বিশেষ প্রতিবেদকঃ সরকারি চাকরিবিধি ও পুলিশ প্রবিধানে প্রতি তিন বছর পর বদলির নিয়ম থাকলেও পুলিশ বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা ঘুরেফিরে সদর দপ্তরেই থাকছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এক যুগের বেশি সময় ধরে আছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে এসব কর্মকর্তা এত দিন ধরে সদর দপ্তরে শিকড় গেড়ে আছেন। সদর দপ্তরে থাকা এসব কর্মকর্তার মধ্যে আছেন পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে। ঊর্ধ্বতনদের কয়েকজন দেশ থেকে পালিয়েও যান। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রদবদল করা হয়। কিন্তু তারপরও এসব কর্মকর্তার গায়ে কোনো আঁচ লাগেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ বছর ধরে সদর দপ্তরে কর্মরত আছেন—এমন কর্মকর্তার সংখ্যা অন্তত ৫০ জন। তাঁদের কেউ কেউ প্রভাবশালীদের কাছাকাছি থাকার সুবাদে বদলিও ঠেকিয়েছেন।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ বলেন, গত দেড় দশকে পুলিশের কাজ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ধীরে ধীরে এগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। মাঠের পুলিশিং ঠিক করে পুলিশ সদর দপ্তরেও হাত দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় বাহিনীর স্বার্থে বিশেষায়িত কাজের জন্য অভিজ্ঞদের একই জায়গায় রাখা হয়। তবে সেটা খুব বেশি না।’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বলেছেন, এভাবে কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিন শুধু সদর দপ্তরে কর্মরত থাকার বিষয়টিকে নিয়মের লঙ্ঘন ও পুলিশের শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাহিনীর সদর দপ্তরে তিনটি মূল বিভাগ—অ্যাডমিন ও অপারেশন, অর্থ ও উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (এইচআরএম)।
এই তিন বিভাগের অধীনে অন্তত ৫৩টি শাখা ও উপশাখা রয়েছে। আইজিপি এসব শাখাপ্রধানদের দিয়ে প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্যের পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করেন।
এসব শাখা-উপশাখায় ৭ জন অতিরিক্ত আইজিপি, ১২ জন ডিআইজি, ৩৮ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ৫৩ জন এআইজি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপারসহ প্রায় ২০০ কর্মকর্তার পদায়ন থাকে।
বর্তমানে তাঁদের মধ্যে অন্তত অর্ধশত রয়েছেন সর্বনিম্ন ৪ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ বছর ধরে।
ডিআইজি (লজিস্টিকস) মোহাম্মদ আতাউল কিবরিয়া প্রায় আট বছর ধরে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত। ২০১৬ সালে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার থাকা অবস্থায় পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি হয়ে সদর দপ্তরে যোগ দেন।
ডিআইজি (উন্নয়ন) শোয়েব রিয়াজ আলম ২০১৬ সালে সদর দপ্তরের এআইজি থাকাকালেই পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি হন। বিসিএস ১৭তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা প্রায় এক দশক ধরে সদর দপ্তরে।
তিনি সদর দপ্তরে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে ডেভেলপমেন্ট এবং কল্যাণ ট্রাস্টে কর্মরত ছিলেন।
ডিআইজি (উন্নয়ন) রুহুল আমিন ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন। এরপর ডিএমপিতে বদলি হন। ডিএমপিতে থাকা অবস্থায় পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে অতিরিক্ত ডিআইজি (ওয়েলফেয়ার) ছিলেন। চার বছরের বেশি সময় ধরে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত থাকা রুহুল আমিন এর আগে ডিআইজি (লজিস্টিকস) ছিলেন।
ডিআইজি আব্দুল্লাহ হেল বাকি ও আব্দুল জলিলও দীর্ঘদিন পুলিশ সদর দপ্তরে আছেন।
ডিআইজি (মানবসম্পদ) কাজী জিয়া উদ্দিন পুলিশ সদর দপ্তরে আছেন সাত বছর ধরে। অতিরিক্ত ডিআইজি ও এআইজি থাকা অবস্থায়ও তিনি সদর দপ্তরে ছিলেন। জানতে চাইলে কাজী জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘আমি নিজের প্রয়োজনে বা আগ্রহে নয়, অফিশিয়াল কাজের জন্যই হয়তো আমাকে সদর দপ্তরে রাখা হয়েছে। অনেক সময় দক্ষতার জন্য রাখা হয়। আমার বেলায়ও হয়তো তা-ই হয়েছে।’
পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে সদর দপ্তরে কর্মরত আছেন ডিআইজি (অর্থ) তাপতুন নাসরীন। তিনি ২০১১ সালের মে মাসে ডিএমপিতে অতিরিক্ত উপকমিশনার থাকাকালে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পান। এরপর বদলি হন পুলিশ সদর দপ্তরে। সদর দপ্তরে এআইজি থাকাকালে মিশনে যান। পরে ফিরে এসে সদর দপ্তরেই যোগ দেন। তিনি পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হলেও কর্মস্থল বদলায়নি তার।
সদর দপ্তরে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন আলোচিত কর্মকর্তা গাজী মো. মোজাম্মেল হক। তিনি সদর দপ্তরে আছেন প্রায় এক যুগ। পূর্বাচলে ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ নামে একটি আবাসন প্রকল্প করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সদর দপ্তরে ২০১১ সাল থেকে কর্মরত থাকা এবং বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গাজী মোজাম্মেল হককে কয়েক দফায় মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি ধরেননি। পরে তিনি নিজে থেকেও সাড়া দেননি।
অন্য অতিরিক্ত ডিআইজিদের মধ্যে ডিঅ্যান্ডপিএস-২ শাখার এহসান সাত্তার, ওভারসিজ অ্যান্ড ইউএন অপারেশন শাখার নাসিয়ান ওয়াজেদ, এমটি অ্যান্ড ওয়ার্কশপ শাখার মো. আবু হাসান, লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স শাখার মো. জিয়াউর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি শাহজাদা আসাদুজ্জামান, আতিকুর রহমান, নাসিরুল হক, পিএম-২ শাখার মো. জহিরুল ইসলাম পুলিশ সদর দপ্তরে আছেন ৫ থেকে ১০ বছর।
পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে এআইজি (এস্টেট) সাইফুল্লাহ বিন আনোয়ার, এআইজি (ইক্যুইপমেন্ট) মুহাম্মদ উল্লাহ, এআইজি (ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মিলন মাহমুদ, এআইজি মো. মঞ্জুরে আলম প্রামাণিক, এআইজি মো. মাহবুবুল করিম, এআইজি আলী হায়দার চৌধুরী এবং মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখার এনামুল হক সাগর দীর্ঘদিন পুলিশ সদর দপ্তরে রয়েছেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা ফেরদৌসী রহমান, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সাদিয়া আফরিনও দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত।
এসব কর্মকর্তা দীর্ঘদিন অন্যত্র বদলি না হয়ে ঘুরেফিরে সদর দপ্তরে কর্মরত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, এটি নিয়মের লঙ্ঘন ও পুলিশের শৃঙ্খলার পরিপন্থী। জনপ্রশাসনে নিয়মানুগ ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সুযোগ নেই।
সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে কোনো কর্মকর্তার একই স্থানে একই পদে তিন বছরের বেশি কাজ করার সুযোগ না থাকলেও এই সাধারণ নিয়মটি লঙ্ঘনের দৃষ্টান্তও ভূরি ভূরি।
তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলের আইন দিয়ে পুলিশকে জনগণের পুলিশ করা যাবে না, লাঠিয়াল বাহিনী বানানো যাবে। পুলিশকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হলে আইন পরিবর্তন করতে হবে।
আরও সংবাদ পড়ুন।
ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি সহ বাংলাদেশ পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য অনুপস্থিত
আরও সংবাদ পড়ুন।
পুলিশ সুপার পদায়নে ১ কোটি থেকে ৩ কোটি টাকা ঘুস নিতেন – সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কামাল
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর ও স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক হিসাব জব্দ
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শহীদুল হক গ্রেপ্তার
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করবে দুদক
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
বরিশালের সাবেক ডিআইজি জামিলের অবৈধ সম্পত্তি অনুসন্ধানে দুদকে আবেদন
আরও সংবাদ পড়ুন।
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. শামসুদ্দোহার অবৈধ সম্পদের পাহাড়
আরও সংবাদ পড়ুন।