বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ৪৯৯ কোটি টাকার অডিট আপত্তি
বিশেষ প্রতিবেদকঃ বাস্তবে কোনো প্রশিক্ষণ কার্যক্রম হয়নি। তবে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানি ও ভাতা হিসেবে আত্মসাৎ করা হয়েছে ৯৬ লাখ ৫৬ হাজার ৯২০ টাকা। এই ঘটনা ঘটেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অধীনস্থ বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (সিএএবি) প্রতিষ্ঠান ঢাকার কুর্মিটোলার সিভিল এভিয়েশন একাডেমির পরিচালকের কার্যালয়ে। ঘটনাটি ঘটেছে ২০২০-২১ অর্থবছরে। শুধু এই ঘটনাই নয়, বেবিচকের প্রায় সব কার্যক্রমেই অনিয়ম-দুর্নীতির ছক। বেবিচকের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কিংবা বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের নিরীক্ষায় (অডিট)।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অডিট অধিদপ্তর বেবিচকের ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাবসম্পর্কিত কার্যক্রমের ওপর কমপ্লায়েন্স অডিট বা নিরীক্ষা পরিচালনা করে। ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরীক্ষায় বেবিচকের সর্বমোট ৪৯৯ কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার ৭৬৭ টাকার আপত্তি উঠে আসে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বুধবার সংবিধানের ১৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে ৪৯টি অডিট ও হিসাব রিপোর্ট উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে বেবিচকের হিসাব সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স রিপোর্টে উক্ত পরিমাণ অর্থের অডিট আপত্তির তথ্য রয়েছে।
বাস্তবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা না করেই প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানি ও ভাতা বাবদ ৯৬ লাখ ৫৬ হাজার ৯২০ টাকা ব্যয় দেখানোর বিষয়ে সংসদে উপস্থাপিত অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অফিস আদেশ, প্রশিক্ষণ শিডিউল ও প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রতিটি লেকচারের বিপরীতে প্রশিক্ষণার্থীদের কোনো হাজিরা দেখাতে পারেনি সিভিল এভিয়েশন একাডেমি।
জেনারেল ফিন্যান্সিয়াল রুলস-এর ১০ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, ‘একজন দূরদর্শী ব্যক্তি নিজস্ব অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেরূপ সতর্কতা অবলম্বন করেন, সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তা অনুরূপ সতর্কতা অবলম্বন করবেন।’ তবে ভুয়া প্রশিক্ষণ দেখিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে বেবিচক এই বিধানটি লঙ্ঘন করেছে।
এই আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে অডিট অধিদপ্তর বেবিচকের কাছে জানতে চেয়েছিল। জবাবে বেবিচক জানিয়েছিল, ‘যে কোনো কোর্স শুরুর আগে এবং পরবর্তীতে সম্মানী ও ভাতা প্রদানে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও সেটি অনুসরণ করা হয়েছে।’ তবে, বেবিচকের এই জবাব গ্রহণযোগ্য হয়নি অডিট অধিদপ্তরের কাছে। নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়েছে, ‘এই ঘটনা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি এবং গুরুতর আর্থিক অনিয়ম’। অডিট প্রতিবেদনে দায়ীদের কাছ থেকে আপত্তিকৃত অর্থ আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে।
এই ঘটনা ছাড়াও সংসদের উপস্থাপিত বেবিচকের ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব সম্পর্কিত কার্যক্রমের ওপর কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাছ থেকে অবতরণ ও বোর্ডিং ব্রিজ চার্জ আদায় না করায় ৩২ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ৫৮২ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাছ থেকে ভ্যাট ও আয়কর আদায় না করায় আর্থিক ক্ষতি হয় ১৩ কোটি ৭ লাখ ৯২ হাজার ১৫৪ টাকা। বন্ধ ঘোষিত বিভিন্ন এয়ারওয়েজের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ আদায় না করায় ক্ষতি হয় ৩৯৪ কোটি ৯১ লাখ ৯১ হাজার ৩০৬ টাকা। বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাছ থেকে ভ্যাটসহ এম্বারকেশন ফি, বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি এবং যাত্রী নিরাপত্তা ফি আদায় না করায় ১৬ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার ৫২৪ টাকা ক্ষতি হয়। বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাছ থেকে আরোপিত সারচার্জ আদায় না করায় ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৬২ টাকা।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, শতভাগ অতিরিক্ত দরে চুক্তি সম্পাদনপূর্বক অর্থ পরিশোধ করায় ৪ কোটি ৪১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৩ টাকা ক্ষতি হয়। বিভিন্ন ইজারা গ্রহীতার কাছ থেকে ভাড়া ও ইজারা মূল্য আদায় না হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৭১ লাখ ৩৪ হাজার ৭০৮ টাকা। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অননুমোদিতভাবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করায় ক্ষতি হয় ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৫২৮ টাকা। আর চুক্তির শর্ত মোতাবেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক রিপোর্ট দাখিল না করা সত্ত্বেও অর্থ পরিশোধ করায় ২ কোটি ২০ লাখ ৪০ হাজার ৯০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অননুমোদিতভাবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করায় ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৫২৮ টাকা ক্ষতি হওয়া সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ঘটনা ঘটেছে বেবিচকের আওতাধীন ঢাকার কুর্মিটোলার পিএন্ডডি/কিউএস সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দপ্তরে। ঘটনার বিবরণে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেবিচকের নিজস্ব অর্থায়নে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শীর্ষক প্রকল্প’ সমীক্ষার জন্য ১৩৬ কোটি ৫৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকার চুক্তি হয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স নিপ্পন কোই কোম্পানি লিমিটেড’-এর সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ২০ মার্চ। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বেবিচক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ লাখ ৫০ হাজার ৩৫২ মার্কিন ডলারের (ভ্যাট-ট্যাক্সসহ) সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ ৫২ হাজার ৬৩২ টাকা পরিশোধ করে। এছাড়া ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ৩১ মে সময়ে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়। পুরো ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৫২৮ টাকাই দেওয়া হয়েছে সংশোধিত ক্রয় প্রস্তাব বা সিসিজিপির অনুমোদন ছাড়া।
এ ব্যাপারে অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, উক্ত অনিয়মের বিষয়ে বেবিচকের পক্ষ থেকে যে জবাব দেওয়া হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। চুক্তির মেয়াদ না বাড়িয়েই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া অর্থ আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে অডিট রিপোর্টে।
শতভাগ অতিরিক্ত দরে চুক্তি সম্পাদনপূর্বক অর্থ পরিশোধ করায় ৪ কোটি ৪১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৩ টাকা ক্ষতি হওয়ার বিষয়ে সংসদে উপস্থাপিত অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের প্রান্তিক ভবন, ক্যানোপি এলাকা, বোর্ডিং ব্রিজ এলাকা, ভিআইপি এলাকা ও এ-সংলগ্ন পার্কিং এলাকা এবং অভ্যন্তরীণ প্রান্তিক ভবন, ভিআইপি এলাকা ও তত্সংলগ্ন এলাকা; মোট ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ দশমিক ৬২ বর্গফুট জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজের জন্য প্রতি বর্গফুট ৪ দশমিক ৮৪৬৫ টাকা দরে মাসিক ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ১১ টাকা ৪৪ পয়সা প্রদানের শর্তে ঠিকাদার মেসার্স এ কে ট্রেডার্স লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল চুক্তি হয়। তবে পরবর্তী সময়ে শতভাগ অতিরিক্ত দরে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
১১০০ কোটি টাকা অনিয়ম – বিমানের পরিচালকসহ ৮ কর্মকর্তাকে তলব করেছে দুদক
আরও সংবাদ পড়ুন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাত কর্মকর্তাকে অনিয়মের অভিযোগ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক
আরও সংবাদ পড়ুন।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজে দুর্নীতি – দুদকের অভিযান
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
বিমান বাংলাদেশের ক্ষতি সাধন ও অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগে ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা
আরও সংবাদ পড়ুন।
বাংলাদেশ বিমানের সাবেক ১৭ সিবিএ নেতার দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হবে আন্তর্জাতিক এভিয়েশন হাব – প্রধানমন্ত্রী