নরসিংদীতে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অনিয়ম ও দূর্নীতি; সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট!

Picsart_22-05-11_12-39-06-950.jpg

নরসিংদীতে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অনিয়ম ও দূর্নীতি;
সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট!

অপরাধ প্রতিবেদকঃ যোগ-বিয়োগের কারসাজিতে কোটি টাকা লোপাট! দলিল রেজিস্ট্রির নামে নরসিংদী সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে যোগ-বিয়োগের কারসাজিতে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

২০২১ সালের ৭ মার্চ। নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে রেকর্ড সংখ্যক দলিলের রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। দলিলের ফি-র বিপরীতে উৎসে করবাবদ পে-অর্ডারের মাধ্যমে ১৭ লাখ ১৮ হাজার ২২০ টাকার সরকারি রাজস্বও আদায় করা হয়। খাতায় দলিলের তালিকা ও পরিমাণ ঠিক থাকলেও দিনশেষে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ১৪ লাখ চার হাজার ২৩২ টাকা। এক দিনেই তিন লাখ ১৪ হাজার ৫৪৮ টাকা হাওয়া!

একই মাসের ২১ তারিখে (মার্চ) উৎসে করবাবদ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৫৩০ টাকার রাজস্ব আদায় হয়। ওই দিনও তালিকা ঠিক রেখে যোগফলের জায়গায় চার লাখ ৭৩ হাজার ৫৭০ টাকা কম দেখানো হয়। অর্থাৎ আদায় যা-ই হোক না কেন যোগফলে বড় ধরনের গরমিল!

এভাবে ওই বছরের (২০২১ সাল) মার্চ মাসের ৩১ দিনে মোট দুই কোটি ৩০ লাখ তিন হাজার টাকার উৎসে কর আদায় হলেও জমা হয় দুই কোটি দুই লাখ ৯৫ হাজার ৪৬৩ টাকা। ২৭ লাখ সাত হাজার ৫৩৭ টাকা গায়েব!

উৎসে কর, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় সরকারের কর আদায়, স্ট্যাম্প ডিউটি ফি ও ভ্যাট আদায়ের হিসাবেও গরমিলের তথ্য রয়েছে। শুধু কি এক বছর, চার থেকে পাঁচ বছরে একই কৌশলে ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য মিলেছে।

সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস ও নকলনবিশ শফিকুল ইসলামের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ওই টাকা সরিয়ে ফেলেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই প্রক্রিয়ায় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ২০ লাখ ১৫ হাজার ৩৭৯ টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার ২৫২ টাকা, মার্চ মাসে ২৭ লাখ সাত হাজার ৫৪৩ টাকা, এপ্রিল মাসে ১৩ লাখ আট হাজার ৭৫০ টাকা, মে মাসে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৪ টাকা, জুন মাসে ৪৭ লাখ ১১ হাজার ১১৫ টাকা, জুলাই মাসে ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ৪১০ টাকা, আগস্ট মাসে ৩০ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮৯ টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ৩০ লাখ ৯৮ হাজার ৮২২ টাকা, অক্টোবর মাসে ৩০ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৮ টাকা এবং নভেম্বরে সাত লাখ সাত হাজার ৫৪৩ টাকা হাওয়া হয়ে গেছে। পুরো বছরের হিসাবে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ৬৩ লাখ ২৯ হাজার ১১৫ টাকা। পুরো টাকাই লুটপাট করা হয়েছে।

উৎসে কর, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় সরকারের কর আদায়, স্ট্যাম্প ডিউটি ফি ও ভ্যাট আদায়ের হিসাবেও গরমিলের তথ্য রয়েছে। শুধু কি এক বছর, চার থেকে পাঁচ বছরে একই কৌশলে ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য মিলেছে। সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস ও নকলনবিশ শফিকুল ইসলামের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ওই টাকা সরিয়ে ফেলেছে। নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। যদিও বিষয়টি ধরা পড়ার পর দুজনই সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন।

টাকা সরিয়ে ফেলার কয়েকটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ মার্চ নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে মোট ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ৯৫৩ টাকা আত্মসাতের প্রমাণও মেলে। এ সংক্রান্ত আরও অনুসন্ধান চলমান রয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন ভবনে ঘুষ বাণিজ্য – দুদকের অভিযান

