতে দিয়ে সোজা ভেতরে চলে গেলো। আমি জানি এখন ফ্রেশ হবে। তারপর টেবিলে এসে বসবে। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে। এর মাঝে খাবার সার্ভ করলে খাবে নচেৎ উঠে যাবে। সটান বিছানায় যাবে। কিছুক্ষণের ভেতর নাক ডাকবে।
এবার ঠোঙাটি খুললাম, ভেতরে কয়েক পিস জিলাপি হাসছে।
মুহূর্তেই ছেচল্লিশ বছর পেছনে চলে গেলাম।
তখন আমাদের শৈশব। মানে নতুন বিয়ে হয়েছে। রুনুর বাবা আমাকে নিয়ে মেলায় গিয়েছে। সেই মেলায় আমাকে সে হারিয়ে ফেলে। পরে যখন খুঁজে পেলো তখন দেখা গেলো আমি মেলার কোণার দোকানে জিলাপি খাওয়ায় ব্যস্ত। রুনুর বাবা আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর কষে একটা চড় মারলো। চড়ের চোটে আমার মুখ থেকে জিলাপির ক্ষতবিক্ষত টুকরো বেরিয়ে পড়লো। রুনুর বাবা সেদিকে একবার তাকালো আর একবার আমার দিকে দিকে তাকালো। এক মুহূর্ত কী ভাবলো জানি না,দোকানের সব জিলাপি ব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে এলো। সারাপথ আমি কাঁদলাম, রুনুর বাবা চুপচাপ বসে ছিলো।
বাসায় ফিরে আমি আম্মার সাথে মিশে গেলাম, রান্না-বান্না ইত্যাদি ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত রইলাম,বাবার কাপড় কাচা, বাবার সাথে খুনসুটি করর সারাবেলা কেটে গেলো। রাতে সবাই যখন যার যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়লো,আমি তখন ড্রইং রুমে। কতক্ষণ আর থাকা যায়!
লঘু পায়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলাম। দেখি রুনুর বাবা বই এ ডুবে আছে। পাশের টেবিলে প্লেটে কয়েকটি জিলাপি আমাকে ডাকছে।
আমার সাড়া পেয়ে সেদিন রুনুর বাবা কেমন যেন নীল হয়ে গেলো। দ্রুত লাইট অফ করে দিয়ে আমার হাতটি ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকলো। অন্ধকারে আমার মুখে জিলাপি ধরিয়ে হুহু কাঁদলো। সেদিনও মুখে কোন কথা ছিলো না কিন্তু আশ্বিনের ঝড়ের মতো চারদিকে পাতা ঝরার শব্দহলো, মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ আমাকে দিশাহারা করে তুলেছিলো, তারপর কোমল শ্রাবণধারায় স্নান করিয়ে আমাকে নিয়ে গেলো অমরাবতীর রুদ্ধদ্বারে, হীরকখচিত দ্বার খুলে বললো, আর কখনো হারিয়ে যেতে দেবো না।
সেই থেকে ছেচল্লিশ বছর রোজ সন্ধ্যায় একটি ঠোঙা আমার বিছানার পাশে স্থান করে নিয়েছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার পর তার অনেক মন খারাপ হয়েছিলো। ডাক্তার বললো, অল্প খেলে সমস্যা নেই। আহা! সেদিন রুনুর বাবার মুখ থেকে কেমন মেঘ কেটে গেলো!

হঠাৎ মনে হলো, যে মানুষটি ছেচল্লিশ বছর আমার আবেগকে লালন করে আসছে সযতনে সে যদি আজ ফুল না এনে জিলাপি আনে,যদি মেকি হাসিতে কথা না বলে তবে কী ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে? নাইবা বললো ইতিসপিতিস কথা!
কোন পুরুষ আছে এমন করে তার স্ত্রীর একটি পছন্দকে এতোকাল লালন পালন করে!
ডাইনিং টেবিলে বোধ হয় আসছে, যাই। আজ তার পছন্দের রেসিপি বাইমমাছের দোপেয়াজা রান্না করেছি সাথে ঘন ডাল আর লালচালের নরম ভাত। শুকনোমরিচ পুড়ে টমেটোর ভর্তা বানাতে ভুল করিনি।

প্রতিদিনের মতো আজও পরম তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে বললো, কেন যে কম খেতে পারি না!
টাওয়েলটা এগিয়ে দিয়ে চেয়ে রইলাম,বললো, অর্ধেক জিলাপি খেলেই চলবে-মাথা ঝেঁকে সায় দিলাম আচ্ছা।

দুঘন্টা টিভি দেখবে তারপর লাইটফ হবে
অমরাবতীর রুদ্ধদ্বারে আজো আমি বন্দি….

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর সাধারণ
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top