তামাক কোম্পানির সিএসআর বন্ধ নয় কেন – মনজুরুল আহসান বুলবুল

PicsArt_02-09-02.12.37.jpg

তামাক কোম্পানির সিএসআর বন্ধ নয় কেন – মনজুরুল আহসান বুলবুল

তামাক চাষে অল্পবয়সী বাচ্ছারাও শ্রম দিচ্ছে।
তামাক কোম্পানির সিএসআর বন্ধ নয় কেন? পরিসংখ্যান বলছে, যাদের দক্ষতা ও সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, সেই তরুণসমাজ হচ্ছে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশ। এদের রক্ষা করা মানে সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাই নয় দেশের ভবিষ্যৎকেও রক্ষা করা। আশঙ্কার কথা হচ্ছে শুধু তামাকেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এ ভবিষ্যৎ। একবারে ধ্বংস না হলেও সম্ভাবনাময় এ তরুণ জনগোষ্ঠী দেশের সম্পদ না হয়ে বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তামাক নিয়ে কাজ করে এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো জানান দিচ্ছে বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তার বেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫.৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়সী মানুষ প্রত্যক্ষভাবেই তামাক সেবন করেন। টোব্যাকো অ্যাটলাসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীর মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৭২ হাজারের বেশি। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে। (সূত্র : বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, ২০১৮)।

এ চিত্রের মধ্যেও বিস্ময়করভাবে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পুরনো ভোক্তা হারানোর শূন্যতা পূরণের জন্য টার্গেট করেছে শিশু-কিশোর-তরুণদের। এদের তামাক ও নিকোটিনজাত পণ্যে আকৃষ্ট করতে নানা কারসাজির আশ্রয় নেয় কোম্পানিগুলো।

তামাক চাষে বিপন্ন হয় পরিবেশ। কৃষি জমি নষ্ট করে। আরও ক্ষতিকর আশংকা।
বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষর করে। ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয় এবং ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে আরও যুগোপযোগী করা হয়। ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা পাস করা হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এফসিটিসিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে মূলধারার উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তামাকের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকারস সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ লক্ষ্য অর্জনে বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধনের ঘোষণাও দেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পরও বিপরীতধর্মী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এর পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলো তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নানা চাতুরীপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে চলছে। এ কৌশলে তাদের অন্যতম হাতিয়ার তথাকথিত সিএসআর কর্মসূচি।

সাধারণভাবে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর কার্যক্রম বললেই সবার চোখের সামনে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনাকারী কোনো ভালো করপোরেট সিটিজেন বা কোম্পানির চিত্র ভেসে ওঠে। কিন্তু তামাক কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয়। তামাক এমন একটি পণ্য যা এর ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেকেরই মৃত্যু ঘটায়। কাজেই প্রাণঘাতী পণ্য উৎপাদনকারী এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করবে এটি নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। এ যেন একদিকে মৃত্যুর নানা আয়োজন জারি রেখে জীবনের উৎসবের কথা বলা। দেশে প্রচলিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু দুর্বলতা এ ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে। যেমন তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর) নিষিদ্ধ না করায় কোম্পানিগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে পুরোদমে। তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনায় তা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। চলমান কভিড-১৯ মহামারীতেও ব্যবসা চালিয়ে যেতে তামাক কোম্পানিগুলো সিএসআর, লবিং, অনুদান, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারসহ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেছে। সিএসআরের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান, ব্র্যান্ড ইমেজ প্রচারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজে লাইভ টকশোয় অংশগ্রহণ, করোনায় ধূমপায়ীদের ক্ষতি কম এ-জাতীয় ভ্রান্ত তথ্য প্রচার ইত্যাদি অব্যাহত রেখেছে কোম্পানিগুলো। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের কভিড-১৯ সংক্রমণে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।


আল্প বয়সী বাচ্ছাদের হাতে তামাক পৌঁছে গেছে। এই অপরাধ টোব্যাকো কম্পানি এবং সরকার দায় এড়াতে পারে না।

এ সতর্কতা আমলে নিলে দেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি তামাক ব্যবহারকারী মারাত্মকভাবে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুযোগ থাকায় সরকারের নীতিপ্রণেতাদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণবিষয়ক নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী ঘোষণার বাস্তবায়ন, করোনায় দেশের প্রায় সিকিভাগ জনগোষ্ঠীকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীকে রক্ষার স্বার্থে তামাক কোম্পানিগুলোর লাগাম টেনে ধরা দরকার। সে লক্ষ্যে তামাকের নেতিবাচক প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এফসিটিসির আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।

মনজুরুল আহসান বুলবুল
সিনিয়র সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top