গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১০৩ প্রকৌশলী দুর্নীতির সন্দেহে নজরদারিতে
অপরাধ প্রতিবেদকঃ দুর্নীতি ও অনিয়ম জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহভাজন শতাধিক প্রকৌশলীর উপর নজরদারি রাখা হয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি স্থাপনা মেরামতের কাজ করে থাকে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
এই খাতে বরাদ্দ পাওয়া অর্থ ব্যয় যথাযথভাবে না করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কাজ না করে বিল-ভাউচার তৈরি করা, একই কাজের জন্য একাধিকবার বিল করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। চলতি অর্থবছরেও (২০২১-২২) স্থাপনা মেরামত বা বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) খাতে মোট ৮১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এই অর্থ খরচে যাতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় সে জন্য নজরে রাখা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ১০৩ নির্বাহী প্রকৌশলীর কাজ।
স্থাপনা মেরামতের জন্য আবাসিক ভবনে ৫ হাজার ৯১২টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি এবং অনাবাসিক ভবনে ৬ হাজার ১৭৪টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রকৌশলীর একক এখতিয়ারে আছে ৮১ কোটি টাকা। ৮১০ কোটি টাকার মধ্যে ৩৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কাজ শেষ করতে হবে আসছে জুনে। এরপর বরাদ্দ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে। এ কারণে অনেক নির্বাহী প্রকৌশলীই গোঁজামিল দিয়ে কাজ শেষ করতে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি হতে পারে। তাই এবার অর্থ খরচে বেশ কঠোর মনিটরিং বা তদারকির কথা জানান গণপূর্ত অধিপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। এর আগে এই অর্থ ব্যয়ে যাদের নামে বদনাম রয়েছে, তাদের সশরীরে ডেকে আবার কখনো ফোন করে সাবধান করা হচ্ছে।
তবে মাঠপর্যায়ে কর্মরত প্রকৌশলীদের একটি অংশ বলছে, যে নির্বাহী প্রকৌশলীদের শীর্ষ পর্যায়ে ভালো যোগাযোগ রয়েছে, তাদের কর্ম এলাকায় অর্থ ব্যয়ের সুযোগ কম থাকলেও এপিপির অর্থ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর প্রভাবশালী প্রকৌশলীদের নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও খুব একটা ‘মাথাব্যথা’ নেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা যদি সামগ্রিকভাবে বলি, এপিপির অর্থ খরচ নিয়ে আমাদের বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সমস্যাটা ঢাকায় একটু বেশি হয়। এসব বিষয় নিয়ে যারা অর্থ খরচের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের ডেকে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বসেছি। তাদের নানা বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রধান দপ্তরে কর্মরত যাদের ভাবর্মূতি ভালো; তাদের সমন্বয়ে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ শুরু করলে কালই সবকিছু ঠিকঠাক হবে তা কিন্তু নয়। এরপরও আমরা শুরু করেছি; চেষ্টা করছি এসব বদনাম থেকে বেরিয়ে আসতে। এবার আমরা যেটা করেছি, সারা দেশে অনেকগুলো কমিটি করে দিচ্ছি। এরা মেরামতের অর্থ ব্যয়ের বিষয়গুলো কঠোর মনিটরিং করবে।’
