সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমুলের টাকার উৎস কি?
স্টাফ রিপোর্টঃ বাংলাদেশের টাকায় লন্ডনে চারটি কোম্পানি খুলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। এসব প্রতিষ্ঠানে শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িতসহ ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। বিনিয়োগকারী ভিসায় গিয়ে নাজমুল এখন বিলেতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
অনুসন্ধানে নাজমুলের নামে ব্রিটেনের কোম্পানি হাউজে আবাসন, গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট ক্লেইম ম্যানেজমেন্ট, পণ্যের পাইকারি বিক্রেতা, বিজ্ঞাপন, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের ছয়টি কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটি কোম্পানির পরিচালক পদে তার নাম নেই। বাকি চার?টি কোম্পানির ম?ধ্যে একটির একক পরিচালক এবং আরো তিনটি কোম্পানির যৌথ পরিচালক হিসেবে তিনি রয়েছেন।
২০১১ সালের ১০ ও ১১ জুলাই সম্মেলনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। ছাত্ররাজনীতিতে সততার কথা বলা এবং নিজেকে একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান দাবি করে আসছিলেন নাজমুল। জামালপুর পৌরসভার পাথালিয়া গ্রামের বাসিন্দা নাজমুলের বাবার নাম খায়রুল ইসলাম শাহজাহান। খাদ্য অধিদপ্তরের পিয়ন থেকে নাজমুলের বাবা এখন খাদ্য ইন্সপেক্টর।
জানা গেছে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে নাজমুলের কোটি কোটি টাকার নিবন্ধিত বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে নাজমুল আলম বিনিয়োগকারী ভিসায় যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। ব্রিটিশ সরকারের আইন অনুযায়ী, এই ভিসা পেতে ন্যূনতম ২ লাখ পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় ২ কোটির বেশি) বিনিয়োগ করতে হয়। জানা যায়, ফ্লেক্সফগ লিমিটেড, এলিট সিটি লিমিটেড, নাজ ইউকেবিডি প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এসএনবি অটোস লিমিটেড, এসএনআর ইউকে বিডি লিমিটেড ও কার মিউজিয়াম লিমিটেড নামে ছয়টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাজমুল যুক্ত। এর মধ্যে ইস্ট লন্ডনের কেনন স্ট্রিট রোডে নাজ ইউকেবিডি প্রোপার্টিজ নামের আবাসন ব্যবসার একক পরিচালক তিনি, যার মূলধন দেখানো হয়েছে সাড়ে ৮ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় যা ১০ কোটির সমান। কোম্পানিটি ২০১৮ সালের ১০ জুলাই নিবন্ধিত হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রিন রোডের পাশে পান্ডারসন গার্ডেনে রয়েছে ফ্লেক্সফগ লিমিটেড নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যেটি ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি কোম্পানি নিবন্ধন করা হয়। এই ব্যবসার ধরন দেখানো হয়েছে নন-স্পেশালাইজড হোলসেল ট্রেড, অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সি এবং অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, যা আগে লিঙ্কমোর ইউকে লিমিটেড নামে পরিচিত ছিল। এই কোম্পানিতে নাজমুল এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। কোম্পানিতে আরো দুই জন পরিচালক রয়েছেন।
তৃতীয় কোম্পানি এলিট সিটি লিমিটেড। এটি সেন্ট্রাল লন্ডনের বসওয়েল স্ট্রিটে অবস্থিত। এই কোম্পানি ২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট নিবন্ধিত হয়। এই কোম্পানির ব্যবসার ধরন হচ্ছে এমপ্লয়মেন্ট প্লেসমেন্ট এজেন্সি ও টেম্পোরারি এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি এক্টিভিটিস। এই কোম্পানির জন্মলগ্ন থেকে নাজমুল যৌথ পরিচালক হিসেবে আছেন। চতুর্থ কোম্পানি এসএনবি অটোস লিমিটেড বেথনাল গ্রিনের ২৫ পান্ডারসন গার্ডেনে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নিবন্ধিত হয়। এই কোম্পানির ব্যবসার ধরন হিসেবে বলা হয়েছে রেন্টিং অ্যান্ড লিজিং অব কারস অ্যান্ড লাইট মোটর ভেহিক্যাল। শুরু থেকে এই প্রতিষ্ঠানেরও পরিচালক হিসেবে আছেন নাজমুল ও মোহাম্মদ রুহুল আমিন। এছাড়া এসএনআর ইউকে বিডি লিমিটেডে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নাজমুল পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেও ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি পদত্যাগ করেন। একইভাবে কার মিউজিয়াম লিমিটেডে ২০১৬ সালের ২৮ জুন পরিচালক পদে যোগ দিয়ে তিন দিনের মাথায় ২০১৬ সালের ১ জুলাই পদত্যাগ করেন তিনি।
নাজমুল ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে লন্ডনে তার কোনো কোম্পানি নেই বলে চ্যালেঞ্জ করেছেন। স্ট্যাটাসে তিনি যুক্তি হিসেবে বলেন, ‘লন্ডনে একটা কোম্পানি খুলতে খরচ হয় ১২ পাউন্ড। চারটি কোম্পানি খুলতে খরচ হয়েছে ৪৮ পাউন্ড বাংলা টাকায় প্রায় ৪৯০০ টাকা, যা সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স খোলার চাইতেও কম। আর অপরিশোধিত মূলধন হিসেবে চাইলে আপনি যা ইচ্ছা দেখাতে পারবেন তার পরও আমার কোনো কোম্পানির অপরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫/৭ হাজার পাউন্ডের বেশি নয়; অথচ কি কাল্পনিক নিউজ?’ তিনি বলেন, ‘কোম্পানি যুক্তরাজ্যে চাইলে যে কেউ খুলতে পারে জাস্ট ২০ মিনিট সময় লাগে অনলাইনে। আমার কোম্পানিগুলোর নাম তো সবাই পেলেন এখন Companyhouse.gov.uk এখানে গিয়ে দেখলেই বুঝবেন সংবাদের সত্যতা কতটুকু।’
ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্নের দায়ে অভিযুক্ত সাবেক এই নেতা লন্ডনেও দলবল নিয়ে চলেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বে আছেন সভাপতি সুলতান শরীফ এবং সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক। এই কমিটির বিরুদ্ধে সক্রিয় যে গ্রুপ রয়েছে তাদের সঙ্গেই চলেন নাজমুল। লন্ডনে নাজমুলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে থাকেন রুহুল আমিন শিপলু, মো. শরফুল হাসান, শাহ মিনার আলী। এদের মধ্যে রুহুল আমিন শিপলু এক সময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। তাকে যুক্তরাজ্য যুবলীগে যুক্ত করেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে আসেন। তখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাজমুলকে বক্তব্যের সুযোগ করে দেন আনোয়ারুজ্জামান। নাজমুলকে দেখে প্রধানমন্ত্রী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নাজমুলকে বক্তৃতা দিতে দেখেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মঞ্চে বসেই তাত্ক্ষণিক হাতের ইশারায় জানতে চান, সে কীভাবে এখানে এলো। কে বক্তব্যের সুযোগ দিয়েছে নাজমুলকে। অবস্থা বেগতিক দেখে মিনিট পার হওয়ার আগেই বক্তব্য শেষ করতে হয় তাকে। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকাকালে নাজমুল থাইল্যান্ডে প্রচুর অর্থ পাচার করে বিনিয়োগ করেন। ঢাকায় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে তার নামে প্লট রয়েছে। তার প্রায় শতাধিক গাড়ি রয়েছে যেগুলো ঢাকায় উবারের সেবায় যুক্ত।
সূত্র জানায়, আয়ের কোনো ইতিহাস না থাকায় (ক্রেডিট স্কোর) নাজমুল নিজ নামে এখনো বাড়ি কিনতে পারেননি। তবে তার টাকা ঘনিষ্ঠজনদের নামে প্রপার্টিতে বিনিয়োগ করা আছে বলে জানা গেছে।