শাহজালালে ট্রলির কৃত্রিম সংকট
নেপথ্যে শতকোটি টাকার বাণিজ্য!
অপরাধ প্রতিবেদকঃ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হঠাৎ ট্রলি সংকট দেখা দিয়েছে। এর নেপথ্যে আছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যারা শতকোটি টাকার বাণিজ্য হাসিল করতেই মূলত এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
তাদের অভিমত-দীর্ঘদিন ধরে ওই সিন্ডিকেট বিমানবন্দরে ট্রলি সরবরাহের চেষ্টা করে আসছিল। তারা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে বিনা মূল্যে এই ট্রলি সরবরাহ করতে চাচ্ছিল। শুধু শর্ত ছিল-ট্রলির গায়ে তাদের মনোনীত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে হবে। কিন্তু প্রয়োজন না থাকায় কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে ট্রলি নিচ্ছিল না। আর এ কারণেই এই সময়কে বেছে নিয়ে সিন্ডিকেট বড় ধরনের সংকট তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই দফায় সফলও হয়েছে ওই সিন্ডিকেট। ইতোমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে আড়াই হাজার ট্রলি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) পেয়েছে।
অপর একটি প্রতিষ্ঠানও বিনা মূল্যে অচল ট্রলিগুলো সচল করে দেওয়ার জন্য সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। যে কোনো সময় প্রতিষ্ঠানটিকে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হতে পারে। সূত্র জানায়, একটি ট্রলিতে কোনো প্রতিষ্ঠান এক মাস বিজ্ঞাপন দিলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। সেক্ষেত্রে ২৫০০ ট্রলিতে এক মাস বিজ্ঞাপন দিলে মাসে আয় হয় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বছরে আয় ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। ট্রলি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, একটি ট্রলি ১২ থেকে ১৫ বছর ব্যবহার করা সম্ভব।
সেক্ষেত্রে ১০ বছর ব্যবহার করা গেলেও আয় কমপক্ষে দেড়শ কোটি টাকা। ট্রলি ক্রয় ও সংস্কার করতে ৫০ কোটি টাকা খরচ হলেও বাকি ১০০ কোটি টাকা লাভ। জানা যায়, কোনো ধরনের খরচ ছাড়া মাসে মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের এই বাণিজ্য পেতে সরকারের অনেক প্রভাবশালী ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অফিসে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে শাহজালালে মোট ২ হাজার ট্রলি রয়েছে। এর মধ্যে ৬শ অচল ছিল। বাকি ১৪শ ট্রলি ভালো। সম্প্রতি ৫শর বেশি অচল ট্রলি সচল করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রতিদিন চলছে একধরনের কৃত্রিম সংকট। অভিযোগ আছে, এই সিন্ডিকেট ট্রলি সার্ভিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্মীকে মাসোহারা দিয়ে সচল ট্রলিগুলোকে বিমানবন্দরের বিভিন্ন জায়গায় ফেলে রাখছে। যাত্রীরা ট্রলি করে মালামাল নিয়ে টার্মিনালের বাইরে গেলে ট্রলিম্যানরা সেগুলো ফ্লাইট নামার সময় যথাযথ জায়গায় নিয়ে আসছে না। উলটো নানা জায়গায় ফেলে রাখছে। যে কারণে ফ্লাইট অবতরণের পরপরই চরম ট্রলি সংকট দেখা দেয়।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ উল আহসান যুগান্তরকে বলেন, রাতে ফ্লাইট বন্ধ থাকার কারণে উড্ডয়ন-অবতরণ মিলে প্রায় ২০টি ফ্লাইটের জন্য দিনে নতুন শিডিউল করতে হয়েছে। প্রথমদিকে ট্রলি ও জনবল সংকটসহ নানা কারণে যাত্রীদের কিছুটা দুর্ভোগ হয়েছে। কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের কারণে এখন ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
জানা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে এখন প্রতিদিন গড়ে দেশি-বিদেশি ২৭টি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছে। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১১০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। সব মিলে দিনে গড়ে ১০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। এছাড়া নন শিডিউল ফ্লাইট তো রয়েছেই। তবে বেশির ভাগ নন শিডিউল ফ্লাইট কার্গো হওয়ায় যাত্রীসেবার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। তবে অভিযোগ উঠেছে-সম্প্রতি কার্গো নন শিডিউল ফ্লাইট বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বিমানের ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত শতাধিক ট্রলিম্যান ও ট্রাফিক হেলপারকে বদলি করে কার্গো বিভাগে পাঠিয়েছে।
যে কারণে হঠাৎ বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিভাগকে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। কার্গো বিভাগে এত কর্মীর প্রয়োজন না থাকার কথা জানালেও ট্রাফিক বিভাগ রহস্যজনক কারণে ওইসব ট্রাফিক হেলপারকে নিয়ে আসছে না। অভিযোগ উঠেছে নিয়োগ বাণিজ্য করার জন্য একটি সিন্ডিকেট রহস্যজনক এই বদলি করেছে।
সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সরেজমিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি দুর্ভোগের জন্য যাত্রীদের কাছে ক্ষমাও চান। তিনি স্বীকার করেছেন, কয়েকদিন ধরে ট্রলিসহ বিভিন্ন সংকটের জন্য অনেক যাত্রী ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। এ ব্যাপারে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ট্রলি সমস্যারও সমাধান করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে আড়াই হাজার ট্রলি যুক্ত হবে বিমানবন্দরে।
তিনি বলেন, বিমানবন্দরে এখন প্রচুরসংখ্যক যাত্রী আসা-যাওয়া করেছেন, যা কোভিড-পূর্ব সময়ের থেকেও বেশি। প্রচুরসংখ্যক মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রী করোনা টেস্টের জন্য বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকায় যাচ্ছেন। সেখানে করোনা টেস্টের নমুনা দিয়ে ফলাফলের জন্য ৩-৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। তারা ট্রলিগুলো সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায় টার্মিনাল ভবনগুলোয় ট্রলি সংকট দেখা যায়। প্রতিমন্ত্রী বলেন, যাত্রীদের ট্রলির সংকট সমাধানে আমরা ৩২ জন কর্মীকে দায়িত্ব দিয়েছি। শিগগির আরও ৫০ জন নিয়োগ দেওয়া হবে।