ছয় বছরে পাচার চার লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা

ছয় বছরে পাচার চার লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা

বিশেষ প্রতিবেদকঃ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি তাদের ওয়েবসাইটে এ তথ্য প্রকাশ করে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩৪টি দেশের বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে কিভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়, সেই চিত্র তুলে ধরেছে জিএফআই। পাশাপাশি একটি দেশ অন্য দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি করার সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কম-বেশি দেখানো হয়। মূল্য ঘোষণার বাড়তি অংশের অর্থ বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। এমন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জিএফআই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ সাল বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় চার লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৯০ টাকা হিসাবে)। এই পরিমাণ অর্থ দেশের চলতি বছরের (২০২১-২০২২) জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। অর্থপাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে চীন থেকে। এর পরই আছে পোল্যান্ড, মেক্সিকো, ভারত ও রাশিয়া।

জিএফআই প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে অর্থপাচারের বিশ্লেষণ তুলে ধরে। এক দশক ধরে কাজটি করছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশের ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য উঠে এসেছে।

জিএফআই বলেছে, উন্নয়নশীল দেশ থেকে বেশি অর্থ পাচার হয় আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত দাম গোপন করে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ২০১৫ সালে বিদেশে পণ্য কেনাবেচার যে খতিয়ান দিয়েছেন, তার ১৮ শতাংশই ভুয়া। আমদানিতে বেশি আর রপ্তানিতে কম দেখিয়ে ওই বছর গায়েব করা হয়েছে এক হাজার ১৮৭ কোটি ডলার যা, এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাচারের অর্থের সংখ্যাটি বড়। এসব অর্থের উৎস মূলত দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়। তবে পাচারের ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক অবস্থা বিশেষ করে নিজের নিরাপত্তা, পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন কেউ মনে করেন, এসব নিরাপত্তা নেই কিংবা থাকলেও ভবিষ্যতে না থাকার অনিশ্চয়তা থাকে, তখন অনেকে বিদেশে অর্থ পাচার করে।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘আমলা, ব্যবসায়ী প্রায় সবার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁরা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় আস্থা নেই। অনেকে বাড়ি বিক্রি করছে, সম্পদ বিক্রি করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে টাকা সরানো এখন কঠিন কিছু নয়।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাচার হওয়া অর্থের একটি আংশিক চিত্র দিয়েছে জিএফআই। প্রতিবছরই নানা কায়দায় অর্থ পাচার বাড়ছে। যাঁরা অর্থ পাচার করছেন, তাঁরা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে অনেক প্রভাবশালী। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

জিএফআইয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ রিক রডেন বলেন, আমদানির সময় ভাউচারে দাম বেশি দেখিয়ে এবং রপ্তানির সময় দাম কমানোর মাধ্যমে মূলত অর্থ পাচার করা হয়। এভাবে অর্থপাচারের পরিমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বাংলাদেশে।

এবার জিএফআই ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। করোনা মহামারির কারণে পরবর্তী বছরগুলোর তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে বাংলাদেশের তথ্য আছে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। তাদের দাবি, জাতিসংঘকে টানা তিন বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তথ্য দেয়নি বাংলাদেশ।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়নি। ২০১৫ সালের পর থেকে জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কোনো তথ্য নেই। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য সব দেশের যত আমদানি-রপ্তানি হয়, তাতে গড়ে ১৭.৩ শতাংশের মূল্য ঘোষণায় গরমিল থাকে।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের পর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ এক হাজার ১৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। ২০০৯ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫২১ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৬৮৪ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮৭৩ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং ২০১৩ সালে ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার করা হয়।

প্যানডোরা পেপারসের নতুন তালিকায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত আটজনের নাম পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) সম্প্রতি এই তালিকা প্রকাশ করে।

বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে—হাইকোর্ট জানতে চাওয়ার পর কর ফাঁকিসংক্রান্ত পানামা ও প্যারাডাইস কেলঙ্কারিতে উঠে আসা দেশের ৪৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা দিয়ে আপাতত কাজ সেরেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দেশ থেকে অর্থপাচার কারা করে, জানেন না বলে সম্প্রতি সংসদে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top