সহনীয় মাত্রার সরল দুর্নীতি!

PicsArt_07-20-01.48.08.jpg

সহনীয় মাত্রার সরল দুর্নীতি!

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের একটি কথাকে কেন্দ্র করে বাপক আলোচনা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক সম্মেলনের পঞ্চম ও শেষ দিন গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সম্পর্কিত অধিবেশনে তিনি বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম কোনো অপরাধ নয়। তবে তিনি এও বলেছেন, সেটি প্রমাণ করতে হবে যে সরল বিশ্বাসে আপনি এ কাজটি করেছেন।

একবার আমরা শুনেছিলাম সহনীয় মাত্রার ঘুষের কথা। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের বলেছিলেন “ঘুষ খান, তবে সহনীয় মাত্রায় খান।”এবার সরল দুর্নীতির কথা জানা গেল। পাবলিক সার্ভিস অ্যাক্টে প্রসঙ্গ টেনে এনে তিনি বলেছেন সরল বিশ্বাসে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি কিছু করে তাহলে সেটা বড় কোন দুর্নীতি হলেও তা কোনো অপরাধ নয়।



এই সরল বিশ্বাস প্রমাণ করাটা কঠিন। তবে ভাবনার বিষয় এই যে, এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কাছে এই বার্তা গেল কিনা– ‘দুর্নীতি করলেও কিছু হবে না, কারণ সেটা সরল বিশ্বাসে হয়েছে।’ এমনিতেই আমাদের প্রশাসনিক স্তরে অতি উচ্চ মাত্রার দুর্নীতির সংস্কৃতি বিরাজমান। তার ভেতর এমন কোন সংকেতকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য কোন আসকারা কিনা সেটা তিনিই ভাল বুঝবেন।

দুর্নীতির একটা দীর্ঘ তালিকা এসেছিল জাতিসংঘ থেকে ২০০৮ সালে। ইউ এন ডি পি দুর্নীতি বিষয়ক একটি প্রাইমায় দুর্নীতির তালিকা দিতে গিয়ে বলেছিল ‘ঘুষ’ মানে কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে টাকা, সেবা বা অন্য কোনও সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।

‘জালিয়াতি’ মানে কোনও অন্যায্য সুবিধা পাওয়ার জন্য ভ্রান্ত বা মিথ্যা তথ্য পেশ করা। ‘মানি লন্ডারিং’ মানে কালো টাকা সাদা করা— অন্যায় পথে অর্জিত অর্থকে এক খাত থেকে অন্য খাতে পাঠিয়ে তাকে আইনি করে তোলা। ‘এক্সটর্শন’ মানে চাঁদাবাজি— ভয় দেখিয়ে বা জুলুম করে অন্যায্য ভাবে টাকা, সম্পত্তি বা কোনও গোপন তথ্য আদায় করা। ‘কিকব্যাক’ হল বখরা, অন্যায় ভাবে কিছু টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সেই টাকার একটা হিস্যা পাওয়া। ‘প্রভাব খাটানো’ মানে নিজের অবস্থানগত প্রতিপত্তির সুযোগ নিয়ে কাউকে কোনও অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।

‘ক্রোনিজম’ বলতে বোঝায় নিজের বন্ধুবান্ধবদের, তাদের যোগ্যতার কথা বিবেচনা না করেই বিভিন্ন সম্পদ বা কাজ বণ্টনের সময় বাড়তি সুবিধা করে দেওয়া। ‘নেপোটিজম’-ও অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, কিন্তু পরিবারের লোককে। ‘প্যাট্রোনেজ’ বা পৃষ্ঠপোষকতা হল কোনও ধনী বা প্রভাবশালী মানুষের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে পারা। কোনও দায়িত্ব পালনের সময় কোনও গোপন তথ্য জানতে পেরে পরে সেই তথ্যকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করার কাজটিকে বলে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’।

সরকারি লালফিতের ফাঁস আলগা করে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, তার নাম ‘স্পিড মানি’। পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে কোনও কাজের জন্য বরাদ্দ টাকার অধিকার হাতে পেয়ে তাকে আত্মসাৎ করা হল ‘তহবিল তছরুপ’।

এই তালিকা ধরলে, বাংলাদেশের সরকারি দফতর সমূহে সবই আছে। এক্সটর্শন, কিকব্যাক, প্যাট্রোনেজ, স্পিড মানি-কোনটি নেই? সরকারি সেবা পাওয়ার অধিকার জনগণের। কারণ তারা কর দিয়ে এই আমলাদের পালে। কিন্তু সেবা পেতে গিয়ে পদে পদে অর্থ খরচ করতে হয় মানুষকে।

জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দুর্নীতি বিষয় এজেন্ডায় থাকাটা শুভ লক্ষণ। তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কঠোরতা বা স্বচ্ছতা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যে ক্ষেত্রেই ঘটুক, ব্যক্তি খাত বা সরকারি অফিস, বড় দুর্নীতি মানেই এতে রাজনীতির সংশ্রব আছে। সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটিকে অবশ্যই স্বচ্ছতর করা সম্ভব, কিন্তু সরকারি কাজে কর্তাদের নিজস্ব বিবেচনার অধিকার এবং তার সম্ভাব্য অপপ্রয়োগকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ দিন শেষে সব কিছু রাজনীতিরই অংশ।

নির্বাচনের সময় দলীয় বা প্রার্থীরা কিভাবে কত টাকা খরচ করেন? এই প্রশ্নের উত্তর কি কখনও আমরা পেয়েছি? পাইনি। নির্বাচন কমিশন একটি সীমা ঠিক করে দেয়। কিন্তু আমরা সবাই জানি তার চেয়ে সহশ্র গুণ বেশি খরচ করেন প্রার্থীরা। সেই টাকা আসে কোথা থেকে আর খরচ হয় কিভাবে, তার কোন চেনাজানা পথ জানা নেই কারও। এই অর্থের বড় একটা অংশই সংগৃহীত হয় চাঁদাবাজি থেকে আর প্রভাব খাটিয়ে নিজের অবস্থানগত প্রতিপত্তির সুযোগ নিয়ে কাউকে কোনও অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দিয়ে।




মূল প্রশ্ন নৈতিকতার। রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির তাগিদে যখন প্রার্থী-বাছাই পর্বে পেশিশক্তি, দাগি দুষ্কৃতীদের টিকিট বিতরণ করে, তখনই তো অগ্রাধিকার ঠিক হয়ে যায়। আজকাল রাজনীতিকরাই আফসোস করে বলেন ভাল রাজনীতিকের জায়গা নেই, মূল্যায়ন নেই। এর সুযোগ খুব দ্রুত নেয় আমলাতন্ত্র।

আমাদের সরকারি অফিসে টাকা না দিলে কোন কাজ হয় না, কেউ কাজ করে না, এমন একটা ধারণা খুবই প্রচলিত। ধারণাটা হয়তো সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু একেবারে অহেতুকও নয়। সরকারি অফিসে কর্ম সংস্কৃতি এমন যে, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তারাও স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন না। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল যেতেও অনেক সময় টেবিলের নিচে আর্থিক লেনদেন করতে হয়। এই সংস্কৃতিতে একজন সৎ কর্মচারী বিনা লেনদেনে ফাইল ছেড়ে দিলে তার কপালে দুর্ভোগ অবশ্যম্ভাবী।

এমন এক কর্মসংস্কৃতি যেখানে বিরাজমান সেখানে কোন দুর্নীতিই আসলে সরল বিশ্বাসে হয় না। একদিকে কাজে ফাঁকি, আরেকদিকে দুর্নীতি এই হল সামগ্রিক কর্ম সংস্কৃতি। সেখানে কিভাবে দুর্নীতি সত্যি প্রতিরোধ করা যাবে তা এক জটিল প্রশ্ন।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সাংবাদিক নেতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top