নৌযানের রুট পারমিট বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে
বিশেষ রিপোর্টঃ যাত্রীবাহী লঞ্চের পাশাপাশি স্পিডবোট এবং পণ্য ও বালুবাহীসহ সব ধরনের নিবন্ধিত নৌযানের রুট পারমিট নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নতুন অর্থবছরে (২০২১-২০২২) এটি কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
১১ ক্যাটাগরিতে নৌযানের আকার ও ধরনভেদে ভিন্ন ভিন্ন রুট পারমিট ফি আদায়ের প্রস্তাব সম্প্রতি অনুমোদনের জন্য নৌমন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সংস্থাটি। এতে নৌযানভেদে বছরে ৪০০ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত রুট পারমিট ফি আরোপের প্রস্তাব করা হয়। এ বিধান পুরোপুরি কার্যকর হলে রুট পারমিট ছাড়া নিবন্ধিত নৌযান চলাচল করতে পারবে না।
এতে বিপাকে পড়বে সরকারের কয়েকটি সংস্থা। নতুন নিয়মের শর্তে বন্ধের উপক্রম হবে বিআইডব্লিউটিএ’র ঐতিহাসিক সাতটি ড্রেজারসহ বেশ কয়েকটি নৌযান এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ঐতিহ্যবাহী স্টিমার লেপচা, টার্ন ও মাসুদসহ প্রায় অর্ধশত নৌযান। এই বাধ্যবাধকতা আরোপের কঠোর বিরোধিতা করছেন নৌযান মালিকরা।
বর্তমানে শুধু যাত্রীবাহী লঞ্চের রুট পারমিট নেওয়া বাধ্যতামূলক। দেশের ২২৭টি নৌপথে ৭৮০টি লঞ্চের রুট পারমিট রয়েছে। নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত নৌযান রয়েছে ১৩ হাজার ৪৮৬টি। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক অনিবন্ধিত নৌযানও চলাচল করছে। বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, নৌপথে শৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে এ বিধান কার্যকর করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, নতুন অর্থবছরে সব নৌযানের জন্য রুট পারমিট বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। এতে রুট পারমিট ফি থেকে সংস্থার রাজস্ব আদায় বাড়বে, অপর দিকে নৌপথে শৃঙ্খলা আসবে। কোন অঞ্চলে কতটি নৌযান চলাচল করবে তা ঠিক করে দেওয়া যাবে। অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাস্তবায়নের প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। সেগুলো আলোচনা করে সমাধান করা হবে।
জানা গেছে, ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ (নৌরুট পারমিট, সময়সূচি ও ভাড়া নির্ধারণ) বিধিমালা’ ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর জারি হয়। এ বিধিমালা জারির আগে শুধু লঞ্চের রুট পারমিট নেওয়ার বিধান ছিল। নতুন বিধিমালায় সব ধরনের নৌযানকে রুট পারমিট নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে সারা দেশকে ১৫টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। তবে দেড় বছরেও এ বিধিমালা পুরোপুরি কার্যকর করেনি বিআইডব্লিউটিএ।
এমনকি বিধিমালার ৩৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী রুট পারমিট ফি নির্ধারণ করেনি। সম্প্রতি ১২ ধরনের নৌযানের আকার ও শ্রেণি অনুযায়ী ফি আরোপের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় বিআইডব্লিউটিএ। ৭ জুন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় রুট পারমিট নেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতা থেকে কাঠের নৌকা বাদ দেওয়া হয়। বাকি ১১ ধরনের নৌযানের রুট পারমিট নেওয়া ও এ সংক্রান্ত ফি দেওয়ার প্রস্তাব বহাল রাখা হয়।
বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে যাত্রীবাহী লঞ্চ রুট পারমিট নেওয়ায় তারা আইন লংঘন করলে বিআইডব্লিউটিএ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু অন্যান্য নৌযানের রুট পারমিট না থাকায় তারা যথেচ্ছা চলাচল করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এমনকি সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া চলাচল করে বালুবাহী বাল্কহেড। এসব বাল্কহেড সব নিয়ম লংঘন করে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙর থেকেও পণ্য পরিবহণ করে। রুট পারমিটের বিধান চালু হলে কোনো নৌযান রুটের বাইরে চলতে পারবে না।
তবে রুট পারমিট বিধিমালা কার্যকর হলে পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মো. খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, ট্রাকের কোনো রুট পারমিট থাকতে পারে না। তেমনি মালবাহী নৌযানেরও কোনো নির্দিষ্ট রুট থাকতে পারে না। যখন যেখানে ট্রিপ পাবে সেখানেই যাবে- এটাই তার রুট। এর বাইরে কোনো রুট বেঁধে দেওয়া হলে সেখানে ট্রিপ নাও পেতে পারে।
নিবন্ধিত ১১ ধরনের নৌযান চলাচল করতে হলে রুট পারমিট নিতে হবে। এতে রয়েছে সব ধরনের যাত্রীবাহী লঞ্চ, পরিদর্শন জাহাজ, ভ্রমণতরী, পর্যটকবাহী জাহাজ, প্রশিক্ষণ জাহাজ, স্পিডবোট ও ওয়াটার ট্যাক্সি। এছাড়া রয়েছে পণ্যবাহী জাহাজ, বালুবাহী নৌযান, তেলবাহী জাহাজ, এলপিজি ট্যাংকার, উদ্ধারকারী জাহাজ, ড্রেজার, ফিশিং বোট ও ফেরি। জাহাজের শ্রেণি ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ৪০০ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বছরে রুট পারমিট ফি দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে রুট পারমিট না নিলে জরিমানাও দিতে হবে। রুট পারমিট ছাড়া চলাচল করলে জাহাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাব অনুযায়ী, কোনো নৌযানকে রুট পারমিট পেতে হলে ওই নৌযানের রেজিস্ট্রেশন সনদ ও সার্ভে সনদ (ফিটনেস সনদ) থাকতে হবে। সার্ভে সনদের মেয়াদ যতদিন থাকবে, রুট পারমিটও ততদিন বহাল থাকবে। এ শর্তের জালেই আটকা পড়বে বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির প্রায় অর্ধশত নৌযান।
১৯৭২ ও ১৯৭৫ সালে সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করে বিআইডব্লিউটিএ। সেগুলোর বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এছাড়া পরিদর্শন জাহাজ হাতিয়া, সালমা, সুরাইয়া, আজরা, উদ্ধারকারী জাহাজ হামজাসহ আরও অন্তত ২০টির বেশি জাহাজের বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। একইভাবে বিআইডব্লিউটিসির ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার অস্ট্রিচ, মাসুদ, লেপচা, শেলা, উপকূলীয় জাহাজ মতিন, মনিরুল হকসহ ১০টির বেশি জাহাজের বয়স ৪০ বছরের বেশি।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ অনুযায়ী, প্রতিটি নৌযান সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। এর বেশি বয়সি হলে সেগুলোর সার্ভে সনদ দেয় না নৌ মন্ত্রণালয়ের আরেক সংস্থা নৌপরিবহণ অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের যেসব জাহাজের বয়স ৪০ বছরের বেশি সেগুলোর সার্ভে সনদ নেই। তবে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের বিশেষ অনুমতি নিয়ে চলে। এখন যদি রুট পারমিট বিধিমালা কড়াকড়ি করে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে এসব জাহাজ আউট অব সার্ভিস হিসাবে বিক্রি করে দিতে হবে।