ঘুরে এলাম স্ট্যাচু অব লিবার্টি – শাহানা সিরাজী
গতকাল গেলাম ম্যানহাটন। উদ্দেশ্য স্ট্যাচু অব লিবার্টি। নিয়ে গেলো আমার ভাই।সাথে তার পরিবার। আমরা বাসা থেকে বের হতে কিছু দেরিই হলো, তার উপর আমার হলো “হাঁদারামের” মতো চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকা। চারদিকে হুরদের ছড়াছড়ি, সুন্দর পথ ঘাট, নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল, ব্রুকলিন ব্রিজ, আন্ডারপাস,ওভারপাস সে এক হুলুস্থুল সুন্দর! আমাদের দেশটিও এমন হতে পারতো যদি রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট , নির্মাণের বরাদ্দের উপর” কমিশন,অমিশন,বেমিশন” না থাকতো! যদি এখানকার মানুষের মতো আমরা শ্রমের মর্যাদা দিতে পারতাম।
যাই হোক গাড়ি চলছে, কোথায় কতো কিলোমিটার স্পিড়ে গাড়ি চলবে তা পাশেই নির্দেশ দেয়া আছে। কাজেই গতি বাড়ানো যাচ্ছে না, রাস্তায় কোন প্রকার হর্ন নেই, কেবল সাঁই সাঁই গাড়ি-আমার মন ডুবে আছে ঢাকা শহরের লক্কর ঝক্কর গাড়ির ভেতর গাদাগাদি করে কোন রকমে দাঁড়ানোর স্মৃতিতে। চোখ বার বার ভিজে যাচ্ছে এই ভেবে – এখানে সভ্যতার পত্তন কবে হয়েছে?আমরা কেন আমাদের দেশে কীট পতঙ্গের মতো বেঁচে আছি। আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই এ সব দেশে এসে নিজেদের মেধা শ্রম দিয়ে কাজ করছে অথচ নিজের দেশের হাল করুণ!
আমাদের রাজনীতিবিদেরা অধিকাংশই ব্যক্তিগত উন্নতি করছে, বিদেশে শত-কোটি টাকা পাচার করছে, সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে, আমলারা অনেকেই ভাগ্য পরিবর্তন করে বিদেশ গিয়ে নাম-পরিচয়হীন শান্তির যাপন করছে
দেশের মাটি পুড়ে কিসের নেশায় ছুটছে কে জানে!
ম্যানহাটন পৌঁছলাম, হাডসন নদীর উপর স্ট্যাচু অব লিবার্টি। যেতে হবে ফেরিতে। ফেরিগুলো নারায়নগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জের লঞ্চের সাইজ হলেও আকার-প্রকৃতি-গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফেরিঘাট খুব বড় নয় । টিকেট কাটা হয় এক জায়গায় তারপর স্ক্যানিং পয়েন্টে গায়ের জামা ছাড়া সব স্ক্যান করে, সিকিউরিটি নিশ্চিত করে ফেরিঘাটে যেতে হবে।
আমার ভাই খসরুর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো,তবুও সিনেমার টিকেট যেমন আমাদের দেশে ব্ল্যাক মার্কেটিং হয় তেমনি কালোরঙের মানুষেরা তাকে আঁকড়ে ধরেছে, Can I talk to you, please? Can I help you please?
গুলিস্তানের বাজারের মতো, আপা আমার দোকানে আসেন, এক নম্বর কম্বল পাবেন! আমার ভাই যতোই বলে, Thank you ততোই
তাদের এপ্রোচ করেই যাচ্ছে। কালোরা আজীবন সুবিধা বঞ্চিত,দুঃখ-কষ্ট তাদের নিত্য সঙ্গী। বাঁচার চ্যালেঞ্জ বেশী। তারা কেউ ব্ল্যাকে টিকেট,কেউ নানান ধরণের সুভ্যানিয়র, কেউ ছোট ছোট খাবারের দোকান নিয়ে কাস্টমার ধরার চেষ্টা করছে। এ জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হা করে নিউইয়র্কের ভেতর অন্য নিউইয়র্ক দেখলাম, যাবার পথে দুজন ভিক্ষুক দেখলাম, মাথা খারাপ লোক একা একা বকবক করছে – দেখলাম। পৌর মার্কেটে পড়ে থাকা সেই পাগলীর চেহারা ভেসে উঠলো। উন্নত অনুন্নত সব জায়গায়ই অসহায় মানেই অসহায়। কলিজা কেঁপে উঠলো- দুনিয়ার কোন প্রাণীই না খেয়ে থাকে না বটে কেউ কেউ সে খাবার যোগাতে গিয়ে কোথা থেকে কোথা যাচ্ছে,কি না করছে!
আমার ভাই ফেরির ভেতরে ঢুকে চোরাকারবারীদের চেয়ে মন দামে টিকেট নিলো। তাতেও তার অনেক টাকা খরচ হলো,নিজের কাছে খারাপ লাগলেও এক ধরণের ভালো লাগা কাজ করছে। আমার ভাই আমাকে পেয়ে ভীষণ খুশি, ভায়ের বউ হাসতে হাসতে কুটিকুটি।” আপা জীবনে প্রথম আপনাকে পেয়েছি”। সে রান্না করছে, সার্ভ করছে আবার বেড়াতেও নিয়ে যাচ্ছে। সাথে সে বিভিন্ন ধরণের খাবার, পানীয় সাথে নিয়েছে। আমি কেবল গাছ,লতা পাতা সব কিছু দেখছি,এতো গাছ চারদিকে একটিও চিনি না। ছবি তুলতে তুলতে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমার ভাস্তি সামিরা, অষ্টম গ্রেডে পড়ে, সে এসে পাশে দাঁড়িয়ে যায়, তার বাংলার অবস্থা দারিদ্রতায় জর্জরিত! খুব কম কথা বলে, মা যা শিখিয়ে দেয় পাখির মতো বলে,
এবার লাইনে দাঁড়ালাম, বন্ধন-উৎসব বাসের কাউন্টারের মতো জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছি। ফেরিতে উঠার সময় একজন এনাউন্স করেই যাচ্ছে, please watch your step, be careful, Have a safe and nice time. Have fun.
ফেরি দোতলা,ছাদেও যাওয়া যায়। আমি লাইনের পেছনে। ফলে ছাদ, দোতলা সব ভরে গিয়েছে, আমার গ্রাউন্ডেই ভালো লাগলো। মনে হলো, মুন্সীগঞ্জ থেকে সদর ঘাটের লঞ্চে চেপেছি। হাডসন নদীর ঢেউ শীতলক্ষ্যার মতোই কিন্তু কচুরিপানা নেই। পানিতে পানির বোতল, বাদামের খোসা, পলিথিন, ময়লা আবর্জনা কিছুই নেই, সদর ঘাট, নারায়নগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ঘাটের পানির মতো দুর্গন্ধ নেই। ঠান্ডা হাওয়া মুখ চুল ছুঁয়ে যাচ্ছে। সবার চেয়ে আমার পোশাক ভিন্ন। নিজেকে বেমানান মনে হচ্ছে। এক পলকে মনে হলো, একজন ছাত্রীর দেখা পেলাম, আসসালামু আলাইকুম বলে কোথায় যে পালিয়ে গেলো খুঁজে পেলাম না। মুখটা চোখের সামনে ভাসছে…
ফেরি যতোই পার্কের দিকে এগুচ্ছে ততোই স্ট্যাচু দৃষ্টির ভেতর প্রবেশ করছে। ফেরি ভিড়লো। একই রকম এনাউন্স এবারো করলো।
পার্কে নেমেই গেলাম রেস্টরুম খুঁজছিলাম, ইয়া মোটা এক ভদ্রলোক মনে হয় আমার পোশাক দেখে জানতে চাইলেন,Hi,you are from?
ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেও বললাম, Hi, Bangladesh.