যে কৌশলে সরকারের রাজস্ব আত্মসাৎ

সাধারণত জেলাপর্যায়ের সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে দিনে প্রায় একশোর মতো দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। পৌর বা সিটি করপোরেশন এলাকায় একটি দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে দলিল-গ্রহীতাকে ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প (সম্পত্তির মূল্য), সরকারি রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় সরকার ফি, উৎসে কর ও গেইন ট্যাক্স (মুনাফার ওপর প্রযোজ্য কর) সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। কিন্তু নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে চক্রটি প্রতিটি দলিল রেজিস্ট্রিবাবদ গ্রহীতার পে-অর্ডার জমা নিলেও প্রতিদিন একটি-দুটি করে পে-অর্ডার ব্যক্তিগত লকারে রেখে দিত। দিনশেষে দলিলের তালিকায় রেকর্ডভুক্ত দেখা গেলেও যোগফলের সময় লুকিয়ে রাখা পে-অর্ডারে টাকার অঙ্কটা বাদ দেওয়া হতো। ফলে তালিকা ঠিক থাকলেও পে-অর্ডারের মোট টাকা অর্থাৎ প্রকৃত যোগফলের চেয়ে কম লেখা হতো। সাদা চোখে এমন কারচুপি ধরা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সরিয়ে ফেলা পে-অর্ডার পরবর্তীতে ব্যাংক থেকে নগদায়ন করে টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল চক্রটি। এভাবে মাসের পর মাস কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়।

নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে চক্রটি প্রতিটি দলিল রেজিস্ট্রিবাবদ গ্রহীতার পে-অর্ডার জমা নিলেও প্রতিদিন একটি-দুটি করে পে-অর্ডার ব্যক্তিগত লকারে রেখে দিত। দিনশেষে দলিলের তালিকায় রেকর্ডভুক্ত দেখা গেলেও যোগফলের সময় লুকিয়ে রাখা পে-অর্ডারে টাকার অঙ্কটা বাদ দেওয়া হতো। ফলে তালিকা ঠিক থাকলেও পে-অর্ডারের মোট টাকা অর্থাৎ প্রকৃত যোগফলের চেয়ে কম লেখা হতো। সাদা চোখে এমন কারচুপি ধরা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না
টাকা আত্মসাতের বিষয়টি যেভাবে ধরা পড়ে

নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দলিল রেজিস্ট্রির সময় কয়েকটি খাতে ধাপে ধাপে সরকারি ফি আদায় হয়। পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগার জমা দিতে হয়। উৎসে কর, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় সরকার কর, স্ট্যাম্প ডিউটি ফি ও গেইন ট্যাক্স দলিল রেজিস্ট্রেশন করা ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় হয়।

নেত্রকোনা জেলা রেজিস্ট্রার এর কার্যালয়ে দুদকের অভিযান

২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দেন আবুল কালাম মো. মনজুরুল ইসলাম। এরপর থেকে সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস ও নকলনবিশ শফিকুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্টদের নানা অপকর্মের তথ্য আসতে থাকে তার কাছে। মূলত, যোগ-বিয়োগের এমন অপকর্ম তিনিই প্রথম উদঘাটন করেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নরসিংদী সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সেখানে যোগ দেওয়ার পর নানা অভিযোগ আসতে থাকে। এটাও জানতে পারেন যে সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অনেক দিন ধরে অজানা কারণে অডিট হয়নি। পরে অডিট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সময় জেলা রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে একটি টিম অডিট করার সময় দলিল রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দেওয়ার তালিকাগুলো যাচাই-বাছাই করে। তখনও জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়েনি। অডিট করার কিছুদিন পর দুটি দলিল নিয়ে অফিসের এক কর্মচারী নরসিংদী জেলা রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. মনজুরুল ইসলামের কাছে আসেন। ওই কর্মচারী অভিযোগ করেন, ‘স্যার, পে-অর্ডার নম্বর লেখা নেই, নকল কীভাবে হবে?’ তখন মনজুরুল ইসলাম মূল খাতা নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। খাতায়ও পে-অর্ডার নম্বর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর পে-অর্ডার জমা দেওয়ার চালানগুলো চাওয়া হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, চালানের তালিকায়ও পে-অর্ডারের নম্বর পাওয়া যায়নি। অথচ নিয়ম হচ্ছে চালান কাটার সময় পে-অর্ডার নম্বর লিখতে হবে। এরপরই সন্দেহ হতে থাকে অফিস প্রধানের।

২০১৮ সাল থেকে এমন আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন। আত্মসাতের সমুদয় অর্থের পরিমাণ ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা হবে বলেও জানান তিনি। পুরো বিষয়টির নেতৃত্ব দিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস ও নকলনবিশ শফিকুল ইসলাম। নীহার রঞ্জনের আগে সাব্বির আহমেদ নামের সাব-রেজিস্ট্রার ওই খাতে কর্মরত ছিলেন। তার সময়েও টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে
তাৎক্ষণিক উৎসে কর জমা দেওয়ার দলিলের তালিকা ধরে ওই দিনের উৎসে করের হিসাব যোগ দিলেন তিনি। এরপর বেরিয়ে আসে প্রকৃত সত্য। যতবারই যোগ দেন, ততবারই কাগজে লেখা যোগফলের তুলনায় বেশি অঙ্ক দেখা যায় কর্মকর্তার ক্যালকুলেটরে। বারবার পরীক্ষার পরও যোগফল বেশি অর্থাৎ সরকারের রাজস্ব আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। এভাবে যাচাই-বাছাই করতে করতে কয়েক দিনের তালিকার যোগফলেও বড় ধরনের গরমিল মেলে।

ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের ৪ কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, ওই সিন্ডিকেট প্রতিদিনই দু-একটা পে-অর্ডার ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজেরা টাকা উত্তোলন করতো। এটা এমনভাবে করা হতো যে সাদা চোখে ধরার কোনো সুযোগ ছিল না। শুধুমাত্র তালিকার টাকার অঙ্ক যোগ করলেই আত্মসাতের বিষয়টি ধরা পড়ে।

২০১৮ সাল থেকে এমন আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন। আত্মসাতের সমুদয় অর্থের পরিমাণ ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা হবে বলেও জানান তিনি। পুরো বিষয়টির নেতৃত্ব দিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস ও নকলনবিশ শফিকুল ইসলাম। নীহার রঞ্জনের আগে সাব্বির আহমেদ নামের সাব-রেজিস্ট্রার ওই খাতে কর্মরত ছিলেন। তার সময়েও টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে।

অন্যদিকে, নকলনবিশ পদটি ছোট হলেও শফিকুল ইসলাম স্থানীয় হওয়ায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজস্ব একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ওই সিন্ডিকেট পুরো অফিস নিয়ন্ত্রণ করতো।

এ বিষয়ে নরসিংদী জেলা রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. মনজুরুল ইসলাম বলেন, নরসিংদী সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় পরিদর্শন এবং রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাইকালে দলিল রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত বেশকিছু অসঙ্গতি পাই। এরপর প্রতিদিনের ফি-বই চেক করতে গিয়ে অনেক টাকার গরমিল ধরা পড়ে। মাসের পর মাস পে-অর্ডার জমা না দিয়ে টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর বিস্তারিত তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন পাঠাই। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ বছর ধরে এমন অপকর্ম ঘটেছে।

নরসিংদী সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় পরিদর্শন এবং রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাইকালে দলিল রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত বেশকিছু অসঙ্গতি পাই। এরপর প্রতিদিনের ফি-বই চেক করতে গিয়ে অনেক টাকার গরমিল ধরা পড়ে। মাসের পর মাস পে-অর্ডার জমা না দিয়ে টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর বিস্তারিত তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন পাঠাই। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ বছর ধরে এমন অপকর্ম ঘটেছে

একপর্যায়ে বিষয়টি দুদকে অভিযোগ আকারে যাওয়ার পর তারাও অভিযান নামে। অভিযানে দুর্নীতির সত্যতা মেলে। দুদক কর্তৃপক্ষ বেশকিছু রেকর্ডপত্র তলব করলে আমি তা সরবরাহ করি। এখন বিষয়টি দুদক খতিয়ে দেখছে— বলেন আবুল কালাম মো. মনজুরুল ইসলাম।

দুদকের অভিযান

চলতি বছরের ৩০ মার্চ দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম ও উপ-সহকারী পরিচালক ওয়াহিদ মঞ্জুর সোহাগের সমন্বয়ে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওই কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে।

অভিযান পরিচালনার বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, নরসিংদী সদর সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে দলিল নিবন্ধন সম্পাদনকালে ২০০১ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত স্ট্যাম্প ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় কর, উৎসে কর খাতের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ মার্চ অভিযান পরিচালনা করে এনফোর্সমেন্ট টিম।

অভিযানকালে ২০২১ সালের ফি আদায়ের রেজিস্ট্রারগুলো যাচাই করে শুধু সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে মোট ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ৯৫৩ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়।

ওই অভিযানে ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ফি আদায়ের রেজিস্ট্রার তলব করে তদন্ত দল। আমি যতটুকু জানি অনুসন্ধান এখনও চলমান। পরবর্তীতে বিস্তারিত জানাতে পারব— বলেন দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা।

যে অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযানে নামে দুদক

নরসিংদী সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সাব-রেজিস্ট্রার, নকলনবিশ ও সহকারী নকলনবিশগণ পরস্পর যোগসাজশে দলিল রেজিস্ট্রির সময় আদায়কৃত ফি ফি-বই ও চালানসমূহে লিখে যোগফলে কম দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন। ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সদর সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন ও তার অফিসের সহকারী নকলনবিশের যোগসাজশে দলিল রেজিস্ট্রির সময় নগদ আদায়কৃত উৎসে কর ফি-বইয়ের পৃষ্ঠায় কৌশলে যোগফল কম দেখিয়ে ৮০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া একই পদ্ধতিতে আগে কর্মরত সাব-রেজিস্ট্রারও দলিল রেজিস্ট্রির পর নগদ আদায়কৃত সরকারি উৎসে কর ফি-বইয়ে কৌশলে যোগফল কম দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

টাকা আত্মসাতের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ মার্চ অভিযান পরিচালনা করে এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযানকালে ২০২১ সালের ফি আদায়ের রেজিস্ট্রারগুলো যাচাই করে শুধু সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে মোট ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ৯৫৩ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন ছাড়াও আগে কর্মরত সাব-রেজিস্ট্রাররা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে ঢাকাসহ নিজ এলাকায় আলিশান বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাট ক্রয়সহ কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স গড়ে তুলেছেন। সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের নকলনবিশ শফিকুল ইসলাম, সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন এবং আগের সাব-রেজিস্ট্রাররা এ কাজের সঙ্গে জড়িত।

নকলনবিশ শফিকুলের বরখাস্ত হওয়ার কারণ

অনুসন্ধান এবং সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নকলনবিশ শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও আসলে তিনি অর্থ আত্মসাতের কারণে বরখাস্ত হননি। তার বরখাস্ত হওয়ার প্রধান কারণ দেখানো হয় ‘দায়িত্বে অবহেলা’। রাজস্ব আদায়ে এবং সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন নকলনবিশরা (মোহরার)। তারা দলিল রেজিস্ট্রির পর বালাম বইয়ে লিপিবদ্ধ (সংরক্ষণ) এবং নকল দলিল প্রদানে মূল সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু নকলনবিশ শফিকুল ইসলাম এটি না করে বছরের পর বছর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।

শফিকুলের অপকর্মের খবর বিভিন্ন মাধ্যমে আসার পর তার পেছনের রেকর্ডপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি আট থেকে ১০ বছর ধরে অফিসিয়ালি কোনো কাজ করেননি। অথচ বিল তুলেছেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে অন্যের হাতে লেখা একটি বিল শফিকুল নিজে সই করে অফিসে দাখিল করেন। পরে তার হাতের লেখার সঙ্গে অমিল পাওয়া এবং বিল তোলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ওই মাসেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাকে। অন্যদিকে, রাজস্ব আত্মসাতের ঘটনা ফাঁস হলে সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ফি আদায়ের রেজিস্ট্রার তলব করে তদন্ত দল। আমি যতটুকু জানি অনুসন্ধান এখনও চলমান। পরবর্তীতে বিস্তারিত জানাতে পারব
দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ শফিউল্লাহ

এদিকে, নকলনবিশ শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের আরও একটি অভিযোগ উপস্থাপিত হয়েছে দুদক কার্যালয়ে। তার সম্পদের বিবরণ সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী শহরে পাঁচতলা একটি ভবন ছাড়াও অন্তত তিনটি বাড়ি রয়েছে তার। নরসিংদীর শিবপুর থানার ব্রাহ্মনদীতে কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং পৈত্রিক জমিতে এক কোটি টাকা দিয়ে দুটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন নকলনবিশ শফিকুল।

সার্বিক বিষয়ে জানতে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া নকলনবিশ শফিকুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

অন্যদিকে, অনুসন্ধানের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে দুদক প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট ইউনিটসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কেউ এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে, প্রতিষ্ঠানটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুদকের আভিযানিক দলটি ২০০১ সাল থেকে সমস্ত রেকর্ডপত্র দেখতে চান। কিন্তু এত রেকর্ডপত্র দেখে শুধুমাত্র ২০২১ সালের উৎসে করের কাগজপত্র খতিয়ে দেখেন। এটা দেখতেই দিন পার হয়ে যায়। সামান্য কিছু অংশ যাচাই করতে সক্ষম হয় দলটি।

পরবর্তীতে অভিযোগের সত্যতা মেলায় রেকর্ডপত্র জব্দ করে দুদক কার্যালয়ে আনা হয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দলটি সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস ও নকলনবিশ শফিকুল ইসলামের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শুধুমাত্র ২০২১ সালেই কোটি টাকার বেশি সরকারি রাজস্ব আত্মসাতের প্রমাণ পায়।

প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের একটি সিদ্ধান্তও আসতে পারে।

আরও সংবাদ পড়ুন।

পাবনা সদর সাব-রেজিস্ট্রার মোঃ ইব্রাহিম আলীকে গ্রেফতার করেছে দুদক।

আরও সংবাদ পড়ুন।

বরিশাল সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার ইউনুস মিয়া’র ঘুষ দাবি – দুদকের অভিযান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top