সম্পর্ক – শাহানা সিরাজী

Picsart_22-02-04_08-25-45-054.jpg

সম্পর্ক – শাহানা সিরাজী

এক এক সময় মনে হতো, ধুর! এ জীবন দিয়ে কী হবে! এর চেয়ে আত্মহত্যা করে জীবনের সাঙ্গ করে দিই! তো সেই প্রয়াসে একাধিকবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। প্রথমবার পারিনি আম্মার জন্য। ভাবছেন আম্মা বুঝি কান্না কাটি করছেন! না তা মোটেই নয়। নয় দশ বছরের একটা বালিকাকে কে ভালোবাসলো আর কে বাসলো না, কার ভালোবাসার ধরণ কী তা সেই বালিকার বোধে আসা এতো সহজ ছিলো না। যখনকার কথা বলছি তা হলো টিভি -মিডিয়া- নেট -মোবাইল পূর্ব যুগ।

আম্মা মাথায় মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন তার খিস্তি খেউর করছেন,তোর বাপে তোরে অমুকের সাথে বিয়া দিবোনি? তুই যে অমুকের লগে পিরিত কইচ্ছস? আমি চমকে উঠলাম! পিরিত মানে? তার মানে ওই লোকটি আমার সাথে পিরিত করে? ওমাগো! কী লজ্জা! নিজে নিজে বড় লজ্জিত হলাম! লোকটি আমাকে স্নেহ করে, নো ডাউট! অংক মিলিয়ে দেয়,ইংরেজী পড়িয়ে দেয়। স্কুলের স্যারদের মতো মারপিট করে না। বকে না। এটাই আমার আনন্দ, ভালো লাগা।
কিন্তু আম্মা কী বলে! সেইদিন সুইসাইড করতে ইচ্ছা হয়েছিলো। গ্রামের লোকেরাও কী সব বলাবলি করছে। মুখ নিয়ে সামনের রুমে আসার উপায় নেই। সব চেয়ে বড় ব্যাপার ছোট ছোটো ভাই-বোনদের কাছে কেমনে দাঁড়াবো!

তো সেদিন মরতে গিয়েও পারিনি। কারণ আমার মনে হয়েছে, আম্মা যদি সঠিক কথা বলে থাকেন যে ঐ লোকটি আমাকে ভালোবাসে তাহলে আমি মরবো কেন? আমি তো বলিনি আমাকে ভালোবাসো! দ্বিতীয়তঃ বাসলে বাসে, খারাপ তো কিছু করে না। আমি যে সে সব তালে নেই আম্মাকে সেটা বোঝাতে হবে। মরলে আম্মার ধারণা পাক্কা হয়ে যাবে!
তাই ফেরত আসালাম।

তারপর পড়াশোনায় কঠিন মনোযোগ দিলাম। ঐ লোকটির ধারে কাছেও গেলাম না। শয়তান লোক, আমি ছোটো,তুই তো ছোটো না, জানিস মানুষ খারাপ বলবে, তারপরও কেন ভালোবাসলি! এখন আমার অংক মিলে না! যাই হোক কোথা থেকে অংকের সমাধান বই হাতে এসে পড়েছে। আব্বা এনেছেন নাকী সেই লোকই পড়ার টেনিলে রেখে গিয়েছে জানি না। আমি পাতা পাতা মুখস্ত করে ফেললাম!

পরীক্ষায় ডিজিট বদলে অংক এসেছে। সেদিকে আমার খেয়াল নেই। সোজা যা মুখস্ত করেছি তা লিখে দিয়ে এক ঘন্টায় পরীক্ষা শেষ। অংক স্যার দেখলেন,ক্লাসের ফার্স্টগার্ল এবার ফার্স্ট হওয়াতো দূরে, পাস নিয়েই টানাটানি পড়বে। কিন্তু আমার জন্য তাঁর মায়া কাজ করেছে। এক ঘন্টায় খাতা দিয়ে বটতলায় বসে বসে আচার খাচ্ছি। কোথা থেকে অংকস্যার এলেন জানি না, ধুম করে পিঠে এক কিল দিলেন যে তাতে আমার ব্রার হুক পিঠে গেঁথে রক্ত পিঠ ছুঁইয়ে কোমরে নেমে এলো।
বান্ধবীরা হাসাহাসি করছে। পরীক্ষার খাতা একবার জমা দিয়ে আবার পরীক্ষা দিচ্ছে। ওদিকে সারা দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! তারা তো জানে না আমার কী হয়েছে! তারা তো জানে না অংকস্যারের ভালোবাসা! চোখ ভিজে গেলো যেন ভোরের কুয়াশার স্পর্শ! আচারের স্বাদ এখনো জিহবায় লেগে আছে। কিন্তু স্যারের কিলের বেদনায় সব ম্লান। যতোটা না বেদনায় তার চেয়ে বেশি লজ্জায়!

স্যার রেগে রেগে বললেন, প্রশ্ন ভালো করে পড়! ডিজিটগুলো চশমা দিয়ে দেখ! এক একটি শব্দ যেন হিমালয়ের মতো উঁচু, চিলের মতো বাজখাই! বেতকাঁটার মতো মারাত্মক। কান্নায় আমার পিঠ বার বার দুলে উঠছে।

কোথা থেকে সেই লোকটি এলো, পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো, সরি,সমাধান বইটি টেবিলে রাখা উচিত হয়নি। আমি একবারও তাকাইনি। তোর জন্য একবার মরতে গিয়েছি। আবারো মরতে যেতে হবে তোর জন্য। বেটা ফাজিল! ইচ্ছা মতো বকা দিতে দিতে খাতায়ও লিখে ফেললাম,বেটা ফাজিল। তাই দেখে অংকস্যার হেসে দিয়ে বললেন, কাউকে এতো ঘৃণা করতে হয় না,আবার এতো ভালোও বাসতে হয় না। এবার বিরক্ত হলাম, “হেরের ভেতর ভের”। কিসের ভেতর কী? যাই হোক বাসায় আসলাম পরে আম্মা আবার দিলো মাইর। পিঠের এ জায়গায় ছিঁড়লো কী করে? কোন ছেলে ছাড়া মেয়ের কাজ নয় এটা- সুতরাং দাও মাইর! শালার মাগুলোর গোষ্ঠি কিলাই! মা হয়েছে বলে শুধুই মারবে? কিছুই বুঝবে না? কিছুই বিশ্বাস করবে না? আবার ভাত বেড়ে যখন ডাকে,যখন ঘুমের ভেতর বালিশ ঠিক করে দেয়,কাঁথা গায়ে তুলে দেয় তখন মনে হয় মায়ের চেয়ে জগতে আপন কেউ নেই।

তো সেদিনও মরতে গিয়েছি। পরে ফিরেছি। না আম্মার ধারণা পাক্কা হয়ে যাবে! কোন ছেলেমানুষ আমার গায়ে বদ উদ্দেশ্যে হাত দেয়নি।
আম্মা পরে বুঝতে পেরেছেন,এটা অংক স্যারের কাজই,আমি মিথ্যে বলিনি। কারণ ইনফেকশন ভালো ভাবে হয়েছে। এর জন্য ডাক্তার বৈদ্য অনেকদূর গড়াতে হয়েছে। অংকস্যার কাচুমাচু করে বললেন, তুই হাফেজের মতো অংক করে খাতা জমা দিয়েছিস,দেখলাম,তোর পাশ করা মুশকিল হয়ে যাবে। তুই ছাড়া আর কেউ ফার্স্ট হতেই পারে না। তাই মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি।
শুনেই আমি ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু করে দিলাম। স্যার আপনি আমাকে এতো ভালোবাসেন? আম্মাকে বলবো আপনার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে তাহলে আর অংক ভুল হবে না।
স্যার তো আক্কেল গুড়ুম। ছিঃ ছিঃ । আর বলিস না! লোকে শুনলে কী বলবে!
আমি বললাম, বল্যজ গে” শুধু লোকে বলেই! যখন তখন,যা মন চায় তাই বলে! লোকের কথায় আমার কাজ নেই। আপনার সারহে বিয়ে হলে আর হাফেজের মতো অংক করা লাগবে না! আমি নিশ্চিত হয়ে বাড়ি ফিরলাম। মনে মনে ফূর্তিতে রইলাম। ভাবছি আম্মার চেহারা কেমন হবে! কঠিন শাস্তি বটে!

ফিরেই আমার রণমূর্তি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। হিন্দা বেটারে তুই বিয়া করবি? হ্যাঁ? এ ধরনের কথা কেমনে বললি? তোরে অই হিন্দা বেটার লগে বিয়া দিমু? বলেই মাইর। চুল ধরে। আমি খুব সাউন্ড ভয়েসে বললাম, তাহলে আর অংক ভুল হবে না! ও মাগো! যে দিকে যাই সেদিকেই কেবল মাইর!
আম্মা ব্যাঙ্গ করে বললেন, অংক স্যারকে বিয়া করলে অংক ভুল হবে না,ইংরেজী স্যারকে বিয়া করলে ইংরেজী ভুল হবে না, ভূগোল স্যারকে বিয়া করলে ভূগোল ভুল হবে না! তোর পড়া লাগবে না,খালী বিয়াই কর!
সেদিনও মরতে গিয়েছিলাম, আমি এতো বোকা কেন? কিন্তু মরিনি আম্মার ধারণা পাক্কা হবে যে আমি বোকা!

সেবার আমি অংকে ১০০ তে ৯০ পেয়েছিলাম। অংকস্যার আমার প্রতি আরো স্নেহাদ্র হয়ে উঠলেন, একটা মেধাবী বোকা মেয়ে! চোখে চোখে রাখতেন। কখন আবার কার কোন ব্যাপার ভালো লেগে যায় আর বলে বসি, আম্মারে বলবো, আপনার সাথে আমাকে বিয়া দিতে তাহলে আমি রোজ নতুন জামা পরতে পারবো! খেতে,পারবো! একবার,স্কুলের মাঠে জেলে মাছ নিয়ে এসেছে। এতো বড়ো বড়ো মাছ দেখে চোখ ছানা বড়া। অংকস্যার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন আমি বাস্তবে নেই।কোন স্বপ্নের জগতে যেখানে জেলেনী মাছের নানান পদ রান্নায় ব্যস্ত। অংকস্যার কালবিলম্ব না করে বললেন, তোদের পুকুরে এর চেয়ে বড় মাছ আছে,তাই না? চল এখন ক্লাসের যাবি। আমার স্বপ্নটা আম্মাকে জানানোরবকথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আরেকবার
সত্যি কিন্তু বলতে গিয়ে ছিলাম- আপনার এতো বড়ো দোকান! সব জামায় ভরা! আম্মাকে বলবো – এরপর কোথা থেকে অংকস্যার এলেন, বললেন, বলা লাগবে না, আম্মা জানে তুই যে ডাক্তার হবি, এই লোক অসুস্থ হয়ে তোর হাসপাতালে ভর্তি হবে, তুই তার চিকিৎসা করবি। আমি এতোটাই এক্সাইটেড হলাম,পারলে স্যারকে কাঁধে তুলে নাচি,পরে শরম পেয়ে বললাম, স্যার সত্যি বলছেন? আম্মা তো ধান্ধায় থাকে কখন আমারে বিয়া দিয়া ঘর খালী করবো! আজ আম্মারে জিজ্ঞাস করবো, কথাটি সঠিক কি না?

আম্মাকে আমার জিজ্ঞাস করা হয়নি। বাড়ি গিয়ে দেখি ঢেঁকিতে কালিজিরা চালের বারা বানতেছে, আজ আমার গায়ে হলুদ।
কার সাথে বিয়ে, কেন বিয়ে, অংকস্যার বলেছেন,আম্মা জানে আমি নাকি ডাক্তার হবো, তার কি হবে কিছুই জানি না। কেবল হলুদবাটা মিহি হয়নি,মেহেদী পাতায় রঙ নেই এ সব নিয়ে কান্না কাটি করছি। কান্নার ফাঁকে সেই লোকটিকে কয়েকবার লেখলাম, আম্মার সাথে হেসে হেসে কথা বলতে,ব্যস আর পায় কে? সোজা আব্বার কাছে চালান দিলাম, আব্বা দেখেন, আম্মায় ওই লোকের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, আম্মা নিশ্চয়ই লোকটাকে ভালোবাসে! আব্বা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, আমাকে বুকে নিয়ে হুহু করে কাঁদলেন।তুই এতো বোকা কেন?

আমি বিস্মিত হলাম, আব্বা বোকা কেন হবো? আম্মাই তো বলেছেন, ওই লোক আমার সাথে হেসে কথা বলে মানে আমাকে ভালোবাসে। এখন আম্মার সাথে হেসে কথা বলছে,মানে আম্মাকে ভালোবাসে। ঐকিক নিয়ম অনেক সহজ আব্বা। আব্বা আরেকদফা কেঁদে আমাকে বললেন, আয় হাতে নকশা এঁকে দিই। আমি বললাম,আব্বা আপনি নকশা আঁকবেন? জীবনেও এঁকেছেন? সেবার ঈদে ওই লোকটি সুন্দর করে নকশা এঁকে দিয়েছিলো। তাকে তো বলতে পারবো না। আম্মার চেঁচা কে খাবে! বাপ রে!

আব্বা বললেন, আয় আজ আমি এঁকে দেবো।
আব্বা নকশা আঁকলেন। একটা বাড়ি, পুকুর। পুকুর পাড়ে আমি। বললেন, সাবধান পা পিছলেই পুকুরে পড়ে যাবে। সব সময় সাবধানে চলবে।
তখন বুঝিনি। আজ বুঝি আব্বা কী বোঝাতে চাইলেন!

তারপরের দিন বাসর রাত। হিন্দুদের বিয়ে সুন্দর।কতো আনুষ্ঠানিকতা। তারা আগেই তাদের বরকে দেখে ফেলে। আমি দেখতে পাইনি। আমার পক্ষে আব্বা কবুল বলেছেন।
আমি সাজগোজ মেহেদী, কুমকুম এ সব নিয়ে ব্যস্ত হলাম। তারপর সফুরা খালা আমাকে সাজানো গোছানো একটা ঘরে বসিয়ে রাখলো। বললো, বর আসতেছে। আমি লজ্জারাঙা বউ এর মতো ঘোমটা দিয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি কেউ একজন আমার ঘোমটা খুলে নিচ্ছে। পান্না বলেছিলো, বর যখন ঘোমটা খুলবে তখন চোখ বন্ধ করে রাখতে হবে। তাকে আমার জিজ্ঞেস করা হয়নি,কেন চোখ বন্ধ রাখতে হবে! কিন্তু আমিও চোখ বন্ধ করলাম, অনুভব করলাম,কেউ একজন আমার কপালে তার ঠোঁট লাগিয়ে চু করে চুমু দিচ্ছে মুখে ফিসফিস করে উচ্চারণ করছে আমার মেধাবী বোকা বউ।
ওমা কে? চোখ খুলেই আম্মা গো দেখে যান বলেই এক চিৎকার… আম্মা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির কী হয়েছে?
আমি আম্মার আঁচলের তলে মুখ লুকিয়ে বললাম, মাইর দেবেন না কিন্তু, দেখেন ওই লোকটা আমার বাসর ঘরে ঢুকেছে, আমার কপালে চুমু দিয়ে বলে আমার মেধাবী বোকা বউ। আমার বর কোথায়?

ঘটনার আকস্মিকতায় আম্মাই বোকা বনেছে তা নয়,সেই লোকটি যে পালিয়ে গিয়েছে আজো ফিরেনি।

এরই মাঝে আমি ডাক্তারিও পাশ করেছি। বিদেশে গিয়েছি। বুঝতে শিখেছি। কিন্তু ঐলোকটিকে আমি ভুলিনি। তার জন্য কোনদিন আমার অপেক্ষা ছিলো না। আমি আমার ধাঁচে স্কুলে গিয়েছি,কলেজে,মেডকেল সায়েন্সে পড়েছি। আমার অংকস্যার এক মুহূর্তের জন্য আমার উপর থেকে তাঁর স্নেহের ছায়া সরায়নি।
কারণ ঐ বিয়েতে স্যার এর মত ছিলো না। স্যারের একটাই স্বপ্ন এ গাঁয়ের ইতিহাস আমাকে দিয়ে ব্রেক করাবেন। ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন,নয়তো আমলা।বানাবেন। স্যারের ইচ্ছা আমি পূরণ করেছি কিন্তু আম্মার ইচ্ছায় গরমজল!. আম্মা শূন্য চোখে আমার দিকে এখন তাকিতে থাকেন, আমি দেখি সেই ভয়াল রুদ্ররূপ, আমার চুল ধরে পেটাচ্ছেন,ঐলোকটার সাথে তোর কী সম্পর্ক!

হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেলো, আমি হাসলাম, সত্যিই তো ঐ লোকোটির সাথে আমার কী সম্পর্ক!

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর সাধারণ
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ।
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top