আমেরিকা তো আমাদের দেশের মতোই মাটি-জল-কাদায় তৈরি। পার্থক্য হলো- তাদের দেশে শিক্ষা আগে শুরু হয়েছে আমাদের দেশে পরে। তারা আইন প্রয়োগ করে আমরা করি না। ভালো থাকতে হলে আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে, রাজনীতি সুস্থ ধারার থাকতে হবে, দেশের মানুষকে, আইনকে ভালো বাসতে হবে। এর কোনটাই আমাদের ভেতর নেই – শাহানা সিরাজী
বস্টন হারবার আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের পবিত্রস্থান। এখান থেকেই ১৭৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন ছিলো মূলত: চা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রথম কোন প্রতিবাদ। যা পরবর্তীতে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঁক নেয়।
বস্টন টি পার্টি ছিল ঔপনিবেশিক ম্যাসাচুসেটস-এর বোস্টনে সনস অফ লিবার্টি দ্বারা ১৬ ডিসেম্বর, ১৭৭৩-এ আমেরিকান রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিবাদ। লক্ষ্য ছিল ১০মে, ১৭৭৩ সালের চা আইন, যা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে টাউনশেন্ড আইন দ্বারা আরোপিত কর ছাড়াই আমেরিকান উপনিবেশগুলিতে চীন থেকে চা বিক্রি করার অনুমতি দেয়। সানস অফ লিবার্টি তাদের অধিকারের লঙ্ঘন হিসাবে টাউনশেন্ড আইনে করের তীব্র বিরোধিতা করেছিল।জবাবে, সানস অফ লিবার্টি, কেউ কেউ নেটিভ আমেরিকানদের ছদ্মবেশে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাঠানো চায়ের একটি সম্পূর্ণ চালান ধ্বংস করে দেয়।বিক্ষোভকারীরা জাহাজে উঠে চায়ের বুকে বোস্টন হারবারে ফেলে দেয়।ব্রিটিশ সরকার এই প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার কাজ বলে মনে করে এবং কঠোর প্রতিক্রিয়া জানায়।
এ ঘটনা আমেরিকান বিপ্লবে পরিণত হয়, আমেরিকার ইতিহাসের একটি আইকনিক ঘটনা হয়ে ওঠে। তারপর থেকে অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিবাদ ঘটতে থাকে। যেমন টি- পার্টি আন্দোলন নিজেদেরকে ১৭৭৩ সালের বোস্টন প্রতিবাদের ঐতিহাসিক উত্তরসূরি হিসেবে উল্লেখ করেছে তেমনই।
টি পার্টি ছিল ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক পাসকৃত চা আইনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমেরিকা জুড়ে একটি প্রতিরোধ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। উপনিবেশবাদীরা চা আইনের প্রতি আপত্তি জানিয়েছিল যে এটি ইংরেজদের “প্রতিনিধিত্ব ব্যতীত কোনো কর প্রদান” করার অধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে বিশ্বাস করেছিল। শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা কর ধার্য করা হয় এবং এমন কোন সংসদের দ্বারা নয় যেখানে তারা প্রতিনিধিত্ব করেননি। সু-সংযুক্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেও ঔপনিবেশিক চা আমদানিকারকদের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যারা এই পদক্ষেপে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল এবং তাদের ব্যবসায় অতিরিক্ত লঙ্ঘনের আশঙ্কা করেছিল। বিক্ষোভকারীরা অন্য তিনটি উপনিবেশে চা আনলোড করতে বাধা দিয়েছিল, কিন্তু বোস্টনে, বিবাদমান রাজকীয় গভর্নর টমাস হাচিনসন চা গ্রেট ব্রিটেনে ফেরত দেওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন।(তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট)
যেখান থেকে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু সেই বস্টন হারবার এসেছি। প্রথমবার গিয়েছি মিউজিয়াম অব সায়েন্স দেখতে, আজ চার নভেম্বর ২০২৩ গেলাম বস্টন নিউ ইংল্যান্ড একুরিয়াম দেখতে। এ একুরিয়াম যেন আস্ত একটা সমুদ্র। তিনতলা ব্যাপী সমুদ্রের স্তরে স্তরে থাকা প্রাণী জগৎ দেখানো হয়েছে।
তাদের ভাষায় “we inspire peiple to love, respect and care for the Ocean. The New England Aquarium has protected and cared for the ocean and marine animals for more than 50 years. Here are a few of the animals in our care and that we study in the wild.”
একুরিয়ামের পানি স্বচ্ছ, টলটলে। ন্যাচারাল পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। নির্দেশনাগুলো মানুষ টো টো পালন করছে। কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় হতে দেখিনি। একটা মাল্টিকালচারাল কান্ট্রি বলতে যা বোঝায় যেন ঠিক তাই। সাদা,কালো,বাদামীর সংমিশ্রণে অপূর্ব এক জনগোষ্ঠী কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না।
একুরিয়ামেও তাই। সারাবিশ্বের মানুষের ঢল। আমি উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। হা করে গিলতেই আছি। একুরিয়াম দেখবো নাকি মানুষ! একজন নন্সটপ বর্ণনা করেই যাচ্ছেন কোন প্রাণী কোথা থেকে এলো, কোন মাছের বয়স কত,তাদের আচরণ কেমন, তারা কী খাবার খায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ভাবলাম, এই বর্ণনা কে কোথা থেকে করছে। খুঁজছিলাম। দেখি আমার পাশেই লোকটি কথা বলছেন। কর্ডলেস মাইক্রোফোন পকেটে। শিশুরা ভীষণ খুশি। আমার নাতনী ইনারা ব্যতিব্যস্ত। যা দেখছে তা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছে। তার বাবাকে অস্থির করে তুলছে, Papa I have a question…. Could you please…
আমার ছেলে উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। নোরাহ খুবই বিজি থাকতে পছন্দ করে, গ্যালারির মাঝে মাঝে বাটন দেয়া আছে। বাটন প্রেস করে দর্শক তথ্য জানতে পারে।
নোরাহকে বাটন থেকে সরালেই সে বাংলাদেশী চিৎকার করে! তার মা দিশাহারা হয়ে পড়ে। বাবাও তখন থামাতে পারে না। অনেক কষ্টে তার মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে হয়। নোরাহ আমার নাতনী। ইনারা বড়, নোরাহ ছোট। ভীষণ প্লেফুল বেবি কিন্তু রাগ করলে গগণবিদারি চিৎকার করে! তার মা এ ভাবে চিৎকার করতো কি না জানি না বাবা করতো না,করতো তার চাচা। মানুষ চাইলেই রক্তের সম্পর্ককে মুছে দিতে পারে না। তারা দুইবোন, আমার দুই ছেলে। যেন আমার ছেলেদেরই শৈশব দেখে এলাম!
দেখলাম,আমেরিকান শিশুরা হইচই যাই করুক খুব উচ্চ স্বরে শব্দ করে না। এক রকম শান্ত, খুব জেদ চিৎকার চোখে পড়েনি। নোরাহর চিৎকার শুনে তারা কানে হাতচাপা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মনে মনে বিরক্ত হয়েছি। আরে বাবা, তোমরা তো আট / নয় বছর হয়েছো,নোরাহ তো মাত্র দুই। এতো কানচাপার কী আছে! আমি নানান কথা বলে তার মাইন্ড চেইঞ্জের চেষ্টা করলাম। শবনম কোলে নিয়েই হাঁটছে।
ঘুরতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেয়েছি মনে পড়ে না। আমাদের দেশে এ রকম জনাকীর্ণ স্থানে কেউ কেউ ইচ্ছা করে ধাক্কা দিয়ে যায়। বাজে মন্তব্য করে। এখানে কিছুই দেখিনি। একে অপরকে প্লিজ প্লিজ বলে জায়গা ছেড়ে দেয়।
শিশু থেকে বুড়ো সকলেই হাসি হাসি মুখে হ্যালো বলছে, হাসি বিনিময় করছে। আমি ভাবছি এসব মেকি নাকি আসলেই এতো ভদ্র জাতি? জানলাম,বুঝলাম এরা আসলেই এমন।
আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিজেকে এখানে কেমন যেন বেমানান লাগছে!
সমুদ্রতল এক গভীর জগত। অনেকেই আছি জীবনে সমুদ্রই দেখিনি। যেমন আমি। সমুদ্র দেখা বলতে যা বোঝায় তার ধারে কাছেও যাইনি। তাই জানি না সমুদ্রের তলদেশে কী আছে। ছেলে নিয়ে গেলো বস্টন একুরিয়াম। বিশাল আয়োজন। একুরিয়ামের প্রবেশ পথে একজন সানাই বাজাচ্ছে। আমি ভাবলাম এটা কর্তৃপক্ষের কোন পদক্ষেপ, ভিজিটর যারা আসে তাদেরকে অভিবাদন জানানোর কৌশল। ফেরার পথে জানলাম এটা এক ধরণের ভিক্ষা বৃত্তি! দাঁড়িয়ে দেখলাম,লোকটি বিউগল বাজাচ্ছে, সামনে একটা কৌটা,তাতে লোকেরা টাকা দিয়ে যাচ্ছে। তবে তার সুর এতো সুরেলা ছিলো না। আমার ছেলে বললো, আম্মু সে প্রফেশনাল হলে এখানে বাক্স নিয়ে দাঁড়াতো না।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসলাম। মজা করে বললাম, আমার বাঁশের বাঁশিটি নিয়ে আসলে ভালো হতো! বউমা এক চিৎকার দিলো,আপনি আয় করবেন?
তার শাসনটা আমার দারুণ লেগেছে। অতঃপর ছেলের পথ অনুসরণ করে চলতে শুরু করলাম।
একুরিয়াম দেখতে দেখতে এতোটাই বিস্মিত হলাম যে আল্লাহু আকবর না বলে পারিনি। কারণ এমন সব প্রাণী সমুদ্রতলে- যাদের জীবন নেই আবার তারা মৃতও না। দেখে মনে হয় শৈবাল কিন্তু শৈবাল নয়। মাছের কতো রঙ, কত সাইজ, স্রোতের বিপরীতে কেউ চলে কেউ আবার স্রোতের অনুকূলে চলে, আমার ফোনে চার্জ শেষ। পুত্র তার ফোন এগিয়ে দিলো, আম্মু নিন। তার কন্যা নোরাহ যতোই কান্নাকাটি করুক না কেন সে কন্যাকে নিয়েই আমার সাথে সাথে চলছে, ইনারা যেন না হারায় সে দিকে খেয়াল রেখেছে। শবনম বেচারি বাচ্চাদের দিকে তাকাবে নাকি দেখবে!
আমাদের তো খাবারের ধান্ধা! তাই যতোই দেখি ততোই চিন্তা করি এ মাছগুলো খেতে ভালো লাগবে। তাদের লবস্টার দেখলাম, নীল ও সোনালী। অনেক ছোট বেলায় মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলোতে লবস্টার নাম পেয়েছি। জীবনে খাইনি। এবার দেখলাম। জায়ান্ট গ্রিন এন্মনে এক প্রকার প্রাণী সমুদ্রতলে বাস করে, নানান রঙের হয়। দেখতে মনে হয় বড় কোন শৈবাল। হাত পা মুখ কিছু নেই
কেবল চুলের মতো শেকড়। এগুলোকে Green giantan emone fishbole. ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। একুরিয়ামে প্রবেশ করতেই হলো সিলমাছ। সারাক্ষণ উলটা সাঁতার কাটছে। আমার নাতনী ইনারা সিলের সাথে সাথেই দৌড়াচ্ছে। ভোদড়ের মত একটা প্রাণী ভুস করেই ভেসে উঠছে তার ডাকছে। সে কী ডাক! Atlantic Horbor seal তার নাম।
পেঙ্গুইন দেখলাম। বিশাল একটা জায়গা জুড়েই পেঙ্গুইন। জোড়ায় জোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। হাঁসের মতো নয় দুইপেয়ে প্রাণীর মত। এই প্রথম এতো কাছ থেকে পেঙ্গুইন দেখলাম।
দুই প্রকারের পেঙ্গুইন।1.African Penguin 2. Southern Tockhipper Penguin.
জেলি ফিসগুলো আশ্চর্য রকম। প্রাণ আছে বলে মনে হয় না। অথচ বড় হচ্ছে। নড়াচড়াও করছে। আগা মাথা কিছুই খুঁজে পাইনি। রঙিন ছোট বড় মাছ। পুঁটিমাছের মতো, মলামাছের মতো আসলে তা নয়। ভিডিও করেছি।
Lookdown fish,(রূপচান্দার মতো),Goliath Grouper,Dwarf seahorse,Giant Pacific Octopus, california sea lion,cownose Ray, weedy seadragon, নানান নামের মাছ ও প্রাণী।
বিশাল এক মাছ আমার নাক বরাবর ভেসে বেড়ালো। এর যে কী নাম জানি না। দেখতে অনেকটা কোরাল মাছের মতো।এতো মাছ এতো নাম কয়টা মনে রাখতে পারি! আজকাল বাংলা নামই মনে থাকে না ইংরেজি নামের কথা বলাই বাহুল্য।
সাগরের উপরের স্তরে বাস করছে কচ্ছপ। দুই প্রকারের sea turtile, Green sea turtile আবার বাদুরের মতো পাখাওয়ালা মাছ। একগুলো মাছ রূপচান্দার আকার কিন্তু রূপচান্দা নয়। যতো প্রকারের মাছ দেখলাম তাতে আমাদের দেশী কোন মাছ দেখিনি।
shark রাখার জায়গা মেরামত হচ্ছে। তাই ওটি বন্ধ ছিলো। আমরা দেখতে গিয়ে নিরাশ হয়েছি। ইনারা খুবই মন খারাপ করেছে। তার জন্যই আমার বেশি খারাপ লেগেছে। এখানে ভায়ের পরিবারকে খুব মিস করেছি। ছেলেকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সময় দিয়েছে। নিয়ে গিয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত জায়গাগুলোতে। ছোটবেলায় কত মারধর করেছি। মনে পড়লে চোখ ভিজে যায়। মা হতে হলে অনেক লেখাপড়া জানা লাগে, আমি ছিলাম অশিক্ষিত মা, কষ্ট ছেলেদেরকে করতেই হয়েছ! এখন সে তার কন্যাদেরকে বড় করছে।
আমি বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের মূর্খ মা
আমার ছেলে উন্নত বিশ্বে শেকড় বিস্তার করছে। তার সন্তানেরা নিশ্চয়ই ভালো কিছু করবেই।
একুরিয়াম থেকে বেরিয়ে পাশেই ঘোরাফেরার জায়গা সেখানে বসলাম। ছেলে বললো, আম্মু এটা বস্টন হারবার। আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
আমাদের লঞ্চঘাটের মতোই কাঠ দিয়ে ঘাট বানানো হয়েছে কিন্তু অনেক সুন্দর, নিরাপদ। শিশুদের নিয়ে অনায়াসে ঘোরাফেরা করা যায়।
বসার জন্য চেয়ার, বেঞ্চ রাখা আছে। ময়লা ফেলার ডাস্টবিন আছে কভার দেয়া, ফুলের গাছ টবে।বেশ নান্দনিক মনে হয়েছে। আমরা ঘাটের যে প্রান্তে তার অপর প্রান্তে একদল নারী ড্যান্স করছে। সেদিকে যাবার জন্য মনে মনে চঞ্চল হলেও সময়ের কথা ভেবে ছেলেকে কিছুই বলিনি। দূর থেকে যা দেখা যায়! একুরিয়াম পার্কে নোরাহ খুবই উৎফুল্ল ছিলো। বার বার পানির দিকে যাবার ঝোঁক। তাকে আমরা ঘিরে ঘিরে রাখি। তাতে সে বিরক্ত। ইনারাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ছোট একটা মানুষ, এতো সময় ধরে ঘুরেছে ক্ষুধাও লেগেছে নিশ্চয়ই।
একুরিয়ামের ভেতর ডুবুরির পোশাকে নারী ও পুরুষ দুজন দু প্রান্ত থেকে খাবার দিচ্ছে। তাদের নিঃশ্বাসের সাথে বুদবুদ উঠছে। সে দৃশ্য তাকে চুম্বকের মতো ধরে রেখেছে। যতো দূর ডুবুরিরা খাবার দিচ্ছে সেও তাদেরকে অনুসরণ করছে। তার বাবা ডেকে যাচ্ছে দ্রুত পা চালানোর জন্য। আমি তার সাথেই আছি। যতোটা সম্ভব আধখাওয়া সিগারেটের মতো ইংরেজি দিয়ে বুঝিয়ে বললাম। আমাদের শৈশব গ্রামে। পুকুরে ডুব দিয়ে কতই বুদবুদ তুলেছি। তার সে সুবিধা নেই। একবার ভেবেছি বাথটাবে দেখিয়ে দেবো, পরে ভাবলাম, তাতে সর্বনাশ হবার সম্ভাবনা বেশি। আমি মাত্র এক মাসের জন্য গিয়েছি, চলে আসলে সে নিজে নিজে চেষ্টা করতে গিয়ে যদি খারাপ কিছু ঘটায়, তাতে কষ্টের অন্ত থাকবে না। কেন বুদবুদ ওঠে,কী ভাবে ওঠে, বুদবুদ না উঠলে কী হতো- এসব প্রশ্নের উত্তর একদিন সে পেয়েই যাবে। আমি মুখে মুখে বলেছি। চোখ দেখে মনে হয়েছে
তার আরো কিছু জানার বাকি।দ্রুত মাইন্ড চেইঞ্জ করে অন্যদিকে নিয়ে গেলাম। আমার ছেলে মাইন্ড চেইঞ্জের বদলে কেবল জোর খাটায়। বেচারি সারাদিন কাঁদে। নীরবে,নিজের কাছে নিজে পরাজয় স্বীকার করে,”আমি পারলাম না”। আমি বেদনার্ত হই নিজের অনুপস্থিতির জন্য। সাথে বাবা-মা ছাড়াও দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, মামা- খালা,- নানী এ সব সম্পর্কের মানুষ থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি দেখেছি, সে আমার কাছে এলে অন্য ইনারা,অনেক প্রশ্ন,অনেক আবেগ সব এক সাথে বের করতে চায়। নিজের স্কিলগুলো দেখাতে চায়। ফেরার সময় আমার তো কলিজা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে!
সন্ধ্যা প্রায় কাছাকাছি। আমরা গেলাম কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে। নামটা মনে হয় ‘লিগ্যাল সিফুড ‘। টেবিলে বসার সাথে সাথে খাবারের মেনু দিলো। আমাকে খাবার সিলেক্ট করতে বলল, আমি শবনমের দিকে এগিয়ে দিলাম। পরে তারা দুজন এবং ইনারা মিলে খাবারের অর্ডার করলো। এরই মাঝে নোরাহকে চেইঞ্জ করার জন্য শবনম তাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে গেলো। আবার তার চিৎকার। সে বিরক্ত হয়ে আছে। অনেক ক্ষণ বাইরে। শিশুদের জন্য এতো সময় বাইরে থাকা আসলেই
কঠিন তার দিবা ঘুম হয়নি আজ। সে কারণে আরো বেশি টক্সিক হয়ে আছে। সে মুক্ত আকাশের নিচে একুরিয়াম পার্কে বেশ হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত ছিলো। শবনম বেচারি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। তবুও বাবা-মা সহ্য করেই যাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, এ জন্যই মা-বাবা হওয়ার বয়স দাদী হওয়ার বয়স আলাদা।মেজাজ আলাদা। মন আলাদা।
রেস্টুরেন্টের সব টেবিল চেয়ার ভরা। আমি কেবল মানুষ দেখছি। আমাদের পাশের টেবিল থেকে একটা পরিবার উঠে গেলো। আবার আর একটা এলো। তাদের তিন সন্তান। তারা খেলো ঝিনুকের সাথে অন্য ব্রেড টাইপের খাবার। ছোট ছোট ঝিনুক। মনে হলো পোড়া দেয়া হয়েছে। শিশুরাও খাচ্ছে আর পাজেল মেলাচ্ছে। ওখানে একটা ব্যাপার আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। প্রতিটি টেবিলে রঙ পেন্সিলের বক্স, তাতে সাত রঙের সাতটি পেন্সিল,পাজেল কার্ড দেয়া আছে। খাবারের অর্ডারের পর সময় লাগে। ততোক্ষণে শব্দ-ধাঁধাঁ মেলাও বসে বসে।
