পূর্বাচলে প্লট ‘উপহার’ দেওয়া হচ্ছে ১৮ সচিবকে
বিশেষ প্রতিবেদকঃ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিবসহ সরকারের ১৮ জন সিনিয়র সচিব ও সচিবকে রাজধানীর অভিজাত আবাসিক প্রকল্প পূর্বাচলে প্লট ‘উপহার’ দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বরাদ্দের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে এখন বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে।
বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে সাতজন সিনিয়র সচিব। বাকিরা সচিব বা সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
প্লট পাওয়া সিনিয়র সচিবরা হলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. কামাল হোসেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, ভূমি সংস্কার বোর্ডের সিনিয়র সচিব আবু বকর ছিদ্দীক, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। তাদের সঙ্গে রয়েছেন সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মো. বদরুল আরেফীন।
সচিবদের মধ্যে রয়েছেন লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মুহাম্মদ সলীম উল্লাহ, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবির, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর মো. আশরাফ উদ্দিন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (অর্থ ও প্রশাসন) সাবেক মৎস্য সচিব ড. মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম, নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হক, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইবরাহিম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের বোর্ড সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম বলেন, বরাদ্দ বিধিমালা অনুসারে রাজউক বিশেষ প্লট দিতে পারে। এসব প্লট বরাদ্দের আদেশ আসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে। রাজউক শুধু সেই আদশ বাস্তবায়ন করে।
বিশেষ কোটার কোনো প্লট অবশিষ্ট নেই। এ বিষয়ে এই বোর্ড সদস্য বলেন, প্রতি বোর্ডসভায় দু-একটি করে প্লট বরাদ্দ বাতিল হয়। মন্ত্রণালয় থেকে যে ১৮ জনের নামে প্লট দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের জন্য ছয়টি প্লট প্রয়োজন। প্লটগুলো দেওয়া হবে যৌথভাবে। ১০ কাঠার একটি প্লট তিনজনকে দেওয়া হবে। ১৮ জনের জন্য ৬টি প্লট প্রয়োজন। আশা করি এগুলো ম্যানেজ করতে সমস্যা হবে না।
গত ২৯ আগস্ট রাজউকের ১১তম বোর্ডসভায় সচিবদের নামে বিশেষ কোটায় ১৩এ (১) সি ধারায় প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে গত ১৪, ১৬ ও ১৭ আগস্ট ছয়টি চিঠিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউক চেয়ারম্যানকে সচিবদের নামে প্লট বরাদ্দ দিতে নির্দেশ দেয়।
বিশেষ কোটায় প্রত্যেকের নামে একটি করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার মতো প্লট না থাকায় তিনজনকে যৌথভাবে ১০ কাঠা আয়তনের একটি করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে ছয়টি গ্রুপে ১৮ জনকে ৬০ কাঠা জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে। এসব প্লটের মূল্য কাঠাপ্রতি তিন লাখ টাকা, যা রাজউকের তহবিলে জমা দিতে হবে। যেই তিনজন ১০ কাঠা আয়তনের প্লট পাবেন তারা চাইলেই প্লট ভাগাভাগি করে ছোট করতে পারবেন না। তাদের যৌথভাবে বাড়ি নির্মাণ করতে হবে।
রাজউকের প্রতিটি প্রকল্পের প্লটের নির্ধারিত মূল্য রয়েছে। একেক প্রকল্পে প্লটের একেক দাম। এর মধ্যে পূর্বাচল প্রকল্পে আবাসিক প্লটের প্রতি কাঠার মূল্য তিন লাখ টাকা। তবে প্রতি কাঠা আবাসিক প্লটের বাজারমূল্য ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা।
রাজউকের এস্টেট ও ভূমি শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, পূর্বাচলের ১০ শতাংশ প্লট বিশেষ কোটার জন্য সংরক্ষিত। এসব প্লট ইতিমধ্যে বরাদ্দ হয়ে গেছে। প্লট না থাকার পরও মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশ বাস্তবায়ন করছে রাজউক। এর আগে একজন সচিবকেই ১০ কাঠার প্লট দেওয়া হয়েছে। এখন যেসব প্লট দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর প্রতিটির বাজারদর প্রায় ১০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্লট বরাদ্দ পাওয়া এই কর্মকর্তারা তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন সরকারের এক আদেশেই।
রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস) রুলস, ১৯৬৯ অনুসারে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বিধিমালা অনুসারে রাজউক কোনো আবাসিক প্রকল্প নিলে প্লট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করে। পরে আবেদন যাচাই-বাছাই করে যোগ্যদের প্লট বরাদ্দ দেয়। তবে এই বিধিমালা ১৯৮৬ সালে সংশোধন করে নতুন একটি উপবিধি (১৩-এ) যুক্ত করা হয়, যা সংরক্ষিত কোটা নামে পরিচিত। এই কোটাতেই মূলত মন্ত্রী, সংসদ সদস্য (এমপি), সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ২০০৯ সালে ৫ আগস্ট ১৩-এ উপবিধিটি আবার সংশোধন করে নতুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। সেখানে ১৩-এ উপবিধির (১)এ অনুসারে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের, (১)বি অনুসারে সংসদ সদস্যদের এবং (১)সি অনুসারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, কেউ সরকারি চাকরিতে অবদান, জনসেবা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলে তারা বিশেষ কোটায় প্লট পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে সে ক্ষেত্রে প্লট বরাদ্দ পেতে আগ্রহীকে প্রধানমন্ত্রী কিংবা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করতে হয়। ওই আবেদন অনুমোদন পেলে সেটি রাজউকের বোর্ডসভায় বা সাধারণ সভায় উত্থাপন করতে হয়। বোর্ডসভায় প্লট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। প্লট বরাদ্দ দেওয়া-সংক্রান্ত রাজউকের নথিতে ‘অবদান’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য থাকে না। মূলত এ বিধিমালা হচ্ছে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী পছন্দের লোককে প্লট উপহার দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া।
একজন কর্মকর্তা জানান, উল্লিখিত ১৮ সচিবের অবদান কী সেটা স্পষ্ট নয়। এসব কর্মকর্তা সারা জীবন সরকারি চাকরি করেছেন। তাদের মতো আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা প্লট পাননি বা তাদের পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সাধারণত সরকারের ‘গুড বুকে’ থাকা কর্মকর্তারা এভাবে প্লট পান। এর আগেও সরকার সচিবদের প্লট দিয়েছে। তবে এবার জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ও জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে প্লট দেওয়ায় সরকারের ভেতরই সমালোচনা শুরু হয়েছে। এর ফলে নির্বাচন প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি হবে বলেও অনেকে মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নষ্ট হয়ে গেছে। তারা দলীয় আনুগত্য বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। নির্বাচনের আগে সচিবদের প্লট দেওয়া হচ্ছে এটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।’
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কর্মকর্তা। এর আগে তিনি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় ও সংস্কার) সচিব।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান এর আগে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি ঢাকা ও সিলেট বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। একই মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ২০২২ সালে সচিব পদে পদোন্নতি পান। এর আগে তিনি একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর সচিব পদে পদোন্নতি পান। ২ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন। এর আগে তিনি জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির ২০২১ সালের ১৫ জুন সচিব পদে পদোন্নতি পান। এর আগে তিনি একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব ছিলেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মুহাম্মদ সলীম উল্লাহ একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
বিপিএটিসির রেক্টর আশরাফ উদ্দিন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন।
নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান একজন পেশাদার কূটনীতিক। তিনি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সুইজারল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত এবং জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। এর আগে তিনি সিঙ্গাপুরে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
সাবেক খাদ্য সচিব বরুণ দেব মিত্রের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জব্দ
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
চুক্তি থেকে মুক্তি মিলবে কবে? জনপ্রশাসনে নিবর কান্না; বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস