৯ মে, মা দিবস: প্রতিটি দিনই হোক মা দিবস ,মায়ের বিকল্প কেউ নেই – শাহানা সিরাজী

PicsArt_05-10-12.05.14.jpg

৯ মে, মা দিবস: প্রতিটি দিনই হোক মা দিবস ,মায়ের বিকল্প কেউ নেই – শাহানা সিরাজী

মা দিবস নিয়ে অনেকেরই নাকসিটে ভাব আছে । আমি বলি হাজার ব্যস্ততার মাঝে এই একটি দিন হলেও ঘটা করে সন্তান মাকে সময় দিক। মা বুঝে নেবে জীবন জীবিকা কঠিন । সন্তান ব্যস্ত। তবু মাকে ভুলে যায়নি। যদিও রোজ মায়ের খোঁজ নেয়া একান্তই কতর্ব্য । তথাপিও একদিন হোক মায়ের জন্য , শুধুমাত্র মায়ের জন্য ।
আমাদের দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে মা দিবস মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। কিন্তু বৃটেনসহ অনেক দেশে মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহ মা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। মা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সংসারে সবার গুরুত্ব সমান। মাকে আমরা গুরুত্ব দিই না। দিই না বলেই জেন্ডার বৈষম্য তৈরি হয়েছে। শত বছর আগে ১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক মা –আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস তাঁর সানডে স্কুলে প্রথম এ দিনটিকে মা দিবস হিসেবে চালু করেন। পরে ১৯১৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
এই একটি দিন সন্তানেরা মাকে নিয়ে খায়, ঘুরে বেড়ায়, ফোন করে। ভালো-মন্দ শেয়ার করে। এতে খারাপ কিছু দেখি না।
যারা মায়ের সাথে বসবাস করে তারাও কাজের ব্যস্ততার জন্য মাকে সেভাবে সময় দিতে পারে বলে মনে হয় না। বৃদ্ধ অবস্থায় সংসারের কর্তৃত্ব মায়ের কাছে থাকে না। মা –বাবা তখন সংসারের অতিরিক্ত কেউ হয়ে যায়।
তাদের মনে সন্তানকে কাছে পাওয়ার, নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়ানোর কিংবা পাশে বসে গল্প করার যে আকুলতা তা সব সন্তান বুঝতে চায় না। হয় টাকার পিছনে ছোটে নয় তো স্ত্রীর কথা শুনে শুনে মা-বাবার সাথে দেয়াল তুলে। ব্যতিক্রমও আছে। ভালো তো ভালোই। মা যখন বোঝে একদিন সন্তানকে অন্তত কাছে পাবে তখন অপেক্ষাই করতে থাকে। এবং সে অপেক্ষা আনন্দের।

মা- ছোট একটি শব্দ যার মাহাত্ম বর্ণনা করা আদৌ সম্ভব নয়। মানুষ জন্মের পর থাকে নিদারুণ অসহায় থাকে। ২৯০ দিন পেটে ধারণ করা থেকে শুরু হয় মায়ের জার্নি। এ সময় অনেক মা খেতে পারে না, অনেক মাকে জাস্ট স্যালাইন দিয়ে বাঁচতে হয়। অনেক মা মেন্টালি ডিজঅর্ডার হয়ে যায়। তবুও কষ্ট সহ্য করে কেবল একটি সন্তানের আশায়। ডেলিভারি পেইন কতোটা কষ্টের তা কেউ কোন দিন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। মা তা সহ্য করে কেবল একটি সন্তান লাভের আশায়।
অনেক মা এ সময় পারিবারিক নৃশংসতার শিকার হয়। এ সময় মায়ের পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন। মানসিক এবং শারীরিক প্রশান্তি প্রয়োজন । অনেক মা এসব পায় না তথাপিও কষ্ট সয়ে যায় একটি সন্তানের জন্য। সন্তান লাভের আশা প্রতিটি নারী পুরুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা অমিয় বাসনা। সন্তানের মুখ এক অমৃতালোকের আনন্দাবাস। । এ সন্তানকে যত্ন করে নিজে না খেয়ে , না পরে সন্তানের ইচ্ছাকে প্রধান্য দিয়ে লালন-পালন করে। কোন কোন সন্তান মৃত্যূ পযর্ন্ত এ ধর্ম রক্ষা করে পরমানন্দে মা বাবার নাসিং করে। কোন কোন সন্তান মননে বখে যায়, কোন সন্তান পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে পিতা-মাতার অসম্মান করে।
কোন কোন সন্তান মা-বাবাকে সংসারের গার্বেজ মনে করে। তাদের জন্য থাকে না পার্সোনাল কোন সুবিধা। আজকালকার এপার্টমেন্টেগুলাতে বাবা-মায়ের জন্য কোন কক্ষ বানায় না। ফলে বাবা-মা চিরকাল অবহেলিত থেকেই যায়।
আমার বাসায় আমার বাবা-মা বেশ কিছুদিন ছিলেন। তাঁরা সবচেয়ে কম সুবিধার কক্ষে ছিলেন। তাঁদের কক্ষে কোন এসি ছিলো না। গরমে আমার মায়ের সমস্ত শরীর ফুটে গিয়েছিলো। আমি থাকি বাসার বাইরে। অন্য জেলায় চাকুরি করি। বাসায় আসার পর আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সোজা ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। ঔষধপাতি এনে দিয়ে আম্মাকে সুস্থ করে তুলেছি। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে ছিড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। মাকে কথা বলার সময় আঙুলে কর গুণে গুণে কথা বলতে হয় পাছে সন্তানেরা কষ্ট পায় কিংবা দোষ ধরে!

