ঘুষ নিয়ে ধরা খেয়েও কয়েক দফা পদোন্নতি; বিআইডব্লিউটিএ এর ঘুসের নিয়ন্ত্রণ করে কে?
অপরাধ প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ড্রেজিং বিভাগের চারজন প্রকৌশলী নৌপথ খনন প্রকল্পের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিজেদের এবং স্ত্রী ও শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে পে অর্ডারের মাধ্যমে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। দুদকের তদন্তে তা সত্য বলে প্রমাণিতও হয়। কিন্তু তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এমনকি তিন দফায় পদোন্নতি নিয়ে বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন তারা। একই ভাবে ঘুষসহ দুদকের হাতে পরপর দুই প্রধান প্রকৌশলী ও এক প্রকৌশলী সার্ভেয়ার গ্রেফতার হওয়ার পর নৌপরিবহন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিআইডব্লিউটিএর আরিচা-রাজশাহী-গোদাগাড়ী-ভোলাহাট নদীপথ খনন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেসিক ড্রেজিং কোম্পানির কাছ থেকে বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, সহকারী প্রকৌশলী এইচ এম ফরহাদ উজ্জামান এবং উপসহকারী প্রকৌশলী আবু বকর ছিদ্দিক ও জহিরুল ইসলাম নিজেদের এবং স্ত্রী ও শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে পে অর্ডারের মাধ্যমে ১ কোটি ২৯ লাখ ৫ হাজার ৯৩৯ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
এ অভিযোগে বেসিক ড্রেজিং কোম্পানির হিসাব শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক গাজী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে ২০০৮ সালে মতিঝিল থানায় মামলা করেছিলেন। মামলা নম্বর ১৭।
দুদক ২০০৯ সালে এই দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরু করে এবং তদন্ত শেষে চার প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৪ জুলাই পে অর্ডারের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ পাওয়ায় চার্জশিট প্রদান করে। চার্জশিটে তিনজনের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী গোদাগাড়ী- ভোলাহাট নৌপথ প্রকল্পের ড্রেজিংয়ের কাজ ঠিকভাবে না করে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের আংশিক এই ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা পে অর্ডারের মাধ্যমে লেনদেনের দালিলিক প্রমাণ পায় দুদক। অথচ দুদকের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরও সহকারী প্রকৌশলী এএইচএম ফরহাদুজ্জামান তিন দফায় পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হয়েছেন। আর দুই উপসহকারী প্রকৌশলী দুই দফায় পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে তাদের এই পদোন্নতির পেছনে বিআইডব্লিউটিএর প্রশাসন বিভাগের পরিচালকসহ শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন।
এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর নেত্রকোনার কংস ও ভোগাই নদীর ১৫৫ কিলোমিটার খনন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগও নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) আবু বকর সিদ্দিক ও নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) দিদার এ আলমসহ একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক। এই প্রকল্পে ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া বিআইডব্লিটিএর উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. সিরাজুল ইসলাম ভুইয়ার দুর্নীতির অভিযোগও দুদক তদন্ত করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
দুদকের চার্জশিটের পরও চাকরিতে বহাল থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) আবু বকর সিদ্দিক জানান, তারা উচ্চ আদালতের আদেশে দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দুদকের মামলার পরও কয়েক দফা পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, অভিযুক্তরা উচ্চ আদালতে রিট করে চাকরিতে বহাল রয়েছেন। এখানে বিআইডব্লিউটিএর কিছু করার নেই।
অন্যদিকে বালাশী (গাইবান্ধা)-বাহাদুরাবাদ ঘাট (জামালপুর) রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করতে বাস্তবায়ন হওয়া ১৪৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ড্রেজিং করা হলেও রুটটি চালু করা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে ড্রেজিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের নেতারা এই বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি ও দুর্নীতির উৎস খুঁজে বের করার দাবি জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, নদীতে নাব্য না থাকার কারণে ফেরিঘাট টার্মিনালটি চালু করা যায়নি। তাই ফেরি সার্ভিসও বন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে কয়েক বছর আগে পরপর নৌপরিবহন অধিদফতরের দুজন প্রধান প্রকৌশলী ও একজন প্রকৌশলীকে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু এ ঘটনার পরও নকশা অনুমোদন ও পরীক্ষায় অনিয়ম বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সংস্থাটি। ফলে একই ধরনের অনিয়ম বারবার ঘটছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
সম্প্রতি অধিদফতরের উপকূলীয় এলাকায় ৭টি রেডিও স্টেশন ও লাইটহাউস প্রকল্পে আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। প্রকল্পের একজন দোভাষীকেই মাত্র ১ বছরে পরিশোধ করা হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার সামি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের দোভাষী মো. জসিম সেখকে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রকল্পের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত হতে গত বছরের ২৩ জুন এই টাকা দেওয়া হয়।
অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। লাইটহাউস প্রকল্পে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হককে কিছু দিন আগে প্রত্যাহার করা হলেও প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকসহ অধিদফতরের দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, অনুমোদন ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বিল পরিশোধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। লাইটহাউস প্রকল্প নামে পরিচিত নৌপরিবহন অধিদফতরের ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পের দুর্নীতি তদন্তে ২৬ এপ্রিল অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার বণিকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছিল মন্ত্রণালয়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মহাপরিচালককে প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগেরও সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি। তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
তবে দুদক বিষয়টি তদন্ত করছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান।
এ ছাড়া নৌপরিবহন অধিদফতরের অধীনে অভ্যন্তরীণ জাহাজের তৃতীয় শ্রেণির মাস্টারশিপ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর নৌ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে দুদকের হাতে গ্রেফতার হন ঢাকা (সদরঘাট) কার্যালয়ের শিপ সার্ভেয়ার মীর্জা সাইফুর রহমান। ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল রাজধানীর একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে নৌ অধিদফতরের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) ড. এস এম নাজমুল হককে গ্রেফতার করে দুদক। এর ৯ মাস আগে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই মতিঝিলে অধিদফতরের প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয় তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলামকে। কিন্তু এই তিন কর্মকর্তা দুদকের হাতে গ্রেফতার হলেও অভিযোগ তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংস্থাটি। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে পরীক্ষায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি দুদক ক্যাপ্টেন গিয়াসের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সিএনএস গিয়াস উদ্দিন জানিয়েছেন, পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন তার তথ্য-প্রমাণ তিনি দুদকের কাছে দিয়েছেন।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার মন্ত্রণালয়ের অবস্থান হচ্ছে জিরো টলারেন্স। কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং দুদকও এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক ভাবে নজরদারি করছে। আর দুর্নীতি দমন কমিশনেরও কিছু অবজারভেশন আছে, সেগুলোও আমরা কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করেছি। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।
আরও সংবাদ পড়ুন।