সরকারের বদলি নীতি মানে না রাজউক! ১০ থেকে ২০ বছর বহাল তবিয়তে কর্মচারীরা
অপরাধ প্রতিবেদকঃ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) টেলিফোন অপারেটর তরিকুল ইসলামের দায়িত্ব সেবাগ্রহীতাদের টেলিফোন ধরা এবং কর্মকর্তাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ইন্টারকমে ফোন ধরিয়ে দেওয়া। বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা আঞ্চলিক কার্যালয়ে এ দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। অথচ সাত বছর ধরে রাজউকের জোন-১ এস্টেট (সম্পত্তি) শাখায় অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত তরিকুল।
তিনি রাজউক কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এ পদে দায়িত্ব নিয়েছেন। কারণ, এস্টেট শাখায় থাকলে প্লটের ফাইলপত্র নাড়াচাড়া করে কিছু বাড়তি কামানো যায়। এ জন্য এ শাখা ছাড়তে চান না তিনি। ফলে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বছরের পর বছর একই স্থানে রয়েছেন এ টেলিফোন অপারেটর।
কেবল তরিকুল ইসলামই নন; রাজউকে এ রকম শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাঁরা বছরের পর বছর এস্টেট শাখার মতো সুবিধাজনক স্থানে পদায়নরত। কখনও বদলি হলেও এক-দু’মাসের মধ্যে আবারও তদবির করে ‘মধুময়’ জায়গায় ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের পোস্টিংয়ের পছন্দের জায়গার মধ্যে রয়েছে গুলশান-বনানী, পূর্বাচল ও উত্তরার এস্টেট শাখা।
একেকজন ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত একই স্থানে কর্মরত। অথচ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রণীত বাংলাদেশ সার্ভিস রুলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, বদলিযোগ্য হলে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন বছর অন্তর বদলি করতে হবে।
সরকারি কর্মচারীদের বদলির সাধারণ শর্তাবলিতে এটা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাজউকে এ নিয়ম কখনোই অনুসরণ করা হয় না। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বছরের পর বছর একই স্থানে থেকে ফুলেফেঁপে উঠছেন। দুর্নীতির শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে গাড়ি-বাড়িসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন সাধারণ সেবাগ্রহীতারা।
তাঁদের ম্যানেজ করতে না পারলে হারিয়ে যায় ফাইলের গতি। কখনও কখনও ফাইল গায়েব হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারও কারোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও মামলা চলমান। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ জমা পড়লেও সেগুলো আমলে নেয়নি রাজউক।
রাজউক কর্মচারীদের বদলি প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইলে, রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা গণমাধ্যমকে জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি তাঁরও নজরে এসেছে। কারা দীর্ঘদিন একই স্থানে কর্মরত – এ ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনের তালিকা হাতে পেয়েছেন। কিন্তু কয়েকজনকে বদলি করলে তখন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে বিধায় এ ধরনের যাঁরা আছেন তাঁদের সবাইকে একসঙ্গে আন্তঃবদলি করা হবে। তখন কেউ আর এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। এক মাসের মধ্যে এটা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আগে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংকটের একটি স্তূপ তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, কানুনগো আব্দুস সাত্তার প্রায় দশ বছর ধরে পূর্বাচল সেলে দায়িত্ব পালন করছেন। পূর্বাচলের প্লটের সীমানা চিহ্নিতকরণসহ নানা কাজ হাতে থাকায় তাঁর আয় বেশ ভালো। অবশ্য আব্দুস সাত্তার বলেন, ২০১৫ সাল থেকে তিনি আছেন। কর্তৃপক্ষ তাঁকে রেখেছে। এখানে তাঁর কোনো করণীয় নেই।
পূর্বাচলের সহকারী পরিচালক ফারিয়া সুলতানা চাকরিজীবনের শুরু থেকেই ওই জায়গায় কাজ করছেন। কতদিন ধরে পূর্বাচল সেলে কর্মরত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা প্রশাসন থেকে জেনে নেন। এতদিন আমার পদোন্নতি দেয়নি। এখন শুনছি আমাকে নাকি বদলি করে দেবে।’
উচ্চমান সহকারী ইউসুফ হোসেন সাত বছর ধরে জোন-১-এ (গুলশান-বনানী-বারিধারা) কর্মরত। অবশ্য তিনি বলেন, এতদিন হবে না, বছর চার-পাঁচ হলো আছি। এর আগে প্রশাসনে ছিলাম। হিসাব সহকারী রবিন হোসেন, অফিস সহকারী মনোয়ারা, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর গিয়াস উদ্দিন ১৩ বছর ধরে পূর্বাচল এস্টেটে। রবিন হোসেন বলেন, ‘পূর্বাচলে আমার এতদিন হবে না। চার-পাঁচ বছর হতে পারে।’
অথরাইজড অফিসার নুরুজ্জামান জাহিদও ছয় বছর ধরে জোন-৫-এর (ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর এলাকা) দায়িত্ব পালন করছেন। অবশ্য তিনি গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন- বছর চারেক হতে পারে এখানে।
নিয়ম মানে না রাজউক
বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসের ‘সরকারি কর্মচারীদের বদলির সাধারণ শর্তাবলি’ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘একই পদে তিন বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বেই মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও উহার অধীনস্থ দপ্তর/পরিদপ্তরসমূহের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাগণকে নতুন পদে/স্থানে বদলি করিতে হইবে।’
২ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলের ক্ষেত্রে উক্ত আদেশ প্রযোজ্য হইবে যদি বর্তমানে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী পদটি বদলিযোগ্য হইয়া থাকে।’ কিন্তু রাজউকে এটা কখনোই অনুসরণ করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এর পেছনে অনেক বড় বাণিজ্য রয়েছে। যাঁরা থাকেন তাঁরাও সুবিধাভোগী; যাঁরা তাঁদের রাখেন তাঁরাও সুবিধাভোগী। উভয়ের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকার কারণে তাঁরা সুবিধা পান আর ভোগান্তিতে পড়েন সেবাগ্রহীতারা।
আরও যাঁরা গেড়ে বসেছেন
ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হেলাল উদ্দিন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে উত্তরার (এস্টেট-৩) এস্টেট শাখায় কর্মরত। অফিস সহকারী কেএম আস্তান তারা বিপ্লব ১০ বছর ধরে উত্তরার এস্টেট শাখায়। অফিস সহকারী নারগিস ও রেকর্ডকিপার আলমগীর হোসেন ১১ বছর ধরে উত্তরার এস্টেট শাখায় কর্মরত।
সহকারী পরিচালক জুয়েল সেরনিয়াবাত উত্তরা অফিস প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সেখানে এস্টেট শাখায় কর্মরত। উচ্চমান সহকারী ফুয়াদ আল সিরাজ পূর্বাচল এস্টেটে ১৫ বছর। নকশাকার শেখ ফরিদ আট বছর ধরে জোন-৬-এর (মতিঝিল) এস্টেট শাখায়।
কর্মরত সাঁটলিপিকার শরীফ সদস্য (প্রশাসন)-এর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে আছেন আট বছর। অফিস সহকারী আশিকুজ্জামান ১২ বছর ধরে পূর্বাচলে। তত্ত্বাবধায়ক উজ্জ্বলও তা-ই। অফিস সহায়ক মান্নান ১২ বছর পূর্বাচলে।
উচ্চমান সহকারী অলিউর রহমান ওলি এস্টেট-১-এ আছেন ১৫ বছর। সুপারভাইজার আলাউদ্দিন ১৩ বছর ধরে এস্টেট-১-এ কর্মরত।
উচ্চমান সহকারী রেবেকা সুলতানা ১৭ বছর ধরে এবং উচ্চমান সহকারী পাপিয়া সুলতানা ২০০৯ সাল থেকে পূর্বাচল এস্টেটে কর্মরত।
মাঝে পাপিয়া সুলতানাকে একবার বদলি করা হলেও তিন মাস পরই আবার তদবির করে পূর্বাচল এস্টেটে ফিরে যান।
উচ্চমান সহকারী সাইদুর রহমান ও অফিস সহকারী ইউসুফ মিয়া ১২ বছর ধরে এস্টেট-১-এ কর্মরত।
সুপারভাইজার মাসুদ রানা ১২ বছর ধরে পূর্বাচলে। অফিস সহকারী হাসনা হেনা ২০০২ সাল থেকে পূর্বাচল এস্টেটে। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নজরুল ইসলাম ২০০০ সাল থেকে জোন-৩-এ কর্মরত।
তত্ত্বাবধায়ক মোফাজ্জল হোসেন ঝিলমিল প্রকল্পের এস্টেট শাখায় আছেন ২০০৭ সাল থেকে। বনানীর এফআর টাওয়ার মামলারও আসামি তিনি।
সার্ভেয়ার মাসুম বিল্লা জোন-৩-এ আছেন ১০ বছর। তাঁর বিরুদ্ধে দুদকে মামলা চলমান।
এভাবে নকশাকার শেখ ফরিদ, অফিস সহকারী আশিকুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক উজ্জ্বল, অফিস সহকারী মান্নান, উচ্চমান সহকারী অলিউর রহমানও দীর্ঘদিন ধরে একই স্থানে কর্মরত।
এ রকম শ-খানেক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাঁদের একই স্থানে তিন বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বদলি করা হয়নি।
একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, কর্মকর্তাদের খুশি করে তাঁরা বছরের পর বছর একই স্থানে আছেন। যাঁরা খুশি করতে পারেন না, তাঁরা ডাম্পিং জোনেই থাকছেন।
অফিস সহায়ক দুদু মিয়া বলেন, ‘চাকরিজীবনের শুরু থেকে গত ৩৪ বছর আমাকে যান্ত্রিক বিভাগে রাখা হয়েছে। সবাই ভালো ভালো জায়গায় পোস্টিং পায়। আমাকে রেখে দেওয়া হয়েছে যান্ত্রিকে। এখান থেকেই হয়তো আমাকে অবসর নিতে হবে।’
তবে, একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সরকারের বদলী নিয়ম মেনে চললে কর্মকর্তাদের উপরি ইনকাম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সিনিয়র কর্মকর্তারাই বদলি চান না। যদি সরকারের নিয়ম নীতি মেনে বদলি প্রক্রিয়া চলতেন, তাহলে ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারাও বছরের পর বছর কিভাবে রাজউকের একই পদে; একই স্থানে চাকুরী করছেন?
সরকারের বদলির আইন তো সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্যই সমান।