হিরণ্ময় বঙ্গবন্ধু – শাহানা সিরাজী
হিরণ্ময় বঙ্গবন্ধু এই আমাদের স্বদেশে। আসুন কেন তাঁকে আমরা হিরন্ময় বলবো- হিরণ্ময় শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ ব্রহ্মা। ব্রহ্মা হচ্ছেন ইশ্বরের সৃষ্টিরূপ। সনাতস ধর্মএ অবতার রূপে পৃথিবীতে এসে সকল দুষ্কৃতিকারিকে বিনাশ করে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে। অন্য আর একটি অর্থ হচ্ছে সোনায় গড়া।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অর্থে ব্রহ্মা অন্য অর্থে সোনায় গড়া। যিনি অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন বজ্রকঠিন কণ্ঠ। জীবনের এত তৃতীয়াংশ কাটিয়েছেন অন্ধকার কারাগারে। যিনি পূর্ববাংলার সাথে সংঘটিত প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন ঈগল ছিলেন বাজপাখি। তাঁর হাতে ছিলো প্রতিবাদের ঝান্ডা।
যে তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট দেশ ভাগ হয়েছে পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা বিভক্ত হয়েছে সে তত্ত্বকে উড়িয়ে জিন্নাহ স্টেট এর স্থলে স্টেটস করে আমাদেরকে তাদের প্রদেশ বানিয়ে শোষন নির্যাতন শুরু করেছে। পূর্ব বাংলাকে শস্যভূমি বানিয়েছে, এ দেশের জনগনকে নিরক্ষর করে রাখার কেীশল, সেনাবাহিনীর মতো জায়গায় এ দেশের উপস্থিতি নগন্য করে রাখা।
কেন্দ্রীয় সরকার কাঠামোয় জটিলতা, ভাষার উপর আগ্রাসী আক্রমণ করা, সংস্কৃতিকে দাবীয়ে রাখার মতো নিকৃষ্ট কাজগুলো এ দেশের মানুষের প্রাণকে,শ্বাসকে অবরুদ্ধ করে রেখে ছিলো। এ দেশে উৎপাদিত অর্থ পশ্চিম বাংলায় নিজেদের উন্নয়নে এবং নিজেদের দেশের জনগনের সুবিধা নিশ্চিত করণের কাজে ব্যবহৃত হতো। পূর্ববাংলার অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবহেলায় ছিলো। অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতে হতে দেশের মানুষ কৃষকায় হয়েছিলো।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া হলঃ বছর পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় (কোটি রুপি) পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় (মোট শতাংশ)পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় (কোটি রুপি)পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় (মোট শতাংশ)
% জনসংখ্যা ৪৪.০০ ৫৬.০০ ১৯৫০-৫৫ ১,১২৯ ৬৮.৩১ ৫২৪ ৩১.৬৯
১৯৫৫-৬০ ১,৬৫৫ ৭৫.৯৫ ৫২৪ ২৪.০৫
১৯৬০-৬৫ ৩,৩৫৫ ৭০.৫ ১,৪০৪ ২৯.৫০
১৯৬৫-৭০ ৫,১৯৫ ৭০.৮২ ২,১৪১ ২৯.১৮
মোট ১১,৩৩৪ ৭১.১৬ ৪,৫৯৩ ২৮.৮৪
Source: Reports of the Advisory Panels for the Fourth Five Year Plan 1970-75, Vol. I, published by the planning commission of Pakistan (quick reference: crore = 107, or 10 million)
শেখমুজিবুর রহমান এ সবের বিরুদ্ধে ছিলো তীব্রপ্রতিবাদী এক কন্ঠ। ফলে তাঁকে বার বার বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছিলো। ছয়দফা দাবী এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রাজসাক্ষী। তিনি ছয়দফা দাবী তুলে পূর্ববাংলার জনগনের অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। ছয়দফা দাবী আসলে কী ছিলো চলমান প্রজন্ম কী জানে? একটি ঘর তুলতে হলে অনেক কিছুরই প্রয়োজন হয়। প্ল্যান, অর্থর সংস্থান, জমি কেনা, মেটেরিয়ালস কেনা, শ্রমিক যোগানো সব শেষে একটা একটা করে ইট-সুরকির গাঁথুনি দেয়া। সব শেষে প্রলেপ দেয়া। কেউ যদি প্রলেপ দিয়েই বলে আমিই এ ঘরের নির্মাতা তাহলে তা যেমন অসত্য হবে তেমনি কেউ যদি বলে যুদ্ধের সময় শেখ মুজিব তো বন্দি ছিলো তিনি কী ভাবে দেশ স্বাধীন করলেন! লিজেন্ড হলেন তাও হাজার কোটিবার ভুল হবে।
আমরা যদি ছয়দফা দাবীর দিকে লক্ষ্য করি তাহলে সব পরিস্কার হয়ে যাবে। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহেরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিত্রিত করা হয়। ফলে নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি এর সম্মেলন বর্জন করেন।
১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি সংগৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমেদের ভূমিকা সংবলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল ছয় দফাঃ আমাদের বাঁচার দাবি।
২৩শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়।
২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয়দফা কর্মসূচীর ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি শহিদ হন।
৬ দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ ছিলেন সিলেটের মনু মিয়া।
চলুন দেখে আসি ছয় দফাদাবীগুলো কী ছিলো-
প্রস্তাব – ১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;
প্রস্তাব – ২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
প্রস্তাব – ৩ : মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
(খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
প্রস্তাব – ৪ : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
প্রস্তাব – ৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
1. (ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
2. (খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
3. (গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
4. (ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
5. (ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
• প্রস্তাব – ৬ : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
ছয় দফা ঘোষণার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ-এর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?” আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব: “আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।”
ঘুরিয়ে বলা এই এক দফা হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন। পরবতীতে তা হয় স্বাধীনতার ডাক।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলনের দাবী উঠেছে কিন্তু ছয় দফার দাবির মধ্য দিয়ে এটি একক এজেন্ডায় পরিণত হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে এই দফা পেশ করেন। অনেকে এসব দাবিকে “রাজনৈতিক বোমা” বলে উল্লেখ করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রওনক জাহান বলেন, এর আগে বাঙালির রাষ্ট্রভাষা থেকে শুরু করে আরো অনেক এজেণ্ডা ছিল। কিন্তু ছয় দফা দেওয়ার পর থেকে জাতীয়তাবাদের বিষয়টি একমাত্র এজেন্ডায় পরিণত হল।
”তখন লোকজনকে সংগঠিত করা অনেক বেশি সহজ হল। হয় আপনি আমাদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে,” তিনি বলেন।
”একারণে শেখ মুজিব খুব দ্রুত সকল মানুষকে জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার পক্ষে নিতে পারলেন এবং ৭০-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দেশকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত পথে নিয়ে গেলেন,” রওনক জাহান বলেন।
আরেকবার দেখি ছয় দফার মূল বক্তব্য কী ছিলো-
৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন।
বাংলার সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ৬ দফা ব্যাপক সমর্থন পায়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ১৯৬৬ সালে ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। তাকে এ ধরনের হয়রানিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
৭ জুন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতার মুক্তির দাবিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন তথা বাঙালি জাতির মুক্তির ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্ণ দিবস হরতাল আহবান করেছিল। অভূতপূর্বভাবে সে হরতাল সাড়া দেয় ছাত্র-শ্রমিক-জনতাসহ সারা দেশের মানুষ। হরতাল বানচাল করতে পুলিশ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে গুলি চালায়। এতে ঢাকার তেজগাঁওয়ে শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, ওয়াজিউল্লাহসহ ১১ জন এবং নারায়ণগঞ্জে সফিক ও শামসুল হক নিহত হন। আহত হন অনেকেই।
সরকারের বিরূপ প্রচারণা ও অত্যাচারে ৬ দফা আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৬ দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায় ঠিক সেই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামি করা হয়। স্বৈরাচারী শাসকেরা ভেবেছিল মামলা দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দেবেন। কিন্তু হলো তার বিপরীত। আগরতলা মামলা দায়েরের পর তিনি পরিণত হন মহানায়কে।
সরকারের যড়যন্ত্র ছাত্র-যুব-জনতা ব্যর্থ করে দেয় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। প্রিয় নেতাকে তারা সেনানিবাসের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন। মুক্তি পেয়ে তিনি তার ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
ঐতিহাসিক দিনটি বাঙালির স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক, অবিস্মরণীয় একটি দিন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে যেসব আন্দোলন বাঙালির মনে স্বাধীনতার চেতনা ও স্পৃহাকে ক্রমাগত জাগিয়ে তুলেছিল ৬ দফা আন্দোলন তারই ধারাবাহিকতার ফসল।
এরই ধারাবাহিকতায় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অবিস্মরণীয় বিজয়, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পথ ধরে দেশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের মুক্তি যুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
৭মার্চের ভাষণ একদিনে আসেনি। এর জন্য বহুবছর রাজপথে সংগ্রাম করতে হয়েছে। জেল খাটতে হয়েছে। পরিবার পরিজনকে বঞ্চিত করতে হয়েছে। ইট-পাটকেল খেয়ে খেয়ে তবেই এ দিনটিকে আনতে হয়েছে। অজ্ঞ নিরক্ষর এ দেশের মানুষকে জাগাতে হয়েছে। স্বপ্ন দেখাতে হয়েছে। মানুষের মনে বিশ্বাস জাগাতে হয়েছে। অ-নে-ক সময় -মেধা- ঘাম ঝরানোর পর এ দিনটি এসেছিলো। এ পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনড়, তুখোড়। তাঁর চোখে ছিলো বাংলার মানুষের মুক্তি। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। এ সংগ্রামতাঁর একার। তাঁর সাতে কেউ যুক্ত হয়েছে কেউ ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু তিনি অবিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রামী নেতা। তাঁর এ অবদান এ দেশের ইতিহাসের হৃদয়, হৃৎপিন্ড ।
এ দিক থেকে তিনি সোনায় গড়া অলংকার। এক বুকছেঁড়া হিরণ্ময় মণিহার।
পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এভাবেই তিনি ব্রহ্মা হয়ে ওঠেন। সে আলোর পথ ধরে ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী স্বাধীনতার ডাক ১৯৭১ এর ৭মার্চ র ভাষণ । সে আলো অনুযায়ী তিনি এদেশের স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুই হিরণ্ময় জ্যোতি সোনায় গড়া সর্ব কালের সেরা বাঙালি। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে তাকে স্মরণ করি।
শোকদিবস কেন পালন করি?
প্রতি বছর আমরা ১৭মার্চ শিশুদিবস বা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস এবং ১৫ আগস্টে আমরা শোক দিবস পালন করি। কিন্তু কেন করি?
তিনি এ দেশের ত্রাণ কর্তা । তাঁর জীবনী আলোচনার মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের কংকরঢালা পথটি কী ভাবে পিচঢালা পথে রূপান্তরিত হয়েছে তা প্রজন্মের কাছে তুলে ধরি। যাতে তারা বুঝতে পারে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সহজে পাওয়া কোন বস্তু নয় বরং দুর্গমগিরি পেরিয়ে আসা এক কান্তার মরু যেখানে সেনাপতি একজন ছিলো, যিনি এক স্বাপ্নিক যুবক ছিলেন। সেই যুবকের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা কিছুই ছিলো না, ছিলো না টাকা পয়সার মোহ। যিনি কেবল দেশ এবং দেশের জনগনের জন্য ভাবতেন। তারপর হয়েছেন স্বাপ্নিকপ্রৌঢ়। যার হাত ধরে এ দেশ দেখেছে আলোর মুখ।
তাঁর জীবনী থেকে প্রজন্মের শিক্ষা নেয়া উচিত কী ভাবে ব্যক্তি থেকে তিনি সামষ্টিক হয়েছেন।
এ শিক্ষা যদি এদেশের মানুষ নিতে পারতো তাহলে আমরা দুর্নীতিতে বার বার চ্যাম্পিয়র হতাম না, আমাদের ব্যাংক লুট হতো না, রিজার্ব চুরি হতো না। অপরাধ এতো প্রবল হতো না যে পরীমণির মতো নীরিহ একটি মেয়েকে টোপ বানিয়ে আইনের চোখকে গুড়িয়ে দিতে পারতাম না।
করোনাকালীন রাষ্ট্রীয় সাহায্যকে চুরি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে পারতাম না।
কাল শোকদিবসে ফুল দিতে গিয়ে আমরা অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছি তা হতে পারতো না!
তাই আসুন কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয় মহান নেতার জীবনী আলোচনা করে নিজেদের ভেতর ভালো কাজের চর্চা করি।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর( সাধারণ)
পিটিআই, মুন্সীগঞ্জ
কবি ,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক