নারী-পুরুষের সম্মিলিত শক্তিতে পৃথিবী হোক পুষ্পিত বাগান – শাহানা সিরাজী
সম্পত্তির সমবন্টন হয় না,লালন পালনেও রয়েছে বৈষম্য
কিন্তু যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে নারী দিবস!
আদিতে মানুষ কী ভাবে বেঁচে থাকতো,বংশ উৎপাদন করতো? তখন কী সম্পত্তির অধিকার, বাঁচার অধিকার এ ভাবেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো?
বোধ করি না। মানুষ দিনে দিনে বন থেকে ঘরে এসেছে। ঘরে আসার সাথে সাথেই নিজেরা আইন তৈরি করেছে। নিজেদের তৈরি আইনে নিজেরাই ফাঁদে পড়েছে আবার সে আইন ভাঙার, মানার অবিরত সংগ্রাম চলছে। এজন্য আইন,ব্যাব পুলিশ,থানা, আনসার, আর্মি, নৌবাহিনী, দুদক -সব সব তৈরি হয়েছে। একের পিছে আরেক লেগেই আছে।
যারা শক্তিতে সবল তারাই দুর্বলকে দাবানোর সব আয়েশ করেছে।
নারী যেহেতু শারীরিক ভাবে দুর্বল তাই সবলের মেইন লক্ষই হলো দুর্বলকে দাবানো।
এর ফলে এক ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে দৈনন্দিন কাজে নারী কী করবে, পুরুষ কী করবে, নারী কী পরবে, পুরুষ কী পরবে। এগুলো সামাজিক বৈষম্য তৈরির ফলে হয়েছে।
সন্তান ধারণের উপর কারো হাত নেই। প্রাকৃতিক ভাবেই ভ্রুন তৈরি হয়,তারপর মানব সন্তানের জন্ম হয়। এ জন্মের জন্য জন্মদাতারা দায়ী নয়। কারণ কোনদিন শুক্রানু-ডিম্বানু মিলিত হলো তা কেউ বলতে পারে না তথাপি কন্যা সন্তান জন্মদানের জন্য মাতাকেই দায়ী করা হয়,অথচ দায়ী পিতা।
সন্তান লাভের ইচ্ছা করলেই লাভ হয় না আবার কেউ ইচ্ছা না করেই লাভ করে। এটাও প্রাকৃতিক। মানুষের হাতে কিছুই নেই। কিন্তু রকটা ব্যাপার মানুষের হাতে আছে সেটি হলো সন্তানকে সন্তানের মতোই বেড়ে উঠতে দেয়া। সেখানে নারীশিশু পুরুষ শিশু ভেদাভেদ না করা।
পিতার গৃহেই শুরু হয় জেন্ডার বৈষম্য। নারী শিশুকে চার দেয়ালে বন্দী। ফলে তার চিন্তা চেতনা সবটাই সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, তার ভেতর বাসা বাঁধে ক্ষোভ,ক্রোধ,হিংসা, ঘৃণা, ঈর্ষার মতো ভয়াবহ নেতিবাচক আবেগগুলো। দ্বন্দ্ব এখান থেকেই শুরু। পিতার গৃহের তৈরি করা দ্বন্দ্ব পরবর্তীতে আরো প্রকট আকার ধারণ করে।
অন্যদিকে পুরুষ সন্তানটি মুক্ত আকাশের নিচে বেড়ে ওঠে,তার ভেতর নেতৃত্বের গুণাবলী জন্মায়, পেশিশক্তির উৎপত্তি হয়। সেই পেশি শক্তি প্রথমেই প্রয়োগ করে গৃহে,মায়ের সাথে বোনের সাথে, পিতার সাথে, ভায়ের সাথে।
দিনে দিনে সে হয়ে ওঠে অসুর। তার অযৌক্তিক পেশিশক্তিকে মা ভয় পায়, ফলে প্রশ্রয় পেয়ে আরো আরো বেশি শক্তিমান হয়ে ওঠে।
এভাবেই গৃহ থেকে পুত্র সন্তান পুরুষ হয়ে প্রথমেই মা, বোন তারপর স্ত্রী – কন্যার উপর খবরদারির ওস্তাদ হয়।
সমাজের প্রতিনিধি যেহেতু তারা সেহেতু নারীকে অর্থনৈতিকভাবে দাবিয়ে রাখার জন্য আইনজারি করেছে কখনো ধর্ম নামে কখনো রাষ্ট্রীয় আইন নামে। নারী ধীরে ধীরে যখন বুঝতে শিখেছে তারা বাইরের পৃথিবীতে পা রাখল, এখানেই কর্মঘন্টা এবং কর্মঘন্টানুযায়ী আয়ের বৈষম্য তৈরি হলো। পুরুষ পায় এক টাকা নারী পায় আট আনা। এক সময় নারীরা প্রতিবাদ করলো,নারীদের নেতৃত্বে এগিয়ে এলো, স্থপতি ক্লারা,জার্মানে। তিনি ঠিক করলেন ৮ মার্চ নারী দিবস।
এখন কথা হলো নারী যদি স্বয়ংক্রিয় ভাবে জন্ম থেকেই মানুষের পরিচয়ে বেড়ে উঠতো, অধিকারগুলো সমভাবে পেতো তাহলে নারীরা সংঘটিত হতো না, নারী দিবসও আসতো না।
এখন নারী কাজে যায় বটে তা কতো শতাংশ?
নারী ঘর থেকে বের হয় কিন্তু কী ভাবে?
নারীর জন্য বাইরের পৃথিবী কী উন্মুক্ত? শঙ্কামুক্ত, ভয়হীন?
নারীর আয় কী নারী তার পছন্দমতো ব্যয় করতে পারে?
সবগুলো প্রশ্নের উত্তর বোধ করি না হবে।
নারীর সহজাত ধর্ম হলো মাতৃত্ব। সেই মাতৃত্বের কারণেই, স্বামী সন্তান পাড়া প্রতিবেশি সবাইকে ভালোবাসে, আগলে রাখতে চায়। কিন্তু তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়,নয় কী?
যেখানে নারী নিজেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে সেখান আবার তাকে অত্যাচার করা হচ্ছে। এ অত্যাচার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির নারী এক ধাপ বেশি করে।
নারীর অবগুণ্ঠন খুলেছে বা খুলে যাচ্ছে বটে মানসিক দীনতা এখনো হাজার বছর পিছিয়ে। এ দীনতা থেকে মুক্তির উপায় কেবল পড়াশোনা। স্কুল- কলেজে যাওয়া,মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ, পাশাপাশি পুরুষদেরও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া।
আপনি উন্মুক্ত মনের আপনার সহযাত্রী বদ্ধমনের, আপনি কী শান্তি পাবেন?
৮ মার্চের মঞ্চ থেকে আহবান সকল পিতার প্রতি কন্যাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না করে হ্যান্ডওভার করবেন না। বিয়ে দেয়াই কেবল পিতার কাজ নয় বরং যুগোপযোগী করে কন্যাকে গড়ে তোলা, শিক্ষিত করা, কাজে যুক্ত করা তাহলে পুত্র সন্তানের মতো কন্যা সন্তানও আপনার বুড়োকালের দায়িত্ব নেবে, আপনিও সানন্দে আপনার সম্পদ পুত্র কন্যার মাঝে সমবন্টন করতে পারবেন। সম্পদ অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে সে ভয় কাজ করবে না৷
একটি রাষ্ট্রের অর্ধেক জনগোষ্ঠিকে অন্ধকারে রেখে রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারে না।
ছবিতে আবার আব্বা,তিনি বাল্যকালে আমাকে হ্যান্ডওভার করেও চাকুরি হওয়া পর্যন্ত নিজের কাস্টডিতে রেখেছেন, আমি যতোটা সম্ভব আমার ভাইবোন সবার জন্য কিছু না কিছু করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
আমাদের বেড়ে ওঠা আমাদের ভাইদের সাথে সমান তালেই হয়েছে। আমরা বোনেরা খুব বেশিদূর না গেলেও পিছিয়ে নেই। আব্বা গত হয়েছেন। আমি দু:খে নেই, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কোন বাঁধা আমার পথকে আঁটকাতে পারেনি,পারছে না।
একবার আমার ছেলেদের চাচা তাদের ভাইকে বলেছিলো,আমার খাবার বন্ধ করে দিতে। তাদের ভাই জবাব দিয়েছিলো, তার খাবার সে নিজেই সংগ্রহ করে, কী ভাবে বন্ধ করবো। এর কারণ ছিলো, আমি সাহিত্য করি, সংগঠন করি,মানুষের সাথে চলি।
যে সব নারীর দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষের মতো তাদেরকে বলি, আপনি নারী,আপনার সত্ত্বাকে আপনি জাগিয়ে তুলুন। তাহলে দেখবেন আপনার আইডেন্টিটি আছে আপনি কেবল কুদ্দুসের বউ,মাখনের মা নন। আপনি আপনার নিজস্ব শক্তিতে শিরিন আক্তার হয়ে উঠবেন।
নারী- পুরুষের সম্মিলিত শক্তিতে পৃথিবী পুষ্পিত বাগান হোক।
আব্বা আপনি শান্তিতে ঘুমান। আমার জন্য কোন প্রকার চিন্তা করবেন না। আমি অনেক ভালো আছি। এই যে এখন বাজারে যাচ্ছি, চাল আটা কিনবো…..