বরগুনার তালতলীর দুর্নীতি’র ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ
অপরাধ প্রতিবেদকঃ প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘বরগুনার তালতলীর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের’ সমীক্ষা প্রণয়ন কাজের দুর্নীতির ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে।
মিথ্যা, প্রতারণামূলক এবং চুক্তির মৌলিক শর্তভঙ্গের কারণে সমীক্ষা কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আর এ কাজের ঠিকাদারকে দেওয়া দুই কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা-বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের (বিএসইসি)।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান মো. রইছ উদ্দিন সোমবার বলেন, প্রকল্পের সমীক্ষা প্রণয়ন কাজে অনিয়ম চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করে শিল্প মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশনা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের সমীক্ষার অনিয়মের সঙ্গে যে বা যারা জড়িত-সবার ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার এ প্রকল্পের সমীক্ষা প্রণয়নের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় কোরিয়াভিত্তিক কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান জেনটেক ইঞ্জিনিয়ারিংকে। এ প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের এজেন্ট ছিল টারবো মেশিনারিজ সার্ভিসেস বাংলাদেশ। সমীক্ষামূলক কাজ হলেও জেনটেকের লোকাল এজেন্ট টারবো মূলত প্রথম শ্রেণির কনস্ট্রাকশন, সরবরাহকারী এবং আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। শর্ত মোতাবেক বিদেশি বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষার মূল কাজ করানোর কথা ছিল। কিন্তু এ কাজের জন্য বিদেশি কোনো বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে আসেনি। এ ছাড়া সব ধরনের লেনদেন জেনটেক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে করার কথা ছিল। কিন্তু এ প্রকল্পের কর্মকর্তা ও বিএসইসির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান চুক্তির শর্ত ভেঙে জেনটেকের লোকাল এজেন্ট টারবো মেশিনারিজের সঙ্গে চুক্তি করেন। এ ছাড়া বিদেশি এক্সপার্ট ছাড়া দেশি লোক দিয়ে কিছু কাজ করে গোঁজামিল প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেটার ওপর ভিত্তি করে ওই প্রকল্পের শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ সম্ভব নয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সুপারিশ এবং ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) পর্যালোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বিএসইসি।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিএসইসির ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর এ অগ্রাধিকার প্রকল্পের সমীক্ষা প্রণয়ন কাজের জন্য নিয়োগকৃত মিথ্যা, প্রতারণামূলক ও চুক্তির মৌলিক শর্ত ভঙ্গ করায় দায়িত্বপ্রাপ্ত দুটি প্রতিষ্ঠান দুই বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়। এ সময় এ দুটি প্রতিষ্ঠান বিএসইসি এবং সরকারি তহবিল দ্বারা বাস্তবায়িত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
তালতলী জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সমীক্ষা প্রণয়ন কাজের জন্য চার কোটি ৬২ লাখ ২৫ হাজার টাকার চুক্তি করা হয়। এ কাজের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা প্রদান করেন প্রকল্প কর্মকর্তা। চুক্তির বিধিবিধান যাচাই-বাছাই না করে সরকারি অর্থ প্রদান করায় তার বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বিএসইসি। তবে এর আগে তাকে এ প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য ব্যয়িত সব অর্থ আদায় করতে হবে।
আরও জানা যায়, এ সমীক্ষার একটি অংশের কাজ ‘সার্ভে ২০০০’-কে দিয়ে করানোর কথা ছিল। কিন্তু সেটা না করে ‘ল্যান্ড সার্ভে টিম’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানো হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা প্রতিবেদন শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সুপারিশে আইডব্লিউএমকে দিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে চুক্তি অনুযায়ী কাজ হয়নি-এ মর্মে গত ২০ জানুয়ারি মতামত দেয়। এরপর গত ২৬ জানুয়ারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় বিএসইসি। সেখানে জানতে চাওয়া হয়, কেন তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে না। সাত দিনের সময় দিয়ে চিঠি দিলেও তারা বেঁধে দেওয়া সময়েও কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেনি। পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
৪ অক্টোবর গণমাধ্যমে ‘বরগুনার তালতলীর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক পরিবেশবান্ধব জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প নির্মাণ প্রকল্পের শুরুতেই ভয়াবহ দুর্নীতি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এটা নিয়ে বিভিন্ন টিভিতে টকশো সহ দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলে। এ ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে শিল্প মন্ত্রণালয়। সংবাদ প্রকাশের পরের দিন বা গত ৫ অক্টোবর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। এ ঘটনার সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন শিল্পমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে তদন্ত কাজ শেষ করেন কমিটির সদস্যরা। সবশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে অর্থ ফেরতসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিএসইসিকে নির্দেশ প্রদান করে এ নির্দেশনা সংবলিত চিঠিসহ তদন্ত প্রতিবেদন বিএসইসির চেয়ারম্যানকে প্রেরণ করে শিল্প মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশনার ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।