আহমদ ছফাঃ তাত্ত্বিক ও চিন্তক – ওমর ফারুক
রাষ্ট্রের অনেকগুলো চোখ থাকে। কবি, কথাসাহিত্যিক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সমালোচক রাষ্ট্রের, সমাজের এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্দেশ করেন, রাষ্ট্রের জন্য চোখ হিসেবে কাজ করেন।আমাদের ভাষা,শিক্ষা-সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধ কোন পথে চালিত হবে, এর গতিপথ কেমন হবে এনিয়ে দীর্ঘ বির্তক রয়েছে।এ অঞ্চলে স্বাধীনতা সংগ্রাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইতিহাস । একে ঘটনা বললে সবটা বলা হয় না।অনেকে আবার গণ্ডগোল বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।সমাজ,রাষ্ট্র সঠিক পথের সন্ধান পায় মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা। এরা পথ সৃষ্টি করেন, পথ দেখান।আমাদের এ ভূখণ্ডে পথ দেখানো ভূমিপুত্র হলেন আহমদ ছফা। ১৯৭১ এর ঘটনাকে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে দেখেননি। পাকিস্তান রাষ্ট্র যে টিকছে না, বাংলাদেশ নামক একটি নয়া রাষ্ট্রের উদ্ভব হতে যাচ্ছে, এ সত্য তিনিই প্রথম অনুধাবন করেন।ডঃ আহমদ শরীফ এবং তিনি ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “লেখক শিবির “। অনেকগুলো লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে তাঁর লেখক শিবির প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়েই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রটি টিকছে না।তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ আহমদ ছফা ও তাঁর সহযোগীরা একটা সেমিনার করেন বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে। সে সভার শিরোনাম ছিলো আরও আশা জাগানিয়া এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।শিরোনামটি ছিল এরকম,” ভবিষ্যতের বাংলাঃআমাদের করণীয় “।শিরোনাম দেখে অনুধাবন করা যায় আহমদ ছফা স্বাধীন বাংলার জন্য কাজ এগিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। বাংলা একাডেমির সে আলোচনা সভাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা একত্রিত হয়েছিলেন। আর ছফা চেয়েছিলেন তাদের টেনে আনতে আর তাদের মনোভাব জানতে। হয়েছিলও তাই, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সভাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে কিংবা বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে সে নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। ছফার ধারণা তাঁরা জোটবদ্ধ হয়েই এসেছিলেন। সে সভাতে ডঃ আহমদ শরীফ, ডঃ মমতাজুর রহমান তরফদার, সরদার ফজলুল করীম, ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, ডঃ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হুমায়ুন কবির,ফরহাদ মজহার এবং আহমদ ছফা ছিলেন।ছফা আঁচ করতে পেরেছিলেন এই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান ভাঙতে চাইবে না।তাঁরা পাকিস্তান আন্দোলন করেছে দেশপ্রেম থেকে নয়, প্রয়োজনে। আবার এরাই দেশ স্বাধীন হলে বাঙালি সাজবে।বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য ছিলো আরও কৌতুহলপূর্ণ।তাঁরা বলেছিলেন”, আমাদের সবাইকে কসাইখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।”।ছফা বুদ্ধিজীবীদের মতলব বুঝেছিলেন।তাই পরবর্তীকালে তিনি “বেহাত বিপ্লব, “অলাতচক্রে” বলেছেন,এইসব বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, আর এখন বুদ্ধিজীবীরা যা বলছে তা শুনলে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।ছফা আমাদের জাতীয় চরিত্রটি ধরতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা দেশের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে না।ছফা জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি কলকাতা থেকে “দাবানল ” পত্রিকা প্রকাশ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার কাজে সহযোগিতা করেছেন।ছফা বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ নামে নতুন দেশ পয়দা হতে যাবে।একাত্তর তাঁর কাছে মহাসিন্ধুর মহাহিল্লোল।তিনি একাত্তরের ডাক শুনতে পেতেন।১৯৭১ সালেই তিনি প্রবন্ধ লিখেন “জাগ্রত বাংলাদেশ ” শিরোনামে। কতটা আত্মপ্রত্যয় থাকলে এমনটা করা যায়!তিনি ১৯৭২ সালে রচনা করেন”বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস”।এখানে আমাদের জাতি রাষ্ট্রের অনেক সত্যের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন।বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণায় পরিবর্তন এনেছেন।তিনি বলেছেন,”আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি সেজে আছেন দেশপ্রেম থেকে নয়, প্রয়োজনে।এরা সঠিক পথ নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।ছফা নানা প্রবন্ধ লিখে এ সত্য আরও প্রকট করে তোলেন।তাঁর বলার স্টাইল ছিলো, রচনায় নিজস্বতা ছিলো। তাঁর রচনাশৈলী সহজেই পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারতো। একটা সম্মোহনী শক্তি ছিলো তাঁর লিখনে।১৯৭৫ সালে লিখেন,” বাংলাভাষাঃ রাজনীতির আলোকে”,”বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা(১৯৭৭),সঙ্কটের নানা চেহারা (১৯৯৬),বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র (১৯৯৯)।ছফা বিভিন্নভাবে আমাদের রাষ্ট্রের পথ নির্দেশ করেছেন।তিনি বলতেন,”আমাদের ভারত বিরোধিতার দরকার আছে,আমাদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য।”ছফার গ্রন্থগুলোতে আমাদের জাতীয় সঙ্কট এবং এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ রয়েছে।তিনি একরোখা, স্বাধীনচেতা এবং বোহেমিয়ান স্বভাবের একজন মানুষ। তাঁকে বিচার করতে হলে তাঁর বই দিয়ে করতে হবে।তিনি আমাদের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে পড়া সমাপ্ত করতে পারেননি।কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে এসে তিনি এর নগ্নরূপ দেখেছেন।দেখেছেন কিভাবে নেপোটিজম হয়।তারই অংশ হিসেবে রচনা করেন “গাভী বৃত্তান্ত “। এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার প্রশাসন সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানতে পারি।বেরিয়ে আসে অনেক ভেতরের খবর। ছফা তার গুরু সম্পর্কে লিখেন ” “যদ্যপি আমার গুরু”।অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বাঙালি সমাজে সক্রেটিসসম।তিনি জ্ঞানে,প্রজ্ঞায় আধুনিক ছিলেন।কিন্তু এই চিরকুমার মানুষটি কেন জানি নিজেকে প্রকাশ করেননি। তাঁকে প্রকাশ করেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হয়েছেন।ছফা তাঁর স্বভাবের ছিলেন,তিনিও বিয়ে করেননি। ছফা যেমন মানুষের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন তেমনি লোকদেরও তিনি সাহায্য করেছেন।ছফার আবিষ্কার ছিল এসএম সুলতান। ছফা বলতেন,” সুলতান হলো এশিয়ার বিস্ময় “।ছফাকে সংগ্রাম করে সমাজে টিকে থাকতে হয়েছে।তাঁর পথ সহজ ছিলো না। তিনি বলতেন,” আমাকে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে এবং হবে।আমাকে দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে হয় লিখে।আর প্রতিনিয়ত লেখার মান বাড়াতে কসরত করতে হয় “।ছফা নিজেকে ভুলে যাননি। তাঁর অস্তিত্ব তাঁকে প্রতিনিয়ত মহান করেছে।তিনি বলতেন,” আমার পরিবার চাষা।আমার পক্ষে এটা ওভারলুক করা কষ্টকর,রঙ চড়িয়ে কিছু বলতে চাইনা। আমার পূর্বপুরুষেরা সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত ছিলো। এই পরিচয় আমার অহংকার”।তিনি নতুন দেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রনীতি নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন।তাঁর চিন্তায়, চেতনায় দেশিয় সংস্কৃতি প্রধান্য পেয়েছে।তাঁর লেখায় আমাদের না বলা কথা শুনতে পাই।তিনি বইয়ের জগতে ভারতীয় আগ্রাসন মেনে নিতে পারেননি। এনিয়ে প্রতিবাদ করেন।তখন কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান ছফাকে গালমন্দ করেন।ছফা তাঁকে কিছু না বলে নিউমার্কেট, আজিজসুপার মার্কেট, নীলক্ষেত ঘুরিয়ে আনেন।এবং বইয়ের বাজারে আমাদের দেশিয় লেখকদের চাইতে ভারতীয় লেখকদের দখল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।আহমদ ছফা বাঙালি মনীষার সর্বশেষ সংযোজন। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের মতে,”মীর মশাররফ হোসেন আর নজরুল ইসলামকে বাদ দিলে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলিম সমাজের সবচেয়ে অগ্রগণ্য পুরুষ। “ছফার চিন্তা ছিলো সমগ্র বাংলা ভাষা,বাংলা রাষ্ট্র নিয়ে।তিনি “বাঙালি মুসলমানের মন” লিখে দেখিয়েছেন আমাদের মুসলিম সমাজের দৈন্যতা ঠিক কোন জায়গায়। দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে তিনি সবার সামনে সে সত্য তুলে আনেন।আমাদের একাত্তরের দীর্ঘ সংগ্রাম যে বেহাত হয়ে গেছে এনিয়ে তাঁর ক্ষোভ ছিলো। বেঁচে থাকতে এ রাষ্ট্র এ মহান মানুষটির কদর করেনি। তাঁর কপালে জোটেনি কোনো পুরস্কার। তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা নয় বলে অবমাননা করা হয়েছে।আবার কেউ কেউ তাঁকে মৌলবাদী বলতেও কসুর করেননি। ছফা বাঙালি ছিলেন,আর বাঙালি সমাজের সবচেয়ে অগ্রগণ্য চিন্তক ও তাত্ত্বিক ছিলেন।তাঁর দর্শন ব্যর্থ হয়ে যায় নি।তাঁকে অনুসরণ করে উত্তরকালে হুমায়ুন আজাদ,নূরুল আনোয়ার, ফরহাদ মজহার,হুমায়ুন কবির,মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন।তাঁকে জানতে হলে তাঁর রচনা পাঠ করতে হবে।আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের জন্য আহমদ ছফার দর্শন জরুরী।
ওমর ফারুক
সহকারী শিক্ষক
দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ।