ছেলেমেয়ে কি পর হয়ে গেল?- আনিসুল হক
‘আরেকবার জীবন পেলে আপনি কী করবেন?’‘আরেকবার জীবন পেলে ইংরেজিটা জুতমতো শিখব।’ বলেছিলাম এক সাক্ষাৎকারে। আমার শিক্ষক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্রই প্রশ্ন, ‘আনিস, এটা তুমি কী বললে! আবার কেন জন্মাতে হবে। আজ থেকে ইংরেজি শেখা শুরু করো।’
আমার আব্বার ছিল ডায়াবেটিস। তিনি মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। খেতে পারতেন না। তিনি আমাদের নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে। বলতেন, যত ইচ্ছা মিষ্টি খাও। আমরা খেতাম। তিনি চেয়ে চেয়ে দেখতেন। তাঁর মিষ্টি খাওয়া হয়ে যেত।
আমরা, বাবা-মায়েরা, আমাদের অপূর্ণ বাসনা চরিতার্থ করার জন্য বেছে নিয়েছি ছেলেমেয়েদের। আমরা ফটর ফটর করে ইংরেজি বলতে পারি না, আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন পারে। কাজেই তাদের ভর্তি করিয়ে দিয়েছি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। প্রথম প্রথম আমাদের শখের অত্যাচারে তাদের গানের স্কুল, নাচের স্কুল, আর্টের স্কুল, সাঁতারের স্কুল, আবৃত্তির স্কুল—হাজারটা ক্লাস করতে হয়। কবীর সুমনের গানের ভাষায়:
‘স্কুলের পড়ার সঙ্গে আছে পাড়ার গানের স্কুল
নিয়ম করে শিখতে হবে রবীন্দ্র–নজরুল।
মায়ের ভীষণ ইচ্ছে মেয়ে আঁকার স্কুলেও যাক
বাবার দাবি তারি সঙ্গে কত্থকটাও থাক।’
তো ছেলেমেয়েরা শৈশবে সব করছে, সব পড়ছে, রবীন্দ্র-নজরুল, উচ্চাঙ্গ-কত্থক। বা বা ব্ল্যাকশিপ আর টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার তো চলছেই। প্রথম প্রথম বাচ্চা কথা বলতে চায় না, ‘মিস, মে আই গো টু দ্য টয়লেট প্লিজ।’ কথা বলার ভয়ে বাথরুম পেলেও ক্লাসে বসে থাকে। স্কুল থেকে কমপ্লেন, ‘আপনার চাইল্ড সোশ্যাল না। কথা বলে না। আপনারা কি একটা কাজ করবেন, বাসায় ওর সঙ্গে ইংলিশ বলবেন?’ সেই বাচ্চাকে নিয়ে কদিন পরে আবার কমপ্লেন, ‘আপনার বাচ্চা খালি কথা কয়!’ বাবা-মার বুক ফুলে উঠছে, একেবারে আমেরিকান একসেন্ট। পারবে না, সারা দিন পপআই দ্য সেইলর ম্যান দেখে যে। ওই কবিতাটা বাবা–মার মনের কথা ফুটিয়ে তুলেছে:
‘ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’
কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের,
বাংলাটা ঠিক আসে না।
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’
অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের,
বাংলাটা ঠিক আসে না।
কত কত বই কিনে দেওয়া হলো শখ করে, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়, রুশদেশের উপকথা। আস্তে আস্তে ছেলে–মেয়ে হাতে তুলে নিল লেডিবার্ডের বই, ফেলুদা ফেলে দিয়ে হাতে নিল রোয়াল ডাল, তিন গোয়েন্দা না পড়ে পড়তে লাগল থ্রি ইনভেস্টিগেটরস, হ্যারি পটার হাতে পেলে কে আর আম আঁটির ভেঁপু পড়বে। ডিজনির ছবির জগতে ঢুকে যে সিনড্রেলা দেখে ফেলেছে, কোন দাদি তাকে শোনাতে পারবেন ডালিমকুমার। ম্যানইউ নাকি চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ নাকি বার্সেলোনা নিয়ে যে মেতে আছে, তাকে আমাদের মোহামেডান, আবাহনীর নস্টালজিক গল্প শোনানোর চেষ্টার মতো বোকামি কি আর আছে?
একদিন গভীর বেদনার সঙ্গে দেখতে লাগলাম, আমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের আর কোনো টকিং পয়েন্ট নেই, অভিন্ন আগ্রহের বিষয় নেই! এমন না যে সে মানুষকে ভালোবাসে না, ডাইভার্সিটিকে শ্রদ্ধা করে না। বরং একটু বেশিই ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ তারা।
তাদের বলা যাবে না, মা, তোমার ওজন বেড়ে গেছে। ‘বাবা, এটা বলতে হয় না, এটাকে বলে বডি শেমিং।’ দাদি যদি নাতিকে বলেন, কী গায়ের রং ছিল তোর, দুধে-আলতায়। নাতি শরীর বাঁকায়, দাদি, গায়ের রং নিয়ে কথা বলতে হয় না।
তার জগৎটাই আলাদা। সারাক্ষণ পড়ে আছে গ্যাজেট নিয়ে। দেখছে আমেরিকান ফুটবল। রাজনীতিতে ভীষণ অনীহা। তারপর প্রথম সুযোগেই পাখি উড়ে চলে গেল আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা। আ লিটল স্টেপ ফর আ চাইল্ড, আ জায়ান্ট ব্লো ফর দ্য প্যারেন্টস। এই বাচ্চা আর ফিরবে না। হোয়াটসঅ্যাপে দুই বেলা কথা হয়, ফেসটাইমে ভিডিও চ্যাট। সে মাঝেমধ্যে বলে, মা, তোমার হাতের ডাল চচ্চড়িটা আর কোথাও হয় না, কিংবা অর্ণবের গলায় মাঝে মাঝে তব দেখা পাই গানটা কিন্তু দারুণ। আমরা তাতেই খুশি। ছোটবেলায় সে-ই তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত, ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কীবা মৃদু বায়! এখন সে যদি ট্যাটু করে, কানে চার–পাঁচটা ফুটো করে, বাবা-মা তাদের বলবেনই–বা কী।
গড়ে-দরে কোনো কথা বলব না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়েও খুব ভালো বাংলা লেখে, বাংলা বলে এমন তরুণ আছে। বাংলাটা পড়তে পারে না, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে তার গবেষণাপত্রটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, হতে পারে তো!
তবু শেষে তিনটা কথা বলতে পারি:
১. ইংরেজি মাধ্যমে পড়েও ভালো বাংলা জানা, বলা, লেখা যায়। এটাও নির্ভর করে পারিবারিক পরিবেশ আর সদিচ্ছার ওপরে।
২. বাংলা মাধ্যমে পড়েও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, শিল্পোদ্যোক্তা, লেখক হওয়া যায়। প্রিন্সটনের বিজ্ঞানী এম জাহিদ হাসান, কোয়ালিটি গুরু সুবীর চৌধুরী, বিজ্ঞানী আতাউল করিম—সবাই বাংলা মাধ্যমেরই ছাত্র ছিলেন।
৩. প্রজন্মের ব্যবধান থাকবেই। আমার মেয়েকে বলেছিলাম, লেখক হওয়ার জন্য ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ার দরকার নেই, তুমি তো বিজ্ঞান বা বিজনেস পড়েও লেখক হতে পারবে। সে বলেছে, তুমি তোমার বাবা-মার কথা শোনোনি, আমিও তোমার কথা শুনব না। আমি ক্রিয়েটিভ রাইটিংই পড়ব।
তাই তো। আমিও তো আমার বাবা-মার কথা শুনিনি!
এটাই জগতের নিয়ম। কহলিল জিবরান বলেন:
তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা,
তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে,
তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে,
কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তরুণেরা বিদ্রোহ করবে পুরোনা চিন্তা মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। তাই আসে ৫২, তাই আসে ১৯৭১। ওদেরকে ওদের মতো এগোতে দিতে হবে। তবে বড়দের আছে অভিজ্ঞতা। সেটাও তো মূল্যবান। আসলে দরকার ভারসাম্য। পরিমিতিবোধ। ওটাই আসল।
আনিসুল হক
সহিত্যিক, কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক
উপসম্পাদক প্রথম আলো।