ব্যাটা হো হো করে হাসলো,ব্যাংলাডেশ! হুররে হু… তারপর ওয়েলকাম জানালো এবং বেড়াতে আসা নিরাপদ বলে পথ দেখালো।
ভেতরে সুন্দর একটা দোকান, চাবির রিঙ থেকে জামা সব কিছুতেই স্ট্যাচু অব লিবার্টির লোগো লাগানো জিনিসপত্র, কেউ দেখছে কেউ কিনছে, দরাদরি নেই। দোকান ঘুরে বের হলাম,
দেখলাম স্টাচু কী ভাবে মানুষের দৈনন্দিন কাজের জিনিসের ভেতর ঢুকে গেলো! আমার কিনতে ইচ্ছা হয়নি। হয়তো ডলারের জন্য ছেলে কিংবা ভায়ের কাছে বলতে হবে সে জন্য নয়তো জীবন থেকে উত্তাপ হারিয়ে গিয়েছে,কিছুই আর টানে না সে ভাবে! উলটে পালটে ভাঁজ করে রেখে দিলাম। সেখানে স্ট্যাচু অব লিবার্টির স্থপতির মূর্তি এবং নকশার গ্যালারি দেখলাম। জানতে চাইলাম ছবি তোলা যাবে কি না। হ্যাঁ সূচক সম্মতিতে ছবি তুললাম। মানুষের কতো অদ্ভুত নেশা থাকে। ফ্রেডরিক অগাস্ট বার্থল্ডি-এ ভদ্রলোককে মানুষ আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে তার কর্মের জন্য। কবি এমা লেজারাজ বিখ্যাত হলেন এ মূর্তি নিয়ে সনেট লিখে। ভাগ্য বটে!
পুরো পার্কের কোথাও বাদামের খোসা,কলার খোসা কিংবা পানির বোতল কিছুই নেই। ঝকঝকে পরিষ্কার। রেস্টুরেন্টের সামনে চেয়ার বেঞ্চ পাতা। একটা রাউন্ড টেবিলকে ঘিরে চেয়ার। আমাদের দেশে বই মেলার সময় এ রকম আয়োজন করে। খাবার নিজেকেই আনতে হয়। বাইরে জুসের মেশিন। নিজেরা খাবে নিজেরাই আবার ক্লিন করে রাখবে। এত মানুষ তবুও কোথাও ওয়ানটাইম ইউজ কাপের আবর্জনা চোখে পড়লো না। আমার ভাই আমার ছবি তুলে দিলো। সি-গার্ল উড়ে উড়ে খাবার খাচ্ছে। এগুলো এতোই আদুরে ধরতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু কেউ ধরে না। আমার ভাই বাদাম, বুট ছিটিয়ে দেয়ায় এক এক করে এক ঝাঁক সি-গার্ল চলে এলো। আমাদের চড়ুই পাখির মতো। সাবিত,সাদি,সাফির এবং সামিরা বেশ হাসাহাসি করলো। এখানে পাখিরাও নির্ভয়ে মানুষের কাছে আসে!
স্ট্যাচু ঘিরে নতুন করে কাজ হচ্ছে,গাছ লাগাচ্ছে স্পেস বাড়াচ্ছে। নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে এখানে কী কী কাজ হচ্ছে। দূরবীন বসানো আছে। কয়েন দিলেই দেখা সম্ভব। যার ইচ্ছা দেখছে। আমি দেখিনি। কারণ চশমা দিয়ে ওখান থেকে ভালোই দেখছি নিউইয়র্ক সিটি। সবটা ভিড়িও করেছি, হানি আপা, সঞ্চিতা আপাকে পাঠাবো। উনারা আমার কলিগ।
এরই মাঝে সিকিউরিটি এনাউন্স করছে সময় শেষ। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছি । ভেবেছি এলিভেটর নষ্ট। সেই সময় খুব নিচ দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিলো। ধরে নিয়েছি পার্কে কেউ আছে কি না চেক দিচ্ছে। পরে দেখলাম সত্যি তাই। পার্ক পুলিশ সাইকেল নিয়ে চক্কর দিয়ে সবাইকে বের হবার অনুরোধ করল। আমরাই লাস্ট ফেরিতে যাবার প্যাসেঞ্জার।
ফেরার পথে ইন্ডিয়ান এবং বাংলাদেশী বাঙালি দেখেছি। আমার ইচ্ছা ছিলো কথা বলার কিন্তু বাংলাদেশী স্বভাবের জন্য ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকলেও কেউ কথা বলেনি। আমি আলজেরিয়ার এক যুবকের সাথে কথা বললাম, সে ছাত্র কিন্তু কাজ করে। এখানে বেড়াতে এসেছে। ফেরার পথে সামিরা, সাবিত ও সাদি ফেরিই ছাদে উঠলো আমরা দোতলায়। জান্নাতের আবার সি ফোবিয়া, মাথা ঘোরে তার। দোতলায় ফেরির অর্ধেক খোলা, সে খোলা জায়গায় বসলো। সাদা ধবধবে বেঞ্চ,খুব সুন্দর। পাশেই লেখা পাড়ানো নিষেধ। ভাবছি আমাদের দেশ হলে এ গুলো নোংরা হয়ে থাকতো। পার্কে কাউকে সিগারেট খেতে দেখিনি। যে যার মতো ঘুরছে,ছবি তুলছে,খাচ্ছে।
অবাক হলাম ফেরি থেকে ওঠা নামার পথে হাজার হাজার পয়সা দেখে। পর্যটকেরা কেন সেখানে কয়েন নিক্ষেপ করেছে জানি না কিন্তু এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। তারা কী মানত করে ফেলেছে? হযরত শাহ জালালের মাজারের মতো গজারমাছকে খাওয়ালো কী না বুঝলাম না! মানুষের ভেতর অশরীরী ভাবনা অজানতেই বিরাজ করে..
স্ট্যাচু অব লিবার্টি যেভাবে আমেরিকার হলো:
নিউইয়র্ক হার্বারের বুকে ৩০৫ ফিট ৬ ইঞ্চি উঁচু, স্ট্যাচু অব লিবার্টি নামের সেই মূর্তিটি বিশ্বের বুকে যুক্তরাষ্ট্রের অনন্য এক নিদর্শন। নিজেদের কালো অধ্যায়কে পেছনে ফেলে বিশ্বের বুকে আমেরিকার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর এক বার্তাই যেন দেয় এই ভাস্কর্য।
‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ নামে বিশ্ববাসী এই মূর্তিটিকে চিনলেও এর প্রকৃত নাম ‘লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’। বহু লোকের নিরলস পরিশ্রম ও ধৈর্যের ফসল এই ভাস্কর্য আজ মার্কিনীদের জাতীয়তাবোধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একদম শূন্য থেকে একটি মূর্তি কীভাবে একটি জনগোষ্ঠির জাতীয়তার প্রতীক হয়ে উঠলো-
স্ট্যাচু অব লিবার্টি আসলে ছিল ফ্রান্সের জনগণের পক্ষ থেকে মার্কিনীদের জন্য একটি উপহার। ১৭৬৫ সাল থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত চলা আমেরিকান বিপ্লবের সময়টিতে ব্রিটেনের কাছ থেকে আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রামে সাহায্য করেছিল ফ্রান্স। সেই সহযোগিতার স্মৃতি হিসেবে আমেরিকার স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তিতে এটি নির্মাণ করা হয়।
সেই সময়টিতে ফ্রান্স বা আমেরিকার কেউই অর্থনৈতিকভাবে অতটা স্থিতিশীল ছিল না। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কেনই বা হঠাৎ ১০০ বছর পরে এসে স্মৃতি রক্ষার কথা মাথায় এলো? বা কীভাবেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো?
ফ্রান্সের ফ্রেডরিক অগাস্ট বার্থোল্ডি ছিলেন স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূল নকশাকার। তিনি কিন্তু মোটেও আমেরিকায় স্থাপনের কথা ভেবে নকশাটি করেননি। তার ভাবনায় ছিল অন্য কিছু। ১৮৫৫ সালে ২০ বছর বয়সের টগবগে তরুণ বার্থোল্ডি গিয়েছিলেন মিশর ভ্রমণে। সেখানকার পরিবেশ এবং চারপাশের চোখ ধাঁধানো সব শিল্প তার এতই নজর কাড়ে যে, ঠিক করে ফেলেন এখানে তার একটি কাজের নমুনা অবশ্যই রেখে যাবেন। সুযোগও পেয়ে যান একটি।
বার্থোল্ডি জানতে পারলেন, খুব দ্রুতই ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরের মাঝে সংযোগ সৃষ্টিকারী একটি খাল তৈরি করা হবে, যা বয়ে যাবে মিশরের মাঝ দিয়ে। এই খাল তৈরির ফলে ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে আর গোটা আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হবে না। এর ফলে বেঁচে যাবে সময় এবং বেড়ে যাবে যোগাযোগ ব্যস্ততা। বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই খালটির নাম হবে সুয়েজ খাল।
সুয়েজ খালের পাড়ে বার্থোল্ডি যে মূর্তি তৈরি করতে চেয়েছিলেন; নামও ঠিক হলো এর জন্য, ‘ইজিপ্ট ব্রিঙিং লাইট টু এশিয়া’। ভেবেছিলেন, মিশরকে পুরো বিশ্বে অসাধারণ মর্যাদা এনে দেবে এই শৈল্পিক মূর্তি। কিন্তু বার্থোল্ডির কপালই বটে! রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্মাণ-সংক্রান্ত নানা জটিলতা, জনবলের অভাব এবং সেই সময়ে কলেরার মহামারী- সব মিলিয়ে খালের নির্মাণকাজ শেষ হতেই লেগে গেল পুরো ১৫ বছর। ১৮৬৯ এর নভেম্বরে জাহাজ যাতায়াত এবং ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সুয়েজ খাল।
এরপর বার্থোল্ডি যখন তার নকশা নিয়ে যান তখন বাধে আরেক বিপত্তি। তার নকশা অনুযায়ী ৬ লক্ষ মার্কিন ডলারের বাজেট দিতে মিশর কোনোভাবেই সক্ষম না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই সেখান থেকে সরে আসতে হয় সদ্য ৩৫-এ পা দেওয়া বার্থোল্ডিকে।
মিশর ফিরিয়ে দিলেও নিয়তিতে অন্য কিছু লেখা ছিল। ১৮৭১ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে এসেই তিনি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের সর্বত্র চষে বেড়াতে শুরু করলেন তার প্রকল্পের প্রচারণার জন্য। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে বিশিষ্ট জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও মিলছিল না ইতিবাচক সাড়া।
এদিকে ১৮৬৫ সালে ফরাসি রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী এডওয়ার্ড ডে ল্যাবুলে বলেন, “যদি আমেরিকার স্বাধীনতা সম্পর্কিত কোনো স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়, তাহলে তা হওয়া উচিত আমেরিকা এবং ফ্রান্সের একটি সম্মিলিত প্রকল্প।” এই কথার জের ধরে সোজা তার কাছে চলে গেলেন বার্থোল্ডি। তিনি জানতেন, একমাত্র ল্যাবুলে উদ্যোগ নিলেই আশার আলো দেখতে পারে তার প্রকল্প।
ল্যাবুলে এক কথায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধভক্ত ছিলেন। দেশটিকে তিনি দেখতেন ভালো এবং উৎকৃষ্ট কিছুর উদাহরণ হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ফলাফল, দাসপ্রথার বিলুপ্তি এবং ৪ মিলিয়ন ক্রীতদাসের মুক্তির ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনেক উচ্ছ্বসিত। স্বাভাবিকভাবেই তিনি দেশটির জন্য কিছু করবার তাগিদ অনুভব করছিলেন। সেখানটায় বার্থোল্ডি নিয়ে এলেন ভাস্কর্য নির্মাণের এক দারুণ আহ্বান। দুয়ে দুয়ে মিলে যায় চার।
১৮৭৫ সালে ল্যাবুলে ‘ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান ইউনিয়ন’ গঠনের মাধ্যমে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার বার্থোল্ডির হাতে তুলে দেন ভাস্কর্যের কাজ শুরু করার জন্য। বার্থোল্ডি তখন গুস্তাভে আইফেলের সাথে পরামর্শ করে এর গঠন ও আকার ঠিক করেন।
তবে এই ২ লক্ষ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার কিন্তু এত সহজে আসেনি। ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান ইউনিয়ন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, মূর্তির ভিত গঠনের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা তোলা হবে মার্কিনীদের কাছ থেকেই এবং জনবল সরবরাহ করবে ফ্রান্স। কিন্তু মার্কিন নাগরিকদের থেকে আশানুরূপ সাড়া মিলছিল না। বিশেষ করে নিউ ইয়র্কের বাসিন্দাদের এ ব্যাপারে যেন কোনো আগ্রহই ছিল না।
আমেরিকানদের আগ্রহী করে তোলার জন্য বার্থোল্ডি ১৮৭৬ সালে মূর্তিটির হাত এবং মশাল পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় একটি প্রদর্শনীতে উন্মোচন করেন। সেখানকার লোকেরা এর ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখান। তারা জানতে চান, মূর্তিটির বাকি অংশ কবে শেষ হবে। তাদেরই আগ্রহের কারণে পেনসিলভেনিয়ার মেডিসন স্কয়ারে হাত এবং মশালের আরেকটি প্রদর্শনী করেন। সেখানকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পেয়ে তিনি বরং ভাবতে লাগলেন, স্বপ্নের ভাস্কর্যটি নিউ ইয়র্কের বদলে পেনসিলভেনিয়াতেই স্থাপন করা যায় কিনা।
নির্মাণের টাকা তোলার জন্য বিক্রি হওয়া মূর্তির মডেল; Image source: Etsy
কিন্তু নিউ ইয়র্ক থেকে আর সরে আসতে হয়নি বার্থোল্ডিকে। প্রচার-প্রচারণার মধ্য দিয়ে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছিল তার কাজ। ১৮৮০ সালে স্ট্যাচু অব লিবার্টির আমেরিকান কমিটি মূল নকশার অনুকরণে ছোট ছোট মডেল আকৃতি তৈরি করে বিক্রি করতে থাকে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।
একদম ছোট ৬ ইঞ্চির মডেলগুলো বিক্রি হতো ১ ডলারে এবং সবচেয়ে বড় ১ ফুট আকারের মডেলগুলো বিক্রি হতো ৫ ডলারে।
এর পাশাপাশি আরো অনেক দাতা সংস্থা কাজ করছিলেন মূর্তিটি নির্মাণের অর্থ তোলার জন্য। ইতোমধ্যে মার্কিন কবি এমা ল্যাজারাসের লেখা ‘The New Colossus’ কবিতাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে আমেরিকানদের মাঝে। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মূর্তিটি নির্মাণের ব্যাপারে তারাও ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করেন।
এত চেষ্টার পরেও কীসের যেন একটা কমতি থেকেই যাচ্ছিল। এই সময়েই ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’-এর সম্পাদক জোসেফ পুলিৎজার শেষ চেষ্টায় এগিয়ে আসেন। তার পত্রিকায় প্রতিটি সংখ্যায় ছাপানো স্ট্যাচু অব লিবার্টি নিয়ে বিশেষ লেখা প্রতিটি আমেরিকানকে আগ্রহী করে তুলতে থাকে এর ব্যাপারে। তারা উৎসাহ পাচ্ছিলেন মূর্তিটির তৈরির পেছনে তাদের মূল্যবান অর্থ খরচ করতে।
এটিই কাজের অগ্রগতি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পত্রিকার প্রচারণার থেকেই উঠে আসে ১ লক্ষ মার্কিন ডলার। এভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে শেষ হয় বার্থোল্ডির স্বপ্নের ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’।
১৮৮৫ সালে ফ্রান্স ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বসে তৈরি করা স্ট্যাচু অব লিবার্টির ৩৫০টি অংশ নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছায়। সবকটি অংশ জোড়া দিতে সময় লাগে পুরো ১ বছর। অবশেষে ২৮ অক্টোবর, ১৮৮৬ তারিখে মূর্তিটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ নানা পটপরিবর্তন ও ক্রান্তিকাল দেখেছে বিশ্ব। কিন্তু আমেরিকানদের আত্মপরিচয়ের একটি গৌরবময় নিদর্শন হিসেবে স্ট্যাচু অব লিবার্টি তার ভূমিকায় সৃষ্টিলগ্ন থেকে আজও অপরিবর্তিত। বার্থোল্ডির সৃজনশীলতা, শ্রম আর ল্যাবুলের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে মার্কিনীরা। ১৯৩৩ সাল থেকে এই মূর্তিটির দেখাশোনা করে আসছে আমেরিকার ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস।( ইন্টারনেট থেকে তথ্য)
এমা লেজারাসের ছবিসহ ছোট একটা বায়োগ্রাফী ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ পথেই লেখা রয়েছে। এ স্ট্যাচুকে নিয়ে সনেট লিখে তিনি বিখ্যাত হন।
প্রায় দুঘন্টা পার্কে ছিলাম। ফ্রান্স এবং আমেরিকার সম্প্রীতির স্বাক্ষর বহনকারী এ মূর্তিটি শুধু কী মূর্তি? এর ভেতরে রয়েছে দুদেশের উষ্ণ ভালোবাসা। শুধু এই মূর্তির জন্যই হাডসন নদীর উপর পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে।
আইনের প্রয়োগ যদি আমাদের দেশে থাকতো তাহলে আমাদের পর্যটন কেন্দ্রগুলো আরো দুর্দান্ত হতো।
শাহানা সিরাজী
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।