দুদকে এমপিদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু হয় – শেষ না; এমপি মন্ত্রীরা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে

PicsArt_10-21-05.46.49.jpg

দুদকে এমপিদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু হয় – শেষ না;এমপি মন্ত্রীরা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে

বিশেষ প্রতিবেদকঃ দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানের তালিকায় যোগ হলেন আরও একজন সংসদ সদস্য; তিনি হাজী মো. সেলিম, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা।

ছেলের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগ আসার পর তুমুল আলোচনার মধ্যে বুধবারই প্রভাবশালী ও অর্থশালী হাজী সেলিমের ‘অবৈধ সম্পদ’র খোঁজে নামার কথা জানান দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান।

ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিসহ নানা ঘটনায় এর আগে সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে ২১ জন সংসদ সদস্যের দুর্নীতির খোঁজে নামে দুদক। কিন্তু তার কোনোটির কাজ শেষ হওয়ার খবর এখনও আসেনি।

দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে অভিযোগ থাকলেও তা নাকচ করছেন দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের চোখে, দুদকের এই অনুসন্ধান ‘অনেকটাই লোক দেখানো’।

সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, খাস জমি দখল, ঘুষ গ্রহণ, কমিশন, চাঁদাবাজিসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বর্তমান সংসদের ১১ জন সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক।

এছাড়া জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আরও ১০ জন সাবেক সংসদ সদস্যকে নিয়েও চলছে অনুসন্ধান।

বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাদের নিয়ে অনুসন্ধান চলছে, তারা হলেন- ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সামশুল হক চৌধুরী, নজরুল ইসলাম বাবু, পঙ্কজ দেবনাথ, আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব।

এছাড়া বিকল্পধারার মাহি বি চৌধুরী, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম রয়েছেন এই তালিকায়।

সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বি এম মোজাম্মেল হক, কামরুল আশরাফ খান পোটন, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, শামসুল হক ভূঁইয়াকে নিয়ে খাতা খোলা হয়েছিল দুদকে।

এই তালিকায় বিএনপি নেতাদের মধ্যে রয়েছেন রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু, মো. শাহজাহান, আব্দুল মোমিন তালুকদার, শহিদুজ্জামান বেল্টু রয়েছেন। জাতীয় পার্টির এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের নামও রয়েছে এর মধ্যে।

বর্তমান সংসদ সদস্য ১১ জনের অনুসন্ধানের শুরুটা ঠিক এক বছর আগে ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় থেকে হয়েছিল। সাবেক এমপিদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল অন্তত তিন বছর আগে থেকে। এর আগে ও সমসাময়িক আরও অনেকের নামে অনুসন্ধান শুরু হলেও সেগুলোর বেশ কিছু চাপা পড়ে গেছে বা পরিসমাপ্তি করে ফেলেছে।

এখন সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে ২১ জনের অনুসন্ধান চলমান বলে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সম্প্রতি রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীকে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

তার বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, খাস জমি ইজারায় দুর্নীতি, সার ডিলার নিয়োগে অনিয়ম, স্কুল কলেজে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ অন্তত ২০ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। এরপর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

ওমর ফারুক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পাওয়ার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন এক অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

১০ থেকে ২০ শতাংশ ঘুষ নিয়ে ঠিকাদার নিয়োগ, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতাকে নিয়ে শুরু হয় দুদকের অনুসন্ধান। তার সম্পদ খতিয়ে দেখতে আগামী ৩ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট সকল নথিপত্র তলব করেছে সংস্থাটি।

গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর দুই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকা করে তাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদক। ইতোমধ্যে এই তালিকা থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বেশ কয়েকজন আলোচিত নেতাসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে দুদক।

ওই সময় দুদকের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এই তালিকায় উঠে আসে আওয়ামী লীগের পাঁচ সংসদ সদস্যের নাম। তারা হলেন- সুনামগঞ্জ-১ আসনের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সামশুল হক চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম বাবু ও বরিশাল-৪ আসনের পঙ্কজ দেবনাথ।

তাদের সম্পদের পরিমাণ খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দুদক।

গত বছর এই অনুসন্ধান শুরুর পর পরই রতন, সামশুল হক ও নুরুন্নবী শাওনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।

তাদের মধ্যে রতনকে দুদকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তার সম্পদের বিষয়ে নথিপত্র সংগ্রহ করা হলেও বাকিদের বিষয়ে অনুসন্ধানে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে অনুসন্ধানে দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

রতন দাবি করেছেন, তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। সম্পদ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দুদকে জমা দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

শামসুল হক ভূঁইয়াকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ এবং তার সম্পদের হিসাব নিয়েছে দুদক।

ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীকে নিয়ে শুরু হয় অনুসন্ধান।

মাহী বি চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সম্প্রতি তার ও তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাব জমা দিতে নোটিস পাঠিয়েছে দুদক।

একই অভিযোগে ভোলা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হলেও তাতে কোনো অগ্রগতি নেই।

এদিকে কুয়েতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা স্বতন্ত্র এমপি পাপুল দম্পতির অনুসন্ধান শেষ পথে বলে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

পাপুলের কাজে সহযোগিতা করা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার স্ত্রী সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামকে গত ২২ জুলাই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। এর আগে গত ২২ জুন পাপুল, স্ত্রী সেলিনা, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও সেলিনার বোন জেসমিনের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক দেশি-বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়।

জনশক্তি রপ্তানিকারক পাপুল কুয়েতে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগে সে দেশে বিচারের কাঠগড়ায়।

সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে বিএনপির রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ ও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আসাদুল হাবিব দুলু ও শাহজাহানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা।

জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একাধিকবার তলব করা হলেও নানা কারণ দেখিয়ে দুদকে হাজির হননি তিনি।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হকের সম্পত্তি সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি কয়েকটি দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

মোজাম্মেল হক বলেন, “অনুসন্ধান চলুক, অসুবিধা নেই। কেউ না কেউ অভিযোগ করেছে, আমি নাকি দুর্নীতি করছি। খুঁজে বের করুক আমি কোথায় দুর্নীতি করেছি।”

তিনি অভিযোগ করেছেন, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এসব অভিযোগ করেছে।

অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, তাদের হয়রানি করার জন্য এই অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

‘লোক দেখানো’

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছিলেন, সংস্থাটি একটি ‘দন্তহীন বাঘে’ পরিণত হয়েছে।

আইনের সীমাবদ্ধতার কথা তিনি বললেও যতটুকু ক্ষমতা আছে, সেটাও দুদক এখন প্রয়োগ করছে না বলে মনে করেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “দুদক নিজের মতো করে এক ধরনের সীমারেখা অঙ্কন করে নিয়েছে। সেই সীমারেখার বাইরে তারা যেতে চায় না। এর বাইরে গেলে তাদের হাত পুড়ে যাবে, এরকম মানসিকতা বিরাজ করছে।”

এই কারণে এমপিদের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের নামাটা লোক দেখানো বলে মনে হচ্ছে ইফতেখারুজ্জামানের।

তিনি বলে, “এই ধরনের উদ্যোগ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের কারও ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এরকম দৃষ্টান্ত বিরল।

“এগুলো অনেকটা লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দুদকের উপর মানুষের প্রত্যাশা ও চাপ আছে। সেই জায়গা থেকে দুদক কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার মতো অনুসন্ধান বা একটা প্রক্রিয়া শুরু করে, বাস্তবে বেশি দূর যায় না।”

“এই কারণে একদিক থেকে মানুষের মধ্যে হতাশার সঞ্চার করে। অন্যদিক দিয়ে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়,” বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

এদিকে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান দাবি করছেন, তারা কারও মুখ দেখে অনুসন্ধান চালান না।

তিনি বলেন, “কোনো অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির পেশাগত, সামাজিক বা অন্য কোনো পরিচয় কমিশনের নিকট গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে কোনো বাধা আসছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে দুদকের এই কমিশনার বলেন, “দুদক এমপি-মন্ত্রীসহ অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এর আগেও মামলা দায়ের করেছে এবং তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছে। দুদকের মামলায় অনেকে শাস্তিও পেয়েছেন। বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

কোনো ঘটনা ঘটলেই অনুসন্ধানে নামার বিষয়ে মোজাম্মেল বলেন, “কোনো কিছুই হঠাৎ করে হচ্ছে না।

“স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট, বস্তনিষ্ঠ এবং দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ সংবলিত অভিযোগ আসে, এগুলো দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা অনুসারে যাচাই-বাছাই পূর্বক অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে থাকে।”

অনুসন্ধান শেষ করায় দেরির বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে, তা কমিশনের দেওয়া নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করে কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দিতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top