বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইচ্ছেমতো ফি নয়; কঠোর হচ্ছে নিয়মনীতি

Picsart_23-01-31_09-19-36-891.jpg

বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইচ্ছেমতো ফি; কঠোর হচ্ছে নিয়মনীতি

স্বাস্থ্য প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোর পক্ষে বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৬৫ শতাংশ চিকিৎসা বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত প্রদান করছে। চাহিদার তুলনায় সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংকট, জনবলের অপ্রতুলতার কারণে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা।

নামি-দামি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি অনেকগুলো আছে যেগুলো মানসম্মত নয়।

একদিকে যেমন বিলাসবহুল হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, তেমনই রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। করোনার সময় নামিদামি হাসপাতালগুলো যেমন চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছে, তেমনি অনেক বেসরকারি হাসপাতাল সেবার নামে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। চিকিৎসার নামে মনোপলি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

ঢাকার বাইরে অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিজস্ব ভবন নেই, বিরাজ করছে নোংরা ও চরম অব্যবস্থাপনা। হচ্ছে ভুল অপারেশন। সিজারিয়ানের প্রয়োজন নেই, তারপরও সিজারিয়ান করাচ্ছে। সিজারিয়ান করতে গিয়ে অনেক বাচ্চা ও মা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংকটাপন্ন অবস্থায় মা ও শিশু উভয়কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। ভুল সিজারিয়ানে পরবর্তীতে বাচ্চার শারীরিক ও মানিসক জটিলতা সৃষ্টি হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রতিদিন ভুল সিজারিয়ান অপরাশেন হয়েছে, এমন রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করছি। অনেকের অঙ্গহানী নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। ঢাকার বাইরে বেশি হচ্ছে বলে তারা জানান। রোগী মারাও যাচ্ছে।

আইসিইউ নেই, কিন্তু আইসিইউয়ের নল মুখে লাগিয়ে রোগীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এবার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ফি আদায়ের দিন শেষ হতে যাচ্ছে।

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সেবার ফি নির্ধারণ করে দেবে সরকার। সরকারের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতৃবৃন্দ। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক পক্ষও বিষয়টি সাধুবাদ জানিয়েছে, তবে বাস্তবায়নে তারা সময় চেয়েছেন।

বেসরকারি হাসপাতালের বেড সংখ্যা, যন্ত্রপাতি, অবস্থান, লোকবল, সুযোগ-সুবিধা ভেদে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ, বি, সি, ডি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দেওয়া হবে। ‘এ’ ক্যাটাগরির এক রকম সুবিধা, ‘বি’ ক্যাটাগরির এক রকম সুবিধা এবং ‘সি’ ক্যাটাগরি হাসপাতালগুলো মান ভেদে এবং সুযোগ-সুবিধা উল্লেখসহ সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করা থাকবে। এতে মানুষ আগে থেকেই জানতে পারবে-কোন হাসপাতালে গেলে কী কী কি সুবিধা পাওয়া যাবে এবং চিকিৎসা বাবদ কত ব্যয় হবে। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ফি নির্ধারণের বিষয়টি অর্ডিনেন্সে উল্লেখ আছে। সরকার অর্ডিনেন্সটি আইনে রূপান্তর করতে যাচ্ছে। এ জন্য মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদে আইনটি পাশ হতে হবে।

এই বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এগুলোর বাস্তবায়ন হলে স্বাস্থ্যসেবার নামে বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো বিধিবহির্ভূতভাবে যে বাণিজ্য করে আসছে, তা রোধ হবে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিশ্চিত হবে সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা। এতে জনগণ প্রতারিত হবে না, সঠিক মূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে। সেবা গ্রহীতারা উপকৃত হবে এবং মালিক পক্ষও উপকৃত হবে।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীল আলম বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। ছয় মাস আগে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।


স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক আগামী এক মাসের মধ্যে এটা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালের মালিকরা বলেন, সব বেসরকারি হাসপাতালের অবকাঠামো এক নয়। ডাক্তাররা প্রাইভেট চেম্বারে বসেন। তাদের কোন ভাড়া দিতে হয় না। ডাক্তারদের ফিও নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানান তারা। তারা বলেন, ২৫০ শয্যার কোন কোন হাসপাতালে এমআরআই, সিটি স্ক্যান ও ইসিজি পরীক্ষারও ব্যবস্থা নেই। অথচ তারা একই ক্যাটাগরিতে কেন পড়বে? সব ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, অনেক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বেশিরভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই। রোগীদের পরীক্ষা না করিয়ে প্যাডে একটা রিপোর্ট প্রদান করেন। অথচ রোগীদের কাছ থেকে গলাকাটা রেট নেন। অর্থাৎ দেশে নাম সর্বস্ব প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, যার সিংহভাগেরই রেজিস্ট্রেশন নেই। এসব অনিবন্ধিত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি বিভাগ রয়েছে। তারাও সেখানে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না।

ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনদের এগুলো মনিটরিং করার কথা। তারাও এগুলো সঠিকভাবে মনিটরিং করেন না। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এসব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা পেয়ে থাকেন। এ কারণে প্রকাশ্যে অবৈধ ক্লিনিকে গলাকাটা বাণিজ্য চলছে। নিঃস্ব হচ্ছে গরীব মানুষরা।

করোনার সময় লিভার ফ্যাংশন টেস্ট ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। এই পরীক্ষা করার ব্যবস্থা যেসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেই তারাও একই রেট নিয়েছেন। অথচ তারা আগে নিত ৩০০ টাকা।

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেকিড্যাল কলেজ হাসপাতাল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মমিন খান ও সাধারণ সম্পাদক ড. আনোয়ার খান বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ক্যাটাগরি নির্ধারণে আধুনিক যন্ত্রপাতি বিবেচনায় নিতে হবে। কেউ চীন, কেউ সুইজারল্যান্ডের যন্ত্রপাতি ও রি-এজেন্ট এনেছে। আবার কেউ পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত করে নিয়ে আসে।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. জামাল চৌধুরী বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ফি নির্ধারণে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে তার সবাইকে মেনে চলতে হবে। তবে এটা নির্ধারণে সময় দিতে হবে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, বিএমএ, স্বাচিপ ও বিএমডিসি এক সাথে বসে ক্যাটাগরির বিষয়টি চূড়ান্ত করে সরকারকে জানাবেন।


বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স এসোসিয়েশনের অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, গত ৫০ বছরে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ফি নির্ধারণ হয়নি। তবে এখন হচ্ছে, এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। এর জন্য সময় দিতে হবে। মালিক পক্ষ, বিএমএ, স্বাচিপ নেতৃবৃন্দসহ সবাই বসে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top