এক কোটি বছর তোমাকে দেখিনা – মোহাম্মাদ মওদুদ আহমেদ

PicsArt_04-16-10.08.59.jpg

এক কোটি বছর তোমাকে দেখিনা – মোহাম্মাদ মওদুদ আহমেদ

“একজন বিচরক”

সাগর চৌধুরীঃ লেখাটা হুবহু তুলে দিলাম প্রিয় পাঠক আপনাদের জন্য। দেখুন একজন বিচারক কিভাবে নিজের কথা লুকিয়ে রাখে। আপনারা হয়ত ভাবেন, বিচারক কারও কথা শোনে না। আইন ছাড়া একমুহূর্ত ও চলে না। দেখুন তারও প্রিয়জন আছে। প্রিয়জনের কথা রেখে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজেকে দায়িত্ব পালনে কতটা অবিচল রাখে। লেখাটা তার অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ করলাম। সে যদি লেখা ছাপানোর দায়ে আদালতে ডাকে তবে তার বিচারের দন্ড মাথা পেতে নেব। কেন নেব? আমার প্রিয় পাঠকেরা লেখাটা পড়ে রাষ্ট্রের বিচারকদেরও মনের ব্যাথা অনুভব করবেন।

এই লক ডাউন একদিন কেটে যাবে। নতুন ভোরে হাসবে সুন্দর পৃথিবী। কিন্তু লকডাউন চলাকালে কেমন ছিল আমাদের চারপাশ, কেমন ছিল আদালত পাড়া, কেমন ছিল প্রিয় স্বদেশ সবাই তা একটু হলেও বুঝতে পারবেন।

আবারও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি লেখাটা বিচারকের অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ করার জন্য।”

মোহাম্মাদ মওদুদ আহমেদ
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বরিশাল।

লেখাটা হুবহু তুলেদিলাম আপনাদের জন্য

“অনেকেই ফোন করে বলে, তোমার পরিবার থাকে ঢাকায় আর তুমি বরিশাল একা একা কি করছ? অফিস আদালত বন্ধ না? আমাকে তখন ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয় মেডিকেল, থানা সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আদালতও কখনো বন্ধ হয় না। এমনকি ঈদের দিনও সীমিত আকারে আদালত চালু থাকে। আমি আমার দায়িত্ব পালনের জন্যই আমার কর্মস্থল ত্যাগ করিনি।
আমার পাশের রুমেই অফিস করেন বরিশালের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পলি আফরোজ আপা। আপা বাসা থেকে হেটে হেটে তার রুমের তালা নিজেই খুলে চুপচাপ অফিস করেন।গাড়ি নাই, পিওন নেই, গান ম্যান নেই, পেশকার নাই – সবকাজ আপা একাই করে আবার হেটে হেটে বাসায় চলে যান। আমি আপাকে বলি, এই মূহুর্তে অন্তত অফিসের গাড়িটা ইউজ করতে পারেন? আপা হাসিমুখে বলেন, ‘ কি হবে ওদের সবাইকে ডেকে আদালতে লোক সমাগম করে, এর চাইতে ওরা ঘরেই নিরাপদ থাকুক ‘। এভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারকরা পালাক্রমে নীরবে হাসিমুখে সরকারি দায়িত্ব পালন করতেছেন।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে ৮ই মার্চ আর প্রথম মারা যায় ১৮ই মার্চ। আজকে পর্যন্ত আক্রান্ত ১৫৭২ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৬০! অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। অথচ আমরা যদি সরকারি নির্দেশনা ঠিকমতো মেনে ঘরের মধ্যে নিজেদের বন্দী রাখতাম তাহলে হয়তো এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নাও হতে পারতো। আমরা এমন জাতি যেখানে ফেইসবুকে “Stay home / ঘরে থাকুন” এই জাতীয় পোস্ট দিয়ে রাস্তায় দলবেঁধে গিয়ে দেখে আসি কারা কারা রাস্তায় নামলো!শুধু ফেইসবুকেই আমাদের দেশপ্রেম উথলে পরে। অথচ পাশের দেশ নেপালে রোগীর সংখ্যা ১৬ এবং ভুটানে মাত্র ৫ জন! আর এইসব দেশের একটি লোকও এখন পর্যন্ত মারা যায়নি!
আমরা সবকিছুতেই সরকারের দোষ খুজি। সমালোচকদের কথা শুনে মনে হয় শুধুমাত্র বাংলাদেশেই করোনাভাইরাস এসেছে। বিশ্বের ২১০ টা দেশ এই ভাইরাসে আক্রান্ত। এই পর্যন্ত সারা বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ২০৯৪৮৮৪ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৩৫৫৬৯! আমাদের সরকার এই মহামারী ঠেকাতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বিতর্ক এড়াতে এবং সবাই যেন ঠিকমতো ত্রাণ পায় সেজন্য দায়িত্ব দেওয়া হলো ইউপি চেয়ারম্যান সদস্যের, কিন্তু তারা যদি রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করে এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখবো! তারপরও এইসব চোররা ধরা পড়ছে, শাস্তিও হচ্ছে। বর্তমান বিপদ একটি সামগ্রিক বিপদ। বেচে থাকলে সরকারের সমালোচনা করার প্রচুর সময় পাওয়া যাবে।কিন্তু এখন দরকার সবকিছু ভুলে গিয়ে সরকারের পাশে থাকার। আসুন আমরা এই মহা সংকটে সরকারকে সহযোগিতা করি। সরকারি সমস্ত নির্দেশনা মেনে চলি।
আমি আদালতে যাওয়ার সময় খেয়াল করি রাস্তায় প্রচুর লোক অযথা ঘোরাঘুরি করছে। হয়তো অনেকে জরুরী প্রয়োজনে বের হয়েছে। একবার যাওয়ার সময় শুনি এক ষাটোর্ধ্ব টুপি পড়া দাড়িওয়ালা মাস্ক পড়া ছাড়া এক মুরুব্বী একজনকে বলতেছে, কি হবে মাস্ক পড়ে? হায়াৎ যতদিন আছে ততদিন কেউ কিছু করতে পারবেনা। আমি তারে অনেক কিছু বলতে চাইছিলাম, কিন্তু বললামনা। এইসব মানুষ কোনো যুক্তি মানতে চায়না। নিজেও মরবে অন্যদেরও মারবে! একটা বিষয় খেয়াল করলাম, দিনের বেলায় রাস্তায় যেমন প্রচুর লোক থাকে কিন্তু রাতের বেলা রাস্তা ঘাট একদম ফাকা। একটা ভুতুরে পরিবেশ। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, করোনাভাইরাস কি রাতের বেলায় আক্রমণ করে???
দীর্ঘ দুই মাস চাকরির কারনে পরিবারের সাথে দেখা হয়না। আমার মা বাবা সহ পরিবার ঢাকার মিরপুরে থাকে, আর আমি বরিশালে। বরিশালে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে আমার পাশের রুমে এক পুলিশ অফিসার থাকেন, তার বাড়ি পাবনাতে। তারও আমার মতো অবস্থা। আগে তার সাথে দেখা হলে টুকটাক কথা হতো আর এখন উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে। আমার অবুজ বউ ঢাকা থেকে ফোন করে বলে, আমার কথা কি তোমার মনে পড়েনা? ? আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনা ? মনে মনে বলি ….

এক কোটি বছর তোমাকে দেখিনা
……………
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে
কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয়
তোমাকে দেখিনা ??

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top