বাজি: সমাজের ক্ষতে এন্টিসেপ্টিক – শাহানা সিরাজী

Picsart_22-07-22_15-42-03-082.jpg

বাজি: সমাজের ক্ষতে এন্টিসেপ্টিক – শাহানা সিরাজী

কিছুদিন আগে বাজি নামের একটি গল্পের বই হাতে আসে। বইটির লেখক খ্যাতিমান গল্পকার এবং গীতিকার, কবি ও সাংবাদিক সাগর চৌধুরী। একুশটি গল্পের সমাহার এ বইটি। প্রতিটি গল্পই সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের আনন্দ-বেদনার সূক্ষ কারচুপির প্রতিনিধিত্ব করে। গল্পকারের চিন্তার সুশীলপ্রকাশ। গল্পের শুরুতে লেখকের চিন্তার বিশ্লেষণ এবং কিছু প্রশ্ন পাঠকের জন্য ছুঁড়ে দিয়েই গল্পে প্রবেশ করেছেন। এটি তাঁর নিজস্ব স্টাইল। বস্তুতঃ পক্ষে তিনি যে কোন বিষয়ের অবতারণা করেনই গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে।

গল্প লেখা সহজ কোন কাজ নয়। গল্পে যেমন নাটকীয়তা থাকে তেমনি থাকে ম্যাসেজ। সমাজ পরিবর্তনে শিল্পের অবদানই মূখ্য। যদিও তা সহজে চোখে পড়ে না কিন্তু কবি সাহিত্যিকেরাই সমাজ বদলে দেয় । নীরবে, গোপনে,চুপে চুপে। শিল্প সাহিত্য যে ধারায় চলে সমাজও সে ধারাতেই চলে।

মানুষের বেড়ে ওঠার পথে রয়েছে অনেকগুলো ধাপ। প্রতিটি ধাপেই নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় মানুষ পূর্ণ হয়। কিন্তু সময়ের পদাঘাতে অনেকেই বেমালুম সব ভুলে য়ায়। নতুনকে নিয়ে মেতে ওঠে। কখনো বাঁচার অভিপ্রায় কখনো বা নিতান্তই পরিস্থিতির শিকার। এই ঢাকা শহরে যে সব শিক্ষার্থী নিতান্তই স্বজনহীন প্রথম আসে তাদের উঠতে হয় মেসে। করতে হয় টিউশনি। খেতে হয় কখনো বুয়া কখনো দোকানে কখনো টিউশনির ছাত্র-ছাত্রীদের বাসায়। উঠতি বয়সের তরুণ শুভ এমনি এক ছাত্রীর দেখা পেলো বহু বছর পর। যে ছাত্রী এক সময় পড়া মুখস্ত বাদ দিয়ে শুভকে মুখস্ত করতো। শুভ বুদ্ধিমানের মতো সব এড়িয়ে গিয়েছে কিন্তু তার হৃদয় কী পেরেছে সাদিয়াকে ভুলতে? হৃদয় কী কোন কথা বলেনি? বাস্তবতার কষাঘাতে হৃদয়ের কথা শুভ না শুনলেও অবচেতন মনে তাকে মনে রেখেছেই । তাই ঝড়ের কবলে পড়ে অচেনা বাসায় গিয়েও শুভর পরিচিত মনে হয়েছে। সেখানে সাদিয়ার সাথে দেখা হয়ে যাওয়া, সাদিয়ার অনুভুতি এবং শুভর বাস্তবতা এবং আত্মহংকার এক সাথে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন ‘পুরনো প্রেম’ গল্পে। টিউশনির ছাত্রী প্রপোজ করেনি কিংবা টিউটর প্রপোজ করে না এমন ঘটনা বিরল। তারুণ্যের দাবীকে কে হেলা করতে পারে!

‘দুঃখের গল্প’ নামক গল্পটির শুরুতেই লেখক মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং বলেছেন মানুষ আসলেই বোকা। তারপর গল্পে এসেছেন। রাজন আর কাকন হাসতে খেলতে একই সাথে বেড়ে উঠেছে। তাদের মানসিক সংগঠনগুলো নানান ঝামেলার ভেতর দিয়ে একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়। যে বয়সে নারীকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় সে বয়সে পুরুষ বসে না। তাই পরিবারের কেউ রাজন-কাকনের খুনসুটিকে পাত্তা না দিয়ে কাকনকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার চিন্তা করে। কিন্ত্র রাজন –কাকন কথা নেই বার্তা নেই হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে আগুনে ঝাঁপ দেয়। এ আগুনে শুধু তারাই পুড়েছে? বর সেজে আসা পুরুষটিরও কী অন্তর পুড়েনি? সে কী জানতো বউ নিতে এসে নিজেই ঝরে পড়া রক্তকরবী হয়ে হয়ে যাবে?

আমাদের সামাজিক ব্যাধি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবর্তিত হয়। নর-নারীর ভালোবাসাকে এখানে পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। কত দম্পতি আছে আলু-পটলের মতো শো-পিস জীবন যাপন করছে! অভিভাবকেরা মনে করে তাদের সন্তান সুখেই আছে। বরের অঢেল টাকা আছে, মেয়ে আমার কতো সুখী। গা ভর্তি গহনা, দামী শাড়ি, গাড়ি কী নেই! কিন্তু জানে না তিলে তিলে তাদের সন্তান মারা যাচ্ছে। যেদিন প্রেম মরে বস্তুত সেদিনই তার মৃত্যূ হয়। এখানেই মানুষের ব্যর্থতা এখানে মানুষের বোকামী!

‘চেনা শহর’ গল্পটি শুরু হয়েছে ‘ ভালোবাসাটা জানি কেমন? ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না আবার বুকেও আগলে রাখা যায় না। আসলে যে এর কী রূপ তাও বোঝা যায় না।’উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটির চরিত্রের নাম রূপম। এ এমন একটি চরিত্র যা বর্তমান সময়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ । কারণ মফস্বল থেকে যে মেয়েটি পড়াশোনা কিংবা স্বপ্ন পূরণের আশায় এ মেগাসিটিতে আসে, সেল্ফসেন্টার্ড এ যুগে আত্মীয়ও হয় অনাত্মীয়ের মতো। এখানে টিকে থাকার জন্য অনেক নারীই কারো না কারো সাথে ইনভল্ভ হয়ে পড়ে। এখানে প্রেম-ভালোবাসার চেয়েও অধিকতর ব্যাপার পাশে কাউকে রাখা। একটু শক্তি, একটু সাহস, একটু নির্ভরতার জন্য । তেমনি নির্ভরতায় চেয়েছিলো রূপমকে। নিজে কষ্ট করে চলে টিউশনির টাকাও তুলে দিয়েছে রূপমের হাতে। রূপম যা ইচ্ছা তাই করেছে। পরম মমতায় ভালোবাসায় রুপমের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজে সম্ভ্রম হারিয়েছে। কিন্তু একদিন আবিষ্কার করলো রুপম তাকে কেবল ভোগের বস্তু হিসেবেই দেখেছে। তার দায়িত্ব নেয়ার তাকে ভালোবাসার কোন মানসিকতা তার ছিলো না এবং নেই। উপরন্তু রুপম একটি ড্রাগ এডিক্ট পুরুষ! প্রচণ্ড আহত হলেও রুপমের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেকে টিচিং দিতে শুরু করে‘ এমন ড্রাগ এডিক্ট ছেলেকে কে ভালোবাসতে চায়?’ এখানেই গল্পটির শেষ হল। এ গল্প দুদান্ত ভাবে চলছে এখন স্কুল –কলেজ- ভার্সিটিতে পড়ুয়া পথহারা ছেলেমেয়েদের ভেতর। এ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সময়ের দুরন্ত চাকা কোথায় যাচ্ছে!

কাক ও কোকিল’ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জ্বলন্ত কাঠি। আমরা জানি কোকিল ডিম পাড়ে কাকের বাসায়। কাক যত্নে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায় খাওয়ায় একদিন কোকিলের বাচ্চা উড়ে যায়। এতো প্রকৃতির লীলা। কিন্তু মানুষ যে বিশ্বাসে যৌথজীবন যাপন করে সে বিশ্বাস কতোটা প্রবল! মাতৃত্বের স্বাদের কাছে অন্য সব মিছে হয়ে যায়। এমনি এক তিন সম্তানের জনক যখন জানতে পারলো আসলে তার সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা কোন কালেই ছিলো না তখন তার কেমন লেগেছে। লেখকের কাছে ‘সন্তান জন্মদানে অক্ষম পুরুষ, সক্ষম পুরুষের কাছে শিমুল তুলোর মতো উড়ে যায়’প্রতিটি দম্পতির ক্ষেত্রেই এটি প্রবল ভাবে সত্যি যে সন্তান আসলে কার তা একমাত্র মা-ই বলতে পারে অন্য কেউই নয়। পোশাক পরিহিত সমাজ জানে না পোশাকের ভেতর দেহটির ক্ষত কোথায় !

‘বাজি’নামকরণের গল্পটি ঠিকযেন মহাভারতের উপাখ্যান। মহর্ষি ব্যাসদেবের ‘মহাভারত’-এ কৌরবদের সাথে পাশা খেলতে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব যে ভাবে নিঃস্ব হয়ে শেষ মুহূর্তে নিজেদের স্ত্রী দ্রৌপদীকে বাজি রেখেছিলেন, মিশরের যুবরাজ মাজেদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ বাজি রেখেছেন আর নয় স্ত্রীকে ঠিক তেমনি একই কায়দায় জুয়ার আসরে প্রেমিক পুরুষ বাজি রেখেছিলো তার প্রেমিকাকে। জুয়া একটা জগণ্য খেলা আমার দৃষ্টিতে। ধনবান হতে চাও? খেটে পরিশ্রম করে হও, জুয়া খেলে কেন? জুয়াড়ির এমন নেশা নিজের স্ত্রীকেও বাজি রাখে! বর্তমান সমাজ অবশ্য জুয়ার নাম রেখেছে ক্যাসিনো। কিছু দিন আগে আমরা দেখেছি ক্যাসিনোয় কী ঘটেছে। ওই যে বললাম পোশাক পরিহিত সমাজের কোষে কাষে অন্যায়। লেখক যুবকদের দেখিয়ে দিয়েছেন যে প্রেমিকা তাকে প্রাণের মতো ভালোবাসতো সে সবার সামনেই তাকে জুতা মেরে চলে গিয়েছে। ‘বাজি ’ গল্পটি মাহাভারতের আদলে হলেও তরুণদের জন্য সর্তকতাই বটে।

একুশটি গল্পই পাঠকের ভালো লাগবে। প্রতিটি গল্পই পাঠককে দেবে নতুন ভাবনার বিষয়। আমরা কেউ কেউ একটা দুটো সন্তান নিয়ে আর নিই না। কেউ কেউ অনেক সন্তান নিই। খাওয়াতে পারি না। রাস্তা-ঘাটে গড়াগড়ি করে মানুষ হয়। এমনই একটি চরিত্র সন্তান গল্পে। যিনি ফ্যামিলি প্ল্যানিং এ কাজ করেন। সারা জবিন মানুষকে একটাদুটো বাচ্চার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। নিজেও নিয়েছেন একটি বাচ্চাই। সে বাচ্চা পাইলট হয়ে যেদিন প্রথম বিমান উঠেছে সেদিনই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। সে থেকে তার স্ত্রীর চোখের পানি শুকায়নি অথচ তিনি এখনো পাড়ায় পাড়ায় ,বস্তিতে বস্তিতে ঘুরছেন‘ জন্ম নিয়ন্ত্রণ’করুন। বিধির খেলা কে বুঝতে পারে!

‘বাজি’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালের বই মেলায়। মিজান পাবলিশার্স বইটি প্রকাশ করেছে। বিক্রয় মূল্য ১২৫ টাকা। সুন্দর মাইনডব্লোইং প্রচ্ছদ করেছেন রফিকুল ইসলাম দুলাল।

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর(সাধারণ)
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top