সারা দেশে স্থাপনা মেরামতের কাজে যুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলীদের মধ্যে আছেন ৬৪ জেলার ৬৪ জন। মহানগরের মধ্যে চট্টগ্রামে ৮, রাজশাহী ও খুলনায় ৩ জন করে। বাকি ২৫ জন রাজধানীর। এই ১০৩ জনের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে আগেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কারও বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর রাজারবাগ, জাজেস কমপ্লেক্সসহ কিছু স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১) রাজিবুল ইসলাম। তিনি ১৫০টি কাজের চাহিদা দিয়ে চলতি অর্থবছরে মেরামত খাতে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছেন ১০ কোটি টাকা। এর আগে অর্থ ব্যয়ে বদনাম থাকায় এবার এই প্রকৌশলীকে একাধিকবার ডেকে কড়া ভাষায় সতর্ক করেছে কর্তৃপক্ষ।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী (মেডিকেল কলেজ) আজমল হক মুন। তিনি চলতি বছরে ২৪৫টি মেরামতকাজের চাহিদা দিয়ে পেয়েছেন ১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আরও কমবেশি ১০ কোটি বরাদ্দ রয়েছে তার বিভাগে। সব মিলিয়ে ২২ কোটি টাকা খরচ করবেন এই প্রকৌশলী। গত অর্থবছরেও প্রায় এ পরিমাণ টাকা খরচ করেছেন তিনি। কিন্তু তিনটি হাসপাতালেই স্থাপনাগুলোর অবস্থা খারাপ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে ব্যাপক অভিযোগ পায় গণপূর্ত অধিদপ্তর। এ ছাড়া এই প্রকৌশলী কিশোরগঞ্জে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কাজ ছাড়া বিল পরিশোধের অভিযোগে আড়াই বছর সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। তাকে ডেকে সাবধান করা হয়েছে।
নজরে রাখা হয়েছে দীর্ঘ সময় গণপূর্তের ঢাকা বিভাগ-২-এর দায়িত্বে আছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহ আলম ফারুক চৌধুরীকে। ২২৪টি কাজের চাহিদা দিয়ে তিনি পেয়েছেন ৩১ কোটি টাকা। চার বছর ধরে একই চেয়ারে রয়েছেন এই প্রকৌশলী।
গণপূর্তের বৃক্ষ সংরক্ষণের (আরবরিকালচার বিভাগ) দায়িত্বে থাকা প্রধান বৃক্ষপালনবিদ শেখ মো. কুদরত-ই-খুদা। তিনি ২২৪টি কাজের চাহিদা দিয়ে বরাদ্দ পেয়েছেন ১০ কোটি টাকা। অনেক দিন ধরেই খরচের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাই অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে থাকা এ বিভাগের অর্থ খরচে অনিয়ম রোধেও নজর দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর কিছু পরিত্যক্ত বাড়ি ও সেগুনবাগিচা এলাকার তিনটি ভবন দেখভালের দায়িত্বে আছেন নির্বাহী প্রকৌশলী (রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ-ঢাকা) মো. আতিকুল ইসলাম। খরচের জায়গা না থাকার পরও অনেকটা রহস্যজনকভাবে এই প্রকৌশলীকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২১ কোটি টাকা। তিনি এই অর্থবছরে ১২০টি কাজ করার চাহিদা দিয়েছেন। অথচ এই প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত সেগুনবাগিচা এলাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে ওই সংস্থার প্রধানের পক্ষ থেকে অনিয়মের নানা অভিযোগ করা হয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর কাছে। পরে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় ও অধিদপ্তরের প্রধানের নানামুখী তৎপরতায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও এখনো শেষ রক্ষা হয়নি। তাই বিভিন্ন সময় প্রধান প্রকৌশলীদের ম্যানেজ করে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা প্রকৌশলী আতিকের ওপর আলাদা করে দৃষ্টি রাখছে কর্তৃপক্ষ।
৫১৮টি কাজের চাহিদা দিয়ে শেরেবাংলা নগরের তিনটি বিভাগ মোট ৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। এ বিভাগে সংসদ ভবন, কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল, সাংসদদের বাসভবন ও কিছু সরকারি আবাসিক এলাকা রয়েছে। সেখানে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
২২৭টি কাজের বিপরীতে মতিঝিল বিভাগ বরাদ্দ পেয়েছে ১২ কোটি টাকা। সরকারি আবাসিক এলাকায় বেশ কয়েকটি ভবন ভেঙে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে মেরামতের কী কাজ হবে তা নিয়েও সংশয়ে আছেন কেউ কেউ।