আমাদের টেবিলেও আছে। ইনারা শব্দ-ধাঁধাঁ মেলানোয় ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি তার চোখ ভেজা। জানতে চাইলাম কী হয়েছে? সে বলে, আই ওয়ান্ট, ইরেসার। ভুল করে ফেলেছে। আমি চেষ্টা করলাম,নখ দিয়ে ঘষে মুছে দিতে।কিন্তু মোম রঙ তো মোছা যায় না। এ দিকে তার কান্নাও থামে না। পরে দেখি টেবিলে আর একটা আছে। শবনম সেটি এগিয়ে দিলো। এরপর শুদ্ধ ভাবে মিলিয়ে মহাখুশি। কোন কিছু না পারলে সে ভীষণ রকম আপসেট হয়ে পড়ে নিজেকে দোষ দিতে থাকে। আমি তাকে অনেকবার বুঝিয়ে বলেছি, না কেঁদে বার বার ট্রাই করো।
প্রতিবারই সায় দিয়েছে, ওকে। কিন্তু আবারো সে কাঁদেই। দুই বোনকে রেখে আসতে ইচ্ছা করেনি বাংলাদেশে। যদি সেখানে আমার একটা জব থাকতো,বাংলাদেশের মতো সুবিধা থাকতো, আমি ফিরতাম না শুধু দাদুমণিদের জন্য।
খাবার এলো। আমার জন্য রাইস,প্রন,টোস্টেড ব্রকলি।ইনারার জন্য পাস্তা কিন্তু ভিন্ন রকম ভাবে সাজানো, তাদের জন্য ব্রেড, ফ্রেঞ্চফ্রাই, অন্থন কিন্তু স্বাদ অন্য রকম, শ্রিম্প। আমাদের দেশের চিংড়ি মাছ ভাজা।
আমার নাক বরাবর সামনে দুই বৃদ্ধা খাচ্ছে আর আমাকে দেখছে। তাদের চোখে কাজল,গলায়,কানে, হাতে অর্নামেন্টস। চকচকে নয়। হালকা রঙের, পোশাকে আশাকে পরিপাটি। খাওয়ার স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে বেশ সুভ্যার তারা। বিল আসলে দুজনেই পকেট থেকে বিল বের করে দিলো। তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। হোটেলে কাজ করছে যে সব নারী তাদের আবার ইউনিফর্ম আছে। নারী-পুরুষ সবাই খুশি মনে কাজ করছে। আমাদের দেশে হলে এ সব সুন্দরী নারীরা এতো প্রাণবন্ত আর আত্মবিশ্বাসের সাথে কাজ করতে পারতো না শিউর। কিছু না হোক সারাক্ষণ, তুমি মোটা,তোমার ওজন কতো এ সব হলেও বলতো। যেমন করে আমার এক কলিগ,( নাম বললাম না) আরেক কলিগকে সারাক্ষণ এবিউজ করেছে তার ওজন কত এই নিয়ে। এখানে হলে নির্ঘাত জেল খাটতো। আমরা তো নীরবে সয়ে যাই!
শবনম জানতে চাইলো, আমার অনুভূতি, আমার ছেলে এতো দূরে বাস করছে, এতো কিছু করছে আমি অবাক কিনা?
সত্যি কথা বললাম, আমি অবাক হইনি। কারণ সে যেমন আছে তার চেয়ে বেশী সে ডিজার্ভ করে। এ বিদেশ-বিভুঁইয়ের সাথে তারা দুইভাই ছোটবেলাতেই পরিচিত। তাদের বাবা তাদের জন্য বেস্ট করার চেষ্টা করেছে। সৌদি আরবে বেড়াতে নিয়ে এ সব রেস্টুরেন্টে তাদের খাইয়েছে এবং তাদের বাবা ছিলো সব সময় আপ-টু-ডেট। পোশাকে আশাকে, চলায় বলায় পরিপাটি। তাদের কাছে তাদের বাবার প্রত্যাশা বেশি ছিলো। নতুন নতুন ট্যাকনোলজী বলি আর ভাবনা বলি যা কিছু এসেছে ছেলেদের তা দেয়ার চেষ্টা করেছে।
আমার ছেলে এবং বউ দুজনই স্বতঃস্ফূর্ত। এজন্যই বেশি ভালো লেগেছে।
আমেরিকা তো আমাদের দেশের মতোই মাটি-জল-কাদায় তৈরি। পার্থক্য হলো- তাদের দেশে শিক্ষা আগে শুরু হয়েছে আমাদের দেশে পরে। তারা আইন প্রয়োগ করে আমরা করি না। ভালো থাকতে হলে আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে, রাজনীতি সুস্থ ধারার থাকতে হবে, দেশের মানুষকে, আইনকে ভালো বাসতে হবে। এর কোনটাই আমাদের ভেতর নেই।
শাহানা সিরাজী
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।