একটু কথা অল্প কথা : জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ – শাহানা সিরাজী

Picsart_23-12-03_22-30-55-580.jpg

একটু কথা অল্প কথা : জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ – শাহানা সিরাজী

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ উপহাস, অশালীন কথা বার্তা চলছে। শিক্ষার সাথে যারা সরাসরি যুক্ত তারা জানেন আসলে কী হতে চলছে। আমি যেহেতু মধ্যমসারির একজন তাই ভাবছি দুটো কথা বলি।
আমাদের এ অঞ্চলে সুলতালি আমল, বাদশাহী আমল, নবাবী আমল,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী,বৃটিশ, পাক- সব আমলেই শিক্ষার ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য – উদ্দেশ্য ছিলো। সবাই যার যার লাভের কথা ভেবে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন কলোনিয়াল শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের করে একটি দক্ষ জনশক্তি তৈরির কথা চিন্তা করেছিল। কিন্তু আমাদের তৎকালীন মানসিকতার জন্য তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে আমাদের দেশ থেকে যখন মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি বেচা শুরু হলো সব অদক্ষ লোকের শ্রম অল্প টাকায় বিক্রি হলো। যে পরিমান পরিশ্রম আমাদের দেশের মানুষ প্রবাসে করে তা এ দেশের সাধারণ মানুষ এমন কী মা,প্রিয়তমা স্ত্রীও জানে না! আমাদের সে সব পুরুষ যারা এ দেশের কলোনিয়াল পদ্ধতিতে দু কলম পড়েছে, যারা বেশি কলমও পড়েছে প্রবাসে তা চিঠি পত্র লেখা ছাড়া ধোপে আর কিছুই টেকেনি!

এখন হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। এ ফোনের একজন নিশ্চয়ই উদ্ভাবক আছে। তিনি কী ভাবে পারলেন? আচ্ছা আরও সহজ করে বলি, আপনি এম এ পাস। ঘরের বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গিয়েছে। আপনি ঠিক করতে পারেন? ডেকে আনেন একজন মিস্ত্রি যিনি এম এ পাস করেননি কিন্তু হাতে-কলমে, ব্যবহারিক ভাবে শিখেছেন।
এখন যদি স্কুল এই কাজটি শেখাতো আপনাকে তাহলে আপনি নিজেই তা ঠিক করতেন, তাই না?

এখন আসুন শিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি?
সবাই নিশ্চয়ই মতামত দেবেন। আমি এক কথায় বলি- জীবন যাপনের পথে উদ্ভুত সমস্যা সমাধান করতে পারাই শিক্ষা।
জীবন যাপনের জন্য কী লাগে?
আমরা তো আর বানর শিম্পাঞ্জি নয়- যেখানে খাবো সেখানে হাগবো!
এ দেশের কত পার্সেন্ট লোক নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখে? যেমন ধরুন- দাঁত ব্রাশ করা, কান -নাক চুল- নখ ক্লিন রাখা, নিজের পা পরিষ্কার রাখা, পোশাক আশাক পরিষ্কার রাখা, সুষম খাবার খাওয়া, ঘর-বাড়ি, বিছানা-পত্র গুছিয়ে রাখা আঙিনা পরিষ্কার রাখা, নিজের খাবারের ঘর,রান্না ঘর,ওয়াশ ব্লক পরিষ্কার রাখা এসব করে? যদি করতো আমাদের সারা দেশ বাগাড় হয়ে থাকতো না!
যারা বাসাবাড়িতে থাকেন তাদের অধিকাংশ কাজের লোক দিয়ে সারেন। সেই কাজের লোক যদি স্মার্টলি এ সব না পারে তাহলে আপনাকেই আবার করতে হচ্ছে। প্রায়শ: শুনি আমার কাজের লোক বিছানা গুছাতে পারে না,পাতিল মাজা হয় না,ডিম ভাজতেও পারে না, ভর্তাটা কাজের লোকের হাতে খাওয়ই যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি…. এর কারন কাজের লোকের শিক্ষা নেই। আপনি যদি ভালো ভাবে পারেন তবে তা কারো কাছ থেকে শিখেছেন। অর্থাৎ আপনাকে শিখতেই হবে।
যদি স্কুলে প্রাত্যহিক জীবনের এ সব দিক শেখানো হয় তাতে আপনাদের সন্তান নিজের হাতেই সব করতে পারবে। মনে রাখবেন, যত কম টাকায় এখন বুয়া(!) নামক নারীদের শ্রম কিনে নিচ্ছেন সে দিন বেশি দূরে নয় এসব বুয়া থাকবে না। কারণ স্মার্টফোনের মাধ্যমে বিশ্ব হাতের মুঠোয়। যেখানে শ্রমের মূল্য পাবে সেখানে যাবে। আপনার কাছে অল্প টাকায় শ্রম বিক্রি করবে না।
বর্তমান শিক্ষাক্রম মুখস্ত বিদ্যাকে খোদা হাফেজ জানিয়ে সমস্যা কী সমাধান করা যায় সেদিকে নজর দিয়েছে।
এখন যা সিলেবাস আগেও তাই ছিলো। পার্থক্য হলো আগে অভিভাবক,কোচিং সেন্টার, গাইড বিজনেসম্যানেরা ইচ্ছামতো শিক্ষার্থীদের পাখি বানিয়ে রাখতো এখন সে সুযোগ নেই। ফলে কোচিং সেন্টারে সন্তানকে দিয়ে গোসিপ করার দরকার পড়বে না, বাড়তি কোচিং ফি লাগবে না, শিক্ষার্থীদের উপর জুলুম করার প্রয়োজন হবে না তাই সবার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে।
অভিভাবক বইগুলো ভালো করে দেখুন, হয়তো আপনি বুঝতেও পারছেন না আসলে কী হচ্ছে!

এবার একটা উদাহরণ দিই-
আমরা প্রথম শ্রেণি হতেই বিভিন্ন প্রাণীর সাথে পরিচিতি ঘটাই।আপনারা বলবেন আমার বাচ্চা প্রাণী চিনে কী করবে?
উত্তরটি দিয়ে দিলাম- প্রাণী জগৎ বিশাল। মানুষও প্রাণী। তাই অন্যান্য প্রাণী সম্পর্কে তার ধারণা পরিষ্কার ভাবে থাকতে হবে। বিভিন্ন প্রাণীর, ডাক, বৈশিষ্ট্য, রঙ, খাবার,আবাস, উপকারিতা,অপকারিতা সবই জানতে হবে। না হয় এ পৃথিবীতে সে সারভাইভ করবে কী ভাবে?
আমি শিউর যে সব অভিভাবক এ সব নিয়ে চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে তারা জানেই না পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন কোথা থেকে তৈরি হয়? এতো সাধের পারফিউম কোথা হতে কী ভাবে আসে! যারা বিশদ ভাবে প্রকৃতিকে চিনেছে তারাই বর্তমান সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে এবং নিয়ে যাচ্ছে।

মনে করুন আপনার সন্তান গরু সম্পর্কে জানবে। আপনি দশ লাইন লিখে মুখস্ত করিয়ে
১০/১০ পাইয়ে দিলেন। কিন্তু এ শিক্ষার্থী জীবনে গরু দেখেনি। একদিন নেকড়ে দেখে ভাবলো গরু। তাহলে অবস্থা কী হবে বলুন?
বর্তমান ক্যারিকুলামে শিক্ষার্থী গরু দেখবে,ধরবে, আঁকবে, গরুর ডাক শুনবে । নিজেই গরু সম্পর্কে লিখবে, শিখবে যাতে অন্য প্রাণীর থেকে গরুকে আলাদা করতে পারে।
আপনি কোন ব্যবস্থাকে ইফেক্টিভ বলবেন?
এবার আসুন – আমাদের দেশে প্রায় আগুন লাগে। এ সময় আমরা হতবুদ্ধ হয়ে পড়ি। ভূমিকম্প হলে, বন্যা হলে আমাদের নানান সমস্যা হয়। এ ব্যাপারগুলো পড়ে মুখস্ত করে খাতায় লেখা আর প্লট তৈরি করে নাটক বা অভিনয়ের মাধ্যমে যদি শেখানো হয় তাহলে তার মুখস্ত করার প্রয়োজন হবে কী? ভূমিকম্পের কারণ কী ফলাফল কী, বন্যা কেন হচ্ছে,এর ফলে কী কী ক্ষতি হয়, কী কী উপকার হয়, কী ভাবে এ সব সমস্যা সমাধান হয়।এগুলো মুখস্ত করার কথা নাকি চিন্তা করার কথা?

বৈদ্যুতিক বিপর্যয় যখন হয় তা কতটা বিপজ্জনক সবাই জানেন, তা যদি অভিনয়, বা প্রচলিত সংস্কৃতি অনুযায়ী জারি সারি,পালা গানের মাধ্যমে শেখানো হয় তা মুখস্ত করার দরকার হয়?

ডিসিপ্লিন নিয়ে রচনা মুখস্ত করেনি এমন সাক্ষর লোক কমই আছে। কিন্তু আমাদের দেশে ডিসিপ্লিনের এতো অভাব কেন? এখন ক্যারিকুলাম চাচ্ছে শিক্ষার্থী নিজেই ঠিক করুক ডিসিপ্লিন কী,কেন,কী ভাবে,কোথায়, কখন ইত্যাদি প্রশ্নের সঠিক উত্তর বের করুক।

ডিম ভাজা আর ভর্তা নিয়ে বেশ মিছিল হচ্ছে।
হবেই তো। এইচ এস সি পাস শিক্ষার্থীর মায়েরা গর্ব করে বলে আমার সন্তান কিছুই পারে না।

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর ( সাধারণ) পিটিআই মুন্সীগঞ্জ।
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

আরও লেখা পড়ুন।

মিষ্টি কুমড়ো ও হ্যালোইন – শাহানা সিরাজী

আরও লেখা পড়ুন।

ঘুরে এলাম স্ট্যাচু অব লিবার্টি – শাহানা সিরাজী

আরও লেখা পড়ুন।

পরদেশ – শাহানা সিরাজী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top