১৭৬টি কাজের চাহিদার বিপরীতে মিরপুর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু পেয়েছেন ১২ কোটি টাকা। বর্তমানে মিরপুরে প্রায় বেশির ভাগ আবাসিক এলাকার ভবন নতুন। বাস্তবিক অর্থে ১২ কোটি টাকা খরচের মতো সুযোগ খুব একটা নেই। এ ছাড়া এই প্রকৌশলী ঢাকার বাইরে থাকা অবস্থায় এ কাজে ১০ কোটি বরাদ্দ নিয়ে ১৯ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বানের মতো অনিয়ম করেছেন। তাই তাকেও নজর রাখা হয়েছে।
সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল (ইএম) বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল হকের ওপর। তিনি ১৪৭টি ছোট-বড় কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন ১৩ কোটি টাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনিয়মের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে চলছে বিভাগীয় মামলা।
১৮৭টি কাজের জন্য ইএম ডিভিশন-৫-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের হাতে আছে ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বছরখানেক আগে এই প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে সেগুনাবাগিচায় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদর দপ্তর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ফলে তার হাতে থাকা আর্থিক এখতিয়ার নিয়েও যথেষ্ট চিন্তিত কর্তৃপক্ষ।
দীর্ঘ সময় ধরে ইএম বিভাগ-৭-এর দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী সমীরন মিস্ত্রী ১৮৯ কাজের চাহিদা দিয়ে বরাদ্দ নিয়েছেন ১৬ কোটি টাকা। প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত এই প্রকৌশলীর দায়িত্ব সংসদ ভবন এলাকায় হলেও সরকারি কর্মদিবসের বেশিরভাগ সময় তাকে সচিবালয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। তিনিও আছেন নিবিড় পর্যবেক্ষণে। ইএম ডিভিশন-১১ নির্বাহী প্রকৌশলী সাজিদুল ইসলামের আওধীন রয়েছে গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলা। চাকরিজীবনে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়া এই প্রকৌশলীর নামে বরাদ্দ আছে ৬ কোটি টাকা। জেলা পর্যায়ে কাজ না করে বিল করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ থাকা এই প্রকৌশলীর বিষয়ে সজাগ গণপূর্ত অধিদপ্তর।
এ ছাড়া ১১২টি কাজের চাহিদা দিয়ে ১১ কোটি ২৫ লাখ বরাদ্দ বাগিয়ে নিয়েছেন কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইউসুফ। চলতি অর্থবছরে ১২২টি কাজ শেষ করে বিল ভাউচার দেওয়ার পর তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছরের কে কী কাজ করবে তাদের কাছ থেকে চাহিদাপত্র পাওয়ার পর এপিপি বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। যারা দীর্ঘ সময় ঢাকাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দায়িত্বে আছেন তাদের ক্ষেত্রে এপিপির বরাদ্দে পক্ষপাতিত্ব হয়। কিছু প্রভাবশালী প্রকৌশলী গত অর্থবছরের তুলনায় এ বছর এপিপি বাড়িয়ে নিয়েছেন। তারা সবাই শীর্ষ পর্যায়ের আশীর্বাদপুষ্ট। আর যারা নিরীহ প্রকৃতির তাদের কর্তৃপক্ষ নামমাত্র এপিপি বরাদ্দ দেয়। ঢাকায় দীর্ঘ সময় অবস্থান করা নির্বাহী প্রকৌশলীর গত কয়েক বছরের এপিপি খরচের তালিকা ধরে অন্য কোনো সংস্থাটি দিয়ে তদন্ত করালেই ‘থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে’ বলেও দাবি করেন এক প্রকৌশলী।
তবে এপিপি বরাদ্দে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘যাদের বিষয়ে আগে থেকে অর্থ খরচের ক্ষেত্রে বদনাম রয়েছে, তাদের ওপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।
ঢাকাসহ সারা দেশে সবাইকে, বিশেষ করে মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এজন্য সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে তারা যেন কাজগুলো ঠিকঠাক মতো করে। যারা ঝামেলা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’