ফোনে আড়িপাতা বন্ধ ও ফাঁসের ঘটনা তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট
আদালত প্রতিবেদকঃ ফোনে আড়িপাতা বন্ধ ও এ পর্যন্ত ফাঁস হওয়া ঘটনার তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের দশ আইনজীবীর পক্ষে এ রিট করেন অ্যাডভোকেট মো. শিশির মনির। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ রিটের শুনানি হবে।
রিটে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানকে বিবাদী করা হয়েছে।
রিট আবেদনে ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ২০ টি আড়িপাতার ঘটনা উল্লেখ করা হয়।তন্মেধ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংলাপ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফোনালাপ, প্রয়াত সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসান এর ফোনালাপ, ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপ, মাওলানা মামুনুল হকের ফোনালাপ, যশোর-৬ সংসদীয় আসনের সদস্য শাহীন চাকলাদারের ফোনালাপ, ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) এর ফোনালাপ, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ফোনালাপ, সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ফোনালাপ উল্লেখযোগ্য। এসব আড়িপাতার ঘটনা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বহুল প্রচারিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
রিট আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ১৩৬১ সাল থেকে এই অধিকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বীকৃত। ১৮৯০ সালে হার্ভার্ড ল রিভিউ এ ‘ দি রাইট টু প্রাইভেসি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Privacy as an Aspect of Human Dignity’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এই প্রবন্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এছাড়াও, সার্বজনীন মানবাধিকার সনদপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর সব আধুনিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।
এরই ধারাবাহিকতায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা সংরক্ষণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই অধিকার সংবিধান কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, সংবিধানের তৃতীয়ভাগে উল্লেখিত মৌলিক অধিকার সমূহের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ অন্যতম।
এছাড়াও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৬ অনুযায়ী টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ধারা ৩০ (চ) অনুযায়ী টেলিযোগাযোগের একান্ততা রক্ষা নিশ্চিত করা এই কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এই ধরণের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান প্রচলিত আইন অনুযায়ী কমিশনের দায়িত্ব হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।
২৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে বিচারপতি মো. শওকত হোসাইন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ এক মামলায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। এই রায়ে বলা হয়, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও টেলিফোন সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সর্বাধিক। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ তাদের দায়িত্ব। তারা আইনের বিধান ব্যতিরেকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্য প্রদান করতে পারে না।
রিট আবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে ৪ (চার) টি আইনি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়, যথা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ এর ধারা ৩০ (চ) অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন -এর দায়িত্ব হলো, নাগরিকের টেলিযোগযোগের একান্ততা রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু কমিশন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি; ২) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩(খ) অনুযায়ী ‘নাগরিকের গৃহ ও রাগের রক্ষণ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। কিন্তু সাম্প্রতিকালে কমিশন সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের বিধান পালনার্থে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি; ৩) অন্তত ২০ টি ঘটনা ফাঁসের তথ্য উপস্থাপন করে কমিশনকে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও কমিশন যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে কোনো জবাব প্রদান করেনি: ৪) টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ এর ধারা ৭১ অনুযায়ী আড়িপাতা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে দোষী ব্যক্তি দুই বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথচ আজ অবধি কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেনি।
এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী এই রিট আবেদন দায়ের করেন। রিটকারী আইনজীবীরা হলেন- মুস্তাফিজুর রহমান, রেজওয়ানা ফেরদৌস, উত্তম কুমার বনিক, শাহ নাবিলা কাশফী, ফরহাদ আহমেদ সিদ্দীকী, মোহাম্মদ নওয়াব আলী, মোহাম্মদ ইবরাহিম খলিল, জিএমমুজাহিদুর রহমান (মুন্না), ইমরুল কায়েস ও একরামুল কবির।