সৃষ্টির প্রথা অনুযায়ী মা-বাবাকে দেখে রাখা প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য । সামজিক প্রথা বা আচার অনুযায়ী পিতা যেমন সংসারের সর্বোময় কর্তা ব্যক্তি তেমনি পিতার অবসরের পর সন্তানও পিতা-মাতাকে একই ভাবে দেখাশোনা করা কর্তব্য। আবার মানবতার দিকে যদি লক্ষ্য করি তাহলেও দেখা যায় আজ তুমি যৌবনের তরুণ কাল তা থাকবে না। তোমার বার্ধ্যকে তুমি নিজেকে কেমন দেখতে চাও সে ভাবেই তোমার পিতামাতাকে যত্ন করো।
আমরা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিন্টেরে সব মানুষই কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাসী। এবার আসুন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মা-বাবার যত্ন সম্পর্কে কী বলা হয়েছে তা ক্ষতিয়ে দেখি-
আসুন ইসলাম ধর্ম কী বলে জেনে নিই-
তাওহিদের দ্বিতীয় দায়িত্ব
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং বাবা-মার সাথে উত্তম ব্যবহার কর।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৩)
 বাবা-মাকে ধমক না দেয়া
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا
তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে, তাদের উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৩)
 বাবা-মার অনুগ্রহ স্মরণ করা
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল, ‘হে আমার পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)
অমুসলিম বাবা-মার প্রতি অনুগ্রহ করা
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৫)
‘মা’র বিশেষ অবদান
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! কে সেই ব্যক্তি; যার সঙ্গে আমি সবচেয়ে উত্তম আচরণ করবো?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি বলল, তারপর কে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি বলল, তারপর কে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমার মা।’
(চতুর্থ বার) লোকটি বলল, তারপর কে?
এবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমার বাবা।’
বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালন জিহাদের সমতুল্য
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন এবং জেহাদের যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার পিতামাতা কি জীবিত আছে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘পিতামাতার সেবাই তোমার জন্য জেহাদ।’ (মুসলিম)
মৃত্যুর পর তাদের জন্য দোয়া করা
হজাত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার ৩ আমল ছাড়া সব কর্মফল বন্ধ হয়ে যায়। তার একটি হলো সাদকায়ে জারিয়া। দ্বিতীয়টি হলো উপকারি জ্ঞান। তৃতীয়টি হলো নেক সন্তান, যে তার পিতামাতার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম)
সুসম্পর্ক বজায় না রাখার কুপরিণতি
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে ক্ষতিগ্রস্ত হোক! সে ক্ষতিগ্রস্ত হোক! সে ক্ষতিগ্রস্ত হোক!
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, কে সেই ব্যক্তি? হে আল্লাহর রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
তিনি উত্তরে বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতামাতা উভয়কে কিংবা তাদের একজনকে তাদের জীবদ্দশায় পেয়েছিলো কিন্তু (পিতামাতার খেদমত করে) জান্নাত অর্জন করতে পারলো না।’ (মুসলিম)
বাবা-মার অবাধ্যতা বড় পাপ
হজরত আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি কি তোমাদের বড় পাপ সম্পর্কে অবহিত করব না? সাবাহায়ে কেরাম জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ’, (অবশ্যই আপনি অবহিত করবেন) হে আল্লাহর রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা এবং পিতামাতার প্রতি অবাধ্য হওয়া।’ (বুখারি)

সন্তানের কাছে মাতা-পিতার প্রাপ্য অধিকারই তাদের হক। সৃষ্টি জগতে মানুষের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী ব্যক্তি হচ্ছে মাতা-পিতা। তাই মাতা-পিতাই তার সর্বাপেক্ষা আপনজন। মাতা-পিতার প্রতিই সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য সর্বাধিক। সন্তানের জন্য অবধারিত মাতা-পিতার প্রতি অবশ্য পালনীয় এসব দায়িত্ব কর্তব্যই মাতা-পিতার হক রূপে আখ্যায়িত হয়।
মাতা-পিতার হক সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন : ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোন বস্তুকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর।’ (নিসা ৩৬)
‘আর তোমার প্রতিপালক এ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ভিন্ন অপর কারো ইবাদত করো না। আর মাতা-পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর। যদি তাঁদের একজন কিংবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাঁদের উদ্দেশ্যে কখনো ‘উহ’ পর্যন্ত বলবে না। তাদেরকে ধমক দিও না, বরং তাদের সঙ্গে মার্জিত ভাষায় কথা বল। আর তাদের উদ্দেশ্যে অনুগ্রহে বিনয়ের বাহু অবনমিত কর। আর বল, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়কে অনুগ্রহ কর, যেমন তাঁরা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছেন।’ (বনী ইসরাঈল ২৩-২৪)
‘আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতা সম্পর্কে আদেশ করেছি। তার মাতা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভধারণ করেছেন। দুই বছর পর্যন্ত তাকে স্তন্য দান করেছেন। এ মর্মে যে, তোমরা আমার এবং তোমাদের মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আমার দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’ (লোকমান ১৪)
‘আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। আর যদি তোমার মাতা-পিতা তোমাকে আমার সঙ্গে শিরক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করো না।’ (আনকাবুত ৮)
‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে মাতা-পিতা ও আমার গৃহে মুমিন হয়ে প্রবেশকারীদেরকে এবং সব ঈমানদার নর-নারীকে ক্ষমা করুন।’ (নূহ ২৮)

• মাতা-পিতার হক সম্পর্কে হাদীস : হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। নবী করীম (সা.) বলেছেন, তার নাক ধূলায় মলিন হোক, তার নাক ধূলায় মলিন হোক, তার নাক ধূলায় মলিন হোক। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে হতভাগ্য ব্যক্তিটি কে? হুজুর (সা.) বললেন সে হলো সেই ব্যক্তি যে তার মাতা-পিতা উভয়কে অথবা কোন একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও বেহেশতে যেতে পারল না। (মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? হুজুর (সা.) বললেন তোমার মা। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করল অতঃপর কে? হুজুর (সা.) বললেন তোমর মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল অতঃপর কে? হুজুর (সা.) এবার জবাব দিলেন তোমার মা। লোকটি পুনঃজিজ্ঞেস করল অতঃপর কে? এবারে নবী করীম (সা.)জওয়াব দিলেন যে, তোমার বাবা।’ (বুখারী, মুসলিম)
হযরত মুগীরা (রা.) হতে বর্ণিত নবী করীম (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা মায়েদের নাফরমানী করা, হকদারের হক না দেয়া এবং কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া, তোমাদের উপর হারাম করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য গল্প-গুজবে মত্ত হওয়া, অতিরিক্ত সওয়াল করা এবং মাল-সম্পদ নষ্ট করাকে অপছন্দ করেছেন। (বুখারী)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন এক ব্যক্তি তার মাতা-পিতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় ত্যাগ করে হিজরাতের উদ্দেশ্যে বায়াত করার জন্যে নবী করীম (সা.) এর খেদমতে এসে হাজির হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন ফিরে যাও তোমার মাতা-পিতার কাছে এবং তাদের খুশী করে এসো যেমনি তাদের কাঁদিয়ে এসেছিলে। (আদাবুল মুফরাদ)

পিতা-মাতা অসদাচরণ করলেও তাদের প্রতি অবহেলা নয়

সন্তানদের উপর পিতামাতার যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি পিতামাতার ওপরও সন্তানদের অধিকার রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর; যে আগুনের ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম, কঠোরস্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না। তারা যে কাজে আদেশপ্রাপ্ত হয়, তাই তারা করে। ’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬৬)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের দায়িত্বশীল; তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামীগৃহের কর্ত্রী; তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে…। ’ (বুখারি, হাদিস নং: ৮৯৩, মুসলিম, হাদিস নং: ১৮২৯)
রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহ যে বান্দাকে কোনো জনসমষ্টির দায়িত্বশীল করেন; কিন্তু সে এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে খেয়ানত করেছে; আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। ’ (মুসলিম, হাদিস নং: ১৪২)
পিতামাতার ওপর সন্তানদের কিছু অধিকার রয়েছে; যেগুলো অধিকার আদায় করা আবশ্যক। যেমন-
এক. স্বামীর উচিত নিজের জন্য উত্তম স্ত্রী নির্বাচন করা এবং স্ত্রীর উচিত নিজের জন্য উত্তম স্বামী নির্ধারণ করা। পুরুষ তার জন্য এমন একজন স্ত্রী নির্বাচন করবেন, যে নারী ভবিষ্যতে তার সন্তানদের মা হওয়ার উপযুক্ত। আর নারী এমন একজন পুরুষকে নির্বাচন করবেন, যে পুরুষ তার সন্তানদের পিতা হওয়ার উপযুক্ত।
দুই. সন্তানের সুন্দর নাম রাখা, যত্ম নেওয়া ও তার খাবার-পানীয়, পোশাকাদি ও বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো সাধ্যানুযায়ী ব্যবস্থা করা; এক্ষেত্রে কৃপণতা বা অপচয় না করা।
তিন. পিতামাতার ওপর সন্তানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে— উত্তম প্রতিপালন, তাদের চরিত্র ও শিষ্টাচার গঠনে যত্মবান হওয়া, আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী দ্বীন-ধর্ম পালন করছে কিনা সেটা তত্ত্বাবধান করা এবং তাদের যাবতীয় দুনিয়াবি প্রয়োজনগুলোর খোঁজখবর রাখা; যাতে করে তাদের জন্য উপযুক্ত ও সম্মানজনক জীবন-নির্বাহ নিশ্চিত করা যায়।
সন্তানদের এ অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক পিতামাতাই অসচেতন থাকেন। প্রচুর পরিমাণে অবহেলা করেন। ফলে তিনি নিজেরাই সন্তানদের ভেতর অবাধ্যতা ও দুর্ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দেন।
আল্লামা ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ (রহ.) বলেন, ‘ যে ব্যক্তি তার সন্তানকে উপকারী শিক্ষা দেয় না ও অবহেলায় ছেড়ে দেয়, সে তার সন্তানের প্রতি জঘন্যতম অন্যায় করে। অধিকাংশ সন্তান নষ্ট হয় পিতামাতার অবহেলার কারণে এবং সন্তানদের ইসলামের ফরজ-সুন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো শিক্ষা না দেওয়ার কারণে। এভাবে পিতামাতাই অঙ্কুরে সন্তানদের নষ্ট করে…। ’
তিনি আরো বলেন, ‘কত মানুষ নিজেই নিজের তার কলিজার টুকরা সন্তানকে দুনিয়া-আখেরাতে দুর্ভাগা বানায়; অবহেলা, শাসন না করা, ভোগবিলাসে সহযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে তাকে অভাগা করে। হয়তো ভাবে যে, সে তাকে খুশি করেছে; বস্তুত সে তাকে লাঞ্ছিত করেছে। ভাবে তার প্রতি দয়া করছে; অথচ সে তার প্রতি অন্যায় করছে। এভাবে সে ব্যক্তি সন্তান দিয়ে উপকৃত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয় এবং সন্তানকেও দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে…। খেয়াল করলে দেখবেন, অধিকাংশ সন্তান নষ্ট হওয়ার কারণ পিতামাতা। ’ (তুহফাতুল মাওদুদ ফি আহকামিল মাওলুদ, পৃষ্ঠা: ২২৯-২৪২)
তবে সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার অবহেলার মানে এটা নয় যে, সন্তানও পিতামাতার অধিকার আদায়ে অবহেলা করবে। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণ করবে। বরং সন্তানদের ওপর ফরজ
হলো পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। তাদের দুর্ব্যবহার হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেওয়া ।

এবার দেখি সনাতন ধর্ম কী বলে-

• সনাতন ধর্মে মায়ের স্থান অনেক উঁচু। চণ্ডীতে বলা হয়েছে…
“যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।”
আর সন্তান এর কাছে মায়ের স্থান কোথায় হবে সে বিষয়ে সনাতন শাস্ত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। সে বিষয়ে জানতে আমরা মনু সংহিতা্র একটি শ্লোক দেখব…
“উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচার্য্যণাং শতং পিতা।
সহস্রন্ত্ত পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে।” (মনুসংহিতা, ২/১৪৫)
অনুবাদ:
দশজন উপাধ্যায় থেকে একজন আচার্যের গৌরব বেশি। একশত আচার্যের থেকে পিতার গৌরব বেশি এবং সহস্র পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানীয়া।
পিতা মাতার ঋণ সন্তান শত সহস্র জন্মেও শোধ করতে পারে না।
“যংমাতাপিতরৌ ক্লেশং সহতে সম্ভবে নৃণাম্।
ন তস্য নিষ্কