চ্যাথাম লাইটহাউজ বিচ, বস্টন, ম্যাসাচুসেস্টস – শাহানা সিরাজী

Picsart_23-12-08_19-06-13-479.jpg

চ্যাথাম লাইটহাউজ বিচ, বস্টন, ম্যাসাচুসেস্টস – শাহানা সিরাজী

মা -ছেলে এক সাথে বেড়াতে বের হলাম। আমার ছেলে বাসা থেকে প্যাকেটে আমার বানানো ম্যারা পিঠা, বাদাম, আপেল সাথে নিল।

দাদুমনিদেরকে যার যার স্কুলে ড্রপ দিলো,শবনমকে অফিসে ড্রপ দিয়ে আমরা মা ছেলে চললাম চাইথাম লাইটহাউজ বিচ এর উদ্দেশ্যে।

রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছে রঙের বাহার এখন আর নেই।কারণ পত্রঝরা বৃক্ষরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে সব পাতা ঝরিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে মাঝে মাঝে কিছু গাছ সবুজ দেখা যাচ্ছে। এগুলোর পাতা সূচের মতো। পাইন গাছ। মাঝে মাঝে ক্রিসমাস ট্রিও দেখা যাচ্ছে। এরা সবুজ।এরাই শুধুমাত্র ঠান্ডার ভেতর টিকে থাকার স্পর্ধা দেখাতে পারে! আমি ক্লিক ক্লিক ছবি আর ভিডিও গাড়ি থেকেই করছি।

এতো সুন্দর রাস্তা। শোঁ শোঁ করে গাড়ি চলছে। চালাচ্ছে আমার ছেলে। মা-ছেলে কথার ফুলঝুরি ফোটাচ্ছি। পরিবার-দেশ-অর্থনীতি কিছুই বাদ নেই। মনে হলো ছোট বেলাতেই পৌঁছে গিয়েছি। চাইথাম পৌঁছার পর দেখলাম লাইটহাউজ।জীবনে প্রথম লাইটহাউজ দেখলাম। মাসুদ রানা পড়ার সময় লাইটহাউজের নানান বর্ণনা পড়েছি। এবার চাক্ষুষ দেখলাম। সারাক্ষণই ভেতর থেকে আলোর গ্লাস(ল্যান্স) ঘুরছে। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। যেন দূরবর্তী কোন জাহাজ পথ হারিয়ে দূরবীন দিয়ে দেখছে কোথাও লাইটহাউজের সন্ধান মিলে কি না! তারপর ক্যাপ্টেনকে খবর দিচ্ছে,পেয়েছি! পেয়েছি!! লাইটহাউজ! সাথে সাথে ক্যাপ্টেন নাবিকদের নির্দেশনা দিচ্ছে ভয় নেই,সামনে আমরা নোঙর করবো। তৈরি হও সবাই!

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। পাশেই একটি কবর ( স্মৃতিসৌধ) আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ছবি তুললাম। কবরে কে শুয়ে আছেন তা লেখা আছে। আমার পুত্র পড়লো কিন্তু আমি চোখকে প্রেসার দিলাম না। কারণ লেকাগুলো পড়তে আমার কষ্ট হচ্ছিলো। ইনারাকে খুব মিস করলাম। নতুন জায়গায় সে আমার খুব কেয়ার করে। ছোট একটা প্রাণ ঠিকই বুঝেছে তার দাদী এখানে নতুন কিছুই চিনে না।

খুব মিস করলাম আমার ভায়ের পরিবারকে। তারাসহ থাকলে ট্রিপটি অনেক আনন্দের হতো! কিন্তু তারা নিউ ইয়র্ক থাকে । চাইলেই আসা সম্ভব নয়। আর ছেলে-মেয়েদের স্কুল আছে। রাস্তার দুপাশে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি। এখানে যারা বেড়াতে আসে তারা রাত্রি যাপন করে। অল্প সময়ের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। লাইটহাউজের রক্ষকের বাড়ি এখন ইউনাটেড কোস্টাল গার্ডদের থাকার কাজে ব্যবহার হয়। বাড়িগুলোর চারপাশ বেশ পরিচ্ছন্ন। আমি শুধু ভাবছি এখানকার মানুষ বাইরের খাবার বেশিই খায় কিন্তু কোথাও ক্যান, বোতল, পলিথিন , ওয়ানটাইম ইউজ প্লেট-বাটি-গ্লাস পড়ে থাকতে দেখিনি।
গাড়ি পার্ক করতে এখানে টাকা লাগে। পার্ক-টাইমও কম। আমরা গিয়েছি ওয়াকিং টাইমে কারণ আমার হাতে সময় নেই। কাজের দিনে সবাই কাজে ব্যস্ত। শুধু আমাদের মতো গুটি কয় পরিবার তাদের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঘুরতে এসেছে। আমাদের কক্সবাজার বেলা ভূমির মতো এতো বড় বেলাভূমি নয় রাস্তা থেকে সামান্য হাঁটলেই আটলান্টিক।

কিন্তু বালিয়াড়িভূমি মানেই তো বালি! আমি হাঁটতেই পারছিলাম না। আমার ছেলে আমাকে ধরে ধরে অনেক দূর নিয়ে গেছে। আটলান্টিকেও চর জেগেছে। চর পাড়ি দিয়ে আরো দূর গেলেই তাররূপ দেখা যাবে। এখান থেকেই শোঁ শোঁ গর্জন শোনা যাচ্ছে, আছড়ে পড়া ঢেউ এবং ফেনায়িত জলরাশি দেখা যাচ্ছে। আমার কলিজা হিম হয়ে গেলো। মাতাল সাগরের কাছে যেতে নেই। এখানে বেশ আছি। আমার ছেলে সাঁতার জানে না। জানলেও বা কী! সাগর কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না!

দাঁড়িয়ে আছি আটলান্টিকের পাড়েই। সামনে স্বচ্ছ টলটলে জলরাশি। আমি ভাবলাম পা ডুবাবো না টিকই আছে একবার মুখে নিয়ে দেখি। এমন লবণাক্ত যেন মুখ পুড়ে গেলো। মনে পড়লো ‘দ্য এনশিয়ান্ট মেরিনার’ গল্পটির কথা। চারদিকে এতো পানি কিন্তু কোথাও এক ফোঁটা খাবারের পানি নেই। আমাদের বঙ্গোপসাগরের পানিও লবণাক্ত। কক্সবাজারের লবণচাষীরা জোয়ারের সময় বাঁধ দিয়ে পানি আঁটকে রেখে পরে থিতানো পদ্ধতিতে লবণ তৈরি করে। এখানে করে কী না জানি না। কিন্তু আমি ছোট ছোট কয়েকটি পাথর সংগ্রহ করেছি। সুন্দর পাথরগুলো। আমাদের জাফলং গিয়ে একই রকম পাথর দেখেছি। আসলে পাথর তো পাথরই সে যে দেশেই হোক একই, তাই না?

যেহেতু মানুষজন কম সেহেতু নিজেদের মধ্যেই আলাপচারিতায় আমরা ব্যস্ত। একজন বয়স্কা নারীর দেখা পেলাম। তিনি কথা বললেন, ঘুরতে আসা নিরাপদ হোক ইত্যাদি কথাবার্তা বললেন। আমার হাসি নাকি খুব সুন্দর মন্তব্য করলেন। ভাবলাম আমার আবার হাসি সুন্দর! আমিও আবার মানুষ! আমার চেয়ে উনার বয়স বেশিই হবে কিন্তু ইনার হাঁটা স্পিডের কাছে আমি নাবালিকা বৈকি! ভাবলাম তারাও তো বেঁচে আছে। মনে কতো আনন্দ! হাঁটচে আর ফোনে হেডফোন লাগিয়ে কথা বলছেন, হাসছেন। জাস্ট প্রাণবন্ত। আমাদের প্রাণ নিয়ে যায় ধর্ম নামক জুজু। অথচ তারাও ধর্ম পালন করে। তারা কাজের ভেতর থাকে আমরা লেবাসের ভেতর থাকি। অন্যের কুৎসা নিন্দায় ব্যস্ত থাকি।

আমাদের পানকৌড়ির মতো আটলান্টিকের পানিতে হাঁস ভেসে বেড়ায়। কেউ তাদেরকে বিরক্ত করে না, ধরে খেয়ে ফেলা তো দূরে। অনেকক্ষণ ডুবসাঁতার, ডিগবাজি খেয়ে উড়ে আরো দূরে চলে গেলো। সি-গার্ল দেখলাম। দিনটি ঝকঝকে কিন্তু এমন ঠাণ্ডা আমি যেন জমে যাচ্ছি। ছেলের কিনে দেয়া গরম জামা পরেছি তবুও হাঁড় কাঁপছে।

ছেলেকে বললাম চলো ফেরা যাক। অনেক পথ দেরী হয়ে যাবে। ইনারা -নোরাহ-শবনম তাদেরকে আবার পিক করতে হবে। এমনিতেই তাদেরকে রেখে এসে ভালো লাগছে না।
আবার সে বালি পেরিয়ে তীরে উঠলাম। রাস্তার পাশেই পাবলিক টয়লেট। আমার যাওয়া লাগবে। আমি জানতে চাইলাম এ টয়লেট ব্যবহার করা যাবে? আমার মাথায় আমাদের দেশের কথা চলে এসেছে। একজন ভদ্রলোক, পিউর সাদা, তিনি বের হচ্ছেন , আমার ছেলে উনাকেই জিজ্ঞস করলো সেখানে পেপার আছে কিনা? ভদ্রলোক আবার টয়লেটে প্রবেশ করে দেখে জানালেন আছে। আমরা বাঙালি আমাদের স্বভাব খুঁত ধরা তাই মা-ছেলে হাসলাম, তার আবার কেন দেখতে হলো সে তো এই মাত্রই বের হলো! উপকারির প্রতি অকুতজ্ঞ হলাম!

চ্যাথাম লাইটহাউজ অনেক পুরোনো। শহরের আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হিসাবে বিবেচিত, চ্যাথাম লাইট ৪৮ফুট লম্বা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০ ফুট উপরে। এটি আমেরিকার কয়েকটি লাইটহাউজের ভেতর একটি। যা এখনও ২৪ ঘন্টা কাজ করে।

চ্যাথাম লাইটহাউস স্টেশনটি প্রথম ১৮০৮সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, দ্বিতীয়টি কেপ কোড-এ নির্মিত হয়েছিল। আজকের ঘূর্ণায়মান বীকনটি তখন ছিলো না। উত্তর ট্রুরোর হাইল্যান্ড লাইটহাউজে থেকে চ্যাথাম আলোকে আলাদা করার জন্য, আটলান্টিকের বাইরে থেকে দেখার জন্য চ্যাথামকে দুটি লাইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল – দুটি লাইট টাওয়ার, 70 ফুট দূরে। চ্যাথাম লাইট বহু বছর ধরে “টুইন লাইটস” নামে পরিচিত ছিল এবং এখনও স্থানীয় জেলেরা এ নামেই জানে। এরপর নানান বিবর্তনের ভেতর দিয়ে আজকের লাইটহাউজ তেরি হয়েছে। এর ল্যান্স প্রতি দশ সেকেন্ডে ২বার ফ্ল্যাশ করে। ২৪ নটিক্যাল মাইল দূর পর্যন্ত দেখা যায়।

রাস্তার পাশেই সতর্কবার্তা রয়েছে – এ বিচে জলে নামা যাবে না। কারণ কোন কোস্টগার্ড নেই, বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া বড় সাইজের সাদা সার্ক আছে যা বিপজ্জনক।

ফেরার পথে অন্ধকার প্রায় নেমে এসেছে। ইনারার স্কুলে যেতে যেতে অনেক দেরী। নোরাহকে শবনম পিক করে তার অফিসে বসে আছে আমাদের জন্য। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগলো। আমার একজনের আটলান্টিক দেখার জন্য সবাইকে ভূগতে হয়েছে। অবশেষে সবাই এক হতে পেরেছি এটাই আনন্দ!


ছেলেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমাদের কক্সবাজার বেলাভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম বেলাভূমি। সে তুলনায় চ্যাথাম বেলাভূমি মাত্র অল্প কয়গজ। ইউ এস এ সরকার এই কয়গজের বাতাসকে কাজে লাগিয়ে বসিয়েছে উইন্ডমিল। যেখান থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিদ্যুৎ। দেখলাম আর দেখলাম। তারা কী ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করে এবং কাজে লাগায়। রাস্তার দুপাশে এতো গাছ কেউ কাটতে পারবে না। কাটতে হলে সেন্ট্রাল গর্ভমেন্ট এর অনুমোদন লাগবে।

আমরা লস প্রজেক্ট বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে লুটপাট করি,আমাদের বেলাভূমিতে বাতাস কী নেই? আমরা কী পারি না এই বাতাসকে কাজে লাগয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে? গাছপালা নদী-নালা সংরক্ষণ?

আমাদের বেলাভূমিতে বিদেশী পর্যটক এলে চুরি- ছিনতাই- ডাকাতি-লুটপাট হয় ওদের বেলাভূমিতে তারা পর্যটকদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে,তাদের দেশে ওয়েলকাম জানায়। আমরা এইটুকুও বুঝি না বিদেশীদের সাথে বিরূপ আচরণে দেশের সুনাম নষ্ট হয়। আমাদের মাথা নত হয়ে যায়।

যদি আমরা ব্যক্তিগত সম্পদের দিকে নজর না দিয়ে দেশ গঠনে মনোনিবেশ করতাম আমরাই বিশ্বের মাঝে সেরা হতাম!


শাহানা সিরাজী
কাব, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

আরও লেখা পড়ুন।

একটু কথা অল্প কথা : জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ – শাহানা সিরাজী

আরও লেখা পড়ুন।

মিষ্টি কুমড়ো ও হ্যালোইন – শাহানা সিরাজী

আরও লেখা পড়ুন।

ঘুরে এলাম স্ট্যাচু অব লিবার্টি – শাহানা সিরাজী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top