মুই কারে কী হমু – শাহানা সিরাজী

Picsart_22-11-11_04-36-11-035.jpg

মুই কারে কী হমু – শাহানা সিরাজী

রোজ জার্নি। সকাল বিকাল
রোজ কত গল্প বানাই, লেখা হয় না। কিছুটা আলসেমি কিছুটা স্বাস্থ্যগত জটিলতায়।
রোজ কত প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করে,কিন্তু করি না। কারেই বা করবো। চারদিকে চাটুকারের দল।
রাস্তার দুপাশ দেখলে মনে হয় না আমাদের দেশে দরিদ্র আছে অথচ সেই ইফতারের ক্ষণ থেকেই শুনছি “খালাম্মা দেন কিছু সাহায্য’। কী জানি অনেকেই বলে ওদের এতো অভাব নেই।কিন্তু ওই যে অন্ধ ভিক্ষুকটি, ইকবাল গাড়িতে তারও অবস্থা ভালো? জানি না।
অই যে কুঁজো লোকটি যার পিঠে কুঁজ, এক পা বাঁকা, এক হাত শুকনো লিকলিকে। তার তিন কন্যা, মা ফাতেমা, উম্মে কুলসুম, বিবি জয়নব – যাদের নাম শুনলেই নাকি মানুষ বেহুঁস হয়ে যায় তারও অবস্থা খুবই ভালো কী? তাহলে ভিক্ষা করতে এসে এতো কাকুতি মিনতি কেন করে? এসব প্রশ্ন যেমন মাথায় ঘুর ঘুর করে তেমনি
এজি অফিসের কালুর কথাও ভাবি, যে কোন ফাইল গেলেই শান্ত এবং ধীর ভাবেই বলবে,ফাইলে ঘাপলা আছে, কাজ হবে না ফেরত নিয়ে যান। কিন্তু যেই না চকচকে টাকা দেখে অমনি চেহারার খুব সুরাত পালটে যায়। পান চিবায় আর বলে,আচ্ছা দেখি কী করা যায়। তারপর দ্রুতই পট পালটে যায়।
একই রকম ভাবে যখন দেখি একই গ্রেডের অনেকেই গাড়ি হাঁকায় আমি মৌমিতায় ঝুলে ঝুলে চলি তখন প্রশ্ন জাগে, আমার গাড়ি কোথায়?
আবার যখন দেখি পচার বাড়ির যদু, মায়ের ভিক্ষার ঝুলি এখনো যত্নে তুলে রেখেছে। সে শুধু তামাক ব্যবসা করেই গাড়ি বাড়ি নয় রীতিমতো আধুনিক সুবিধাজনক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে হাজার হাজার মানুষের কর্ম সংস্থান করছে, দুহাতে দেদারাসে বিলোচ্ছে তখন নিজেকে একজন তামাক ব্যবসায়ী ভাবতে খুব ভালো লাগে। স্বপ্নেরা ডালাপালা মেলে, তামাকের টাকায়,গরু কিনবো, গরুর দুধের কোম্পানী দেবো,নাম দেবো “পিউর মিল্ক”। “নিশ্বাসে বিশ্বাসে বাঁচুন” শ্লোগান দেবো চারদিকে। আহা! দিনে দিনে আমার হাজার কোটি টাকা সুইচ ব্যাংকে চলে যাবে! তখন কেবল ওই মধু ওয়ালার কথা মনে হয়। ” না ম্যাডাম, এই মধু বেঁচবো না, বাড়িতে যাবো,এটাকে ২০ কেজি বানবো, তারপর দুইশ টাকায় খাঁটি মধু বিক্রি করবো।” মধুওয়ালার সরল স্বীকারোক্তিতে আমি মুগ্ধ হইনি বরং ভেবেছি এটাও দুইশটাকার মধু আটশ টাকায় বিক্রির চাল! সেই চালের ভেতর আমার ভীমরতি হয়েছে, অবশিষ্ট টাকা খাঁটি মধু পাওয়ার লোভে হারিয়ে এসেছি। তাহলে কালু আর যদুর কথা বলে লাভ কী? যদু হয়তো তার তামাকের ব্যবসা দেখিয়ে ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে সুইটজারল্যান্ড ভেগেছে, মধুওয়ালা ব্যাংক নয় আমার ব্যাগ লোপাট করে মিটিমিটি হাসছে, বাসায় যেতে চাল কিনে নেবে। আমিও যদুর মতো লোভে নিজেকে দেউলিয়া বানিয়ে ইকবালে উঠে দেখি টাকা নেই, ড্রাইভার দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে” লাগবে না আফা বহেন” মানুষ হিসেবে উত্তম কে? কালু,যদু, মধুওয়ালা, ড্রাইভার নাকি আমি?
উত্তর খুঁজতে খুঁজতে স্বপ্নের ল্যান্ডক্রজারে বসে ঘুমিয়ে পড়লাম, হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে জাগলাম, আফা, রেললাইন এসেছে, নেমে যান।
ব্যাগ হাতড়াতে লাগলাম। এতো বড় ব্যাগ কানা কুঞ্চিতে কিছুই কী নেই? তাহলে এতোক্ষণ তামাক বিক্রির টাকা গেলো কই?
এ সময় মোবাইলের খাপে পেয়ে গেলাম একশত টাকার নোট, এ যাত্রায় রলখা পেলাম বটে প্রশ্ন রয়েই গেলো,আগে কেন পেলাম না? ইচ্ছা করে নাকি জাতিগত স্বভাব, মিথ্যা বলা, চুরি? উত্তর খোঁজার আগেই দেখি মিশকাত লম্বা সালাম দিয়ে বললো, ভাবী রোজা রাখছো,কই যাও?
মাথায় টুপি,লম্বা জোব্বা, লাল রঙের কী সুন্দর গাড়ি! গ্লাস নামিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ভাবী তোমার দোয়ায় এবার জি এম হয়েছি। কুন্ঠিত হলাম, অবসাদ গ্রাস করেছে। মিশকাতের এতো সুন্দর গাড়ি। সেতো আমাকে তুমি সম্বোধন করতাও না! ভাবী, বাড়ি বানিয়েছি, আল্লাহর ইচ্ছায়, বনানীতে,ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কিনেছি। আমি কিন্তু ইন্সুইরেন্স কোম্পানি খুলেছি, “ইসলামিক ইনভেস্ট ইন্সুইরেন্স “। তুমি আইসো কিন্তু। কোথা যাচ্ছো? এসো নামিয়ে দিই।
এবার নিজেকে আবিষ্কার করলাম বনানীর বিশাল এক বাড়ির ড্রিইং রুমে। আবদুল কি রে এতো বালি কেন? আমার এলার্জি আছে জানিস না? আবদুল দৌড়ে এসে নিজের শার্টের হাতা দিয়ে ক্লিন করে দিচ্ছে। মিশকাত আবার ডাকলো, কী এতো ভাবছো, বলতো?
কেন যেন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করেনি,এতো টাকা কোথায় পেলেন? আমাকে তুমি করেই বা কেন সম্বোধন করছেন? ভাবী, সামনে এম পি ইলেকশন করবো। তোমায় এ ভাবে ঝুলতে দেখে মায়া হচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে সামনে পা বাড়ালাম।
জনগনের টাকা,রাজস্ব,রাজ কোষাগার,কে কোথায় কী ভাবে লুটে নিচ্ছে সে প্রশ্ন যখন করার কেউ নেই,আমিও পারি না তখন মধু ওয়ালা আমাকে ঠকিয়ে দুটো চাল কিনলে অসুবিধা নেই। মধুর বোতলে হাত রাখি।
আমার পকেট খালি হোক, মধু নকল হোক, মধুওয়ালার সন্তান কেবল পেট ভরে খাবে।
কালু- যদু- মিশকাতেরা মসজিদ -মন্দির- স্কুল- কলেজ, ব্যাংক -বীমা স্থাপন করুক।

আমি ঝুলতে থাকি,উৎসব থেকে বন্ধন,বন্ধন থেকে মৌমিতা, তারপর অনাবিল-লাব্বাইক, ইকবাল। সি এন জি থেকে অটো, তারপর মুনের মতো একদিন রেললাইন থেকে নামতে না নামতেই ভ্যানের সাথে ধাক্কা খাবো। সাধের দুনিয়ার, স্বপ্নের এখানেই সৌধ হয়ে যাবে! তবুও শান্তু, তবুও মুক্তি। রাজকোষাগার লুট করিনি। কালু যদু তারা বাঁচুক, দেশের ঝুড়ি তাদের ব্যক্তিগত হোক।

প্রশ্ন করার যখন কেউ নেই
আমিও যখন প্রশ্ন মাথায় নিয়ে চলতে থাকি বলতে পারি না
তখন পারুল খালার কথাই সঠিক, মুই যে কহন কেমনে মরি যামু হে চিন্তায় বাঁচি না, কারে কী কমু!

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ) পিটিআই মুন্সীগঞ্জ।
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন।

নারী-পুরুষের সম্মিলিত শক্তিতে পৃথিবী হোক পুষ্পিত বাগান – শাহানা সিরাজী

আরও পড়ুন।

“আমানত উল্যাহ সিরাজী ফাউন্ডেশন ” এর গুণীজন সম্মাননা ও ইফতার সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম ২০২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top