‘মাথামোটা’ জনপ্রশাসন কাঠামো থেকে বের হবে কবে?

‘মাথামোটা’ জনপ্রশাসন কাঠামো থেকে বের হবে কবে?

বিশেষ প্রতিবেদকঃ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদ দুটি, কর্মরত আছেন ১৩ জন। যুগ্ম সচিবের ছয় অনুমোদিত পদের বিপরীতে কাজ করছেন ২৭ জন। উপসচিবের ২৬টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৩৭ জন কর্মরত আছেন। কিন্তু সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের অনুমোদিত পদ আছে ৬৭টি কর্মরত আছেন মাত্র ২১ কর্মকর্তা।

শুধু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নয়, অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চিত্রও এমন। একাধিক মন্ত্রণালয়ের জনবল কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি, অপ্রয়োজনীয় পদ বিলুপ্ত না করায় এবং পদের চেয়ে বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ায় প্রশাসনে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তারাই একে ঠাট্টাচ্ছলে ‘মাথাভারী প্রশাসন’ বলছেন।

নিজেদের জনবল কাঠামো পর্যালোচনা করতে আগামীকাল বুধবার বৈঠকে বসছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এক বছর আগে সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের জনবল কাঠামো হালনাগাদ করার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। দায়িত্ব ছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা সবেমাত্র নিজেদের কাঠামো ঠিক করতে উদ্যোগী হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, পদ না থাকলেও সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে প্রতিবছর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অন্য ক্যাডারে এভাবে পদোন্নতির সুযোগ নেই। ফলে তাঁদের মধ্যে এই নিয়ে সমালোচনা আছে।

আবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেলেও পদ না থাকায় তাঁদের বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের দপ্তরে নিচের পদে কাজ করতে হচ্ছে। এ নিয়ে তাঁদের অনেকের মধ্যে অস্বস্তি আছে। জনবল কাঠামো হালনাগাদ করা থাকলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

৪০ বছরের এই সমস্যা সমাধানে জনপ্রশাসনের জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে স্থায়ী পদের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা) খোরশেদা ইয়াসমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আগামীকালের বৈঠকের দিকে তাই প্রশাসনের অনেকের দৃষ্টি।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অতিরিক্ত সচিবের ১৩০টি পদের বিপরীতে ৩৯৮ জন এবং যুগ্ম সচিবের ৪৫০টি পদের বিপরীতে ৮৭৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।

একইভাবে উপসচিবের এক হাজার ছয়টি পদের বিপরীতে রয়েছেন এক হাজার ৭০৯ জন কর্মকর্তা। তবে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতি হলেও অন্যান্য ক্যাডারে তা হচ্ছে না। তাঁরা শূন্য পদ না থাকায় পদোন্নতি পাচ্ছেন না। জনবল কাঠামো হালনাগাদ না হওয়ায় সেখানে নতুন পদও সৃষ্টি হচ্ছে না। কিন্তু গত ৪০ বছরে আগের চেয়ে অন্যান্য ক্যাডারের কাজ বেড়েছে কয়েক গুণ।


জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমরা নতুন পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে পদ সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ নিয়ে কাজ করছে। জনবল কাঠামো হালনাগাদ হলে পদের বেশি পদোন্নতির দুর্নাম আর থাকবে না। চাহিদা অনুযায়ী স্থায়ী পদ সৃজন হলে পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতিও দেওয়া হবে না। ’

পদের অতিরিক্ত কর্মকর্তা পদোন্নতি দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন সরকারের প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ৭০০টি, সব প্রকল্পে একজন করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প তৈরি হলেও সে জন্য আলাদা অর্গানোগ্রাম তৈরি করা যায় না। অনেক মন্ত্রণালয় সেখানে নিজেদের কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায়, সেখানেও জনপ্রশাসন থেকে কর্মকর্তা দিতে হয়েছে।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব শওকত হোসেন মোল্যা গণমাধ্যমে বলেন, ১৯৮৩ সালে এনাম কমিটি যখন জনবল কাঠামো তৈরি করে, তখন বেশির ভাগ কলেজে অনার্স-মাস্টার্স ছিল না। বর্তমানে সরকারি কলেজগুলোতে ৫০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। অথচ শিক্ষকের পদ আছে মাত্র ১৬ হাজার ৩৮টি। ফলে অনেক বিভাগ চলছে একজন শিক্ষক দিয়ে। এ ছাড়া শূন্য পদ নেই বলে পদোন্নতিও আটকে রয়েছে। হাজার হাজার কর্মকর্তা থাকলেও একজন কর্মকর্তারও গ্রেড-১ নেই। তিনি বলেন, পদ সৃজনের দায়িত্ব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। তারা অন্যান্য ক্যাডারের পদ সৃজন করছে না। কিন্তু নিজেরা সুপারনিউমারারির নামে (সংখ্যাতিরিক্ত পদ) পদোন্নতি নিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতি দেওয়া জন্য তাঁরা বহুবার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

একইভাবে বিসিএস কৃষি, খাদ্য, তথ্য, কর, গণপূর্ত ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, আগের তুলনায় তাদের কাজের পরিধি বেড়েছে অনেক। কিন্তু নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়নি। এতে সরকারি কিছু অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিনরাত কাজ করছেন, আবার অনেকের পদ থাকলেও কাজের তেমন সুযোগ নেই। কর্মকর্তারা বলেন, যেসব দপ্তরের ক্ষমতা বেশি, তারা ইচ্ছামতো নতুন পদ সৃজন করে নিয়েছে। যেগুলোর ক্ষমতা কম, সেগুলোতে বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য রয়েছে।

হালনাগাদে সাড়া নেই মন্ত্রণালয়গুলোর : সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পুরনো কাঠামো দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ৩৯ বছর পর ২০২১ সালে জনবল কাঠামো হালনাগাদের উদ্যোগ নেয় সরকার। এ জন্য দুই দিনব্যাপী আন্ত মন্ত্রণালয় সভা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজমের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিবরা। কিন্তু কাজ এগোয়নি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়,১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে প্রণীত এনাম কমিটির সুপারিশ ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী চলছে প্রায় সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর। কমিটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার এনামুল হক খানের নামানুসারে এ কমিটি এনাম কমিটি নামে পরিচিত।

নিয়ম না মেনে সৃজন হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদ : গত ৪০ বছরে কোনো ক্যাডারের পদ হালনাগাদ না হলেও নিয়ম না মেনে কয়েক হাজার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে। সিনিয়র সচিব, সচিব পদমর্যাদায় গ্রেড-১, অতিরিক্ত আইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও সৃষ্টি করা হয়। আর বাণিজ্য, জনস্বাস্থ্যের মতো ক্যাডারগুলো পদ সৃষ্টির অনুমোদন নিতে না পেরে প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ বৈষম্যের কারণে তথ্য, বাণিজ্য ও সমবায় ক্যাডার প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হতে সরকারের কাছে আবেদনও করেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি অনুবিভাগ) আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন গণমাধ্যমে বলেন, নিয়মিত পদ বিলুপ্ত ও সৃজন হলে এই সমস্যা থাকবে না। সেই উদ্যোগই এখন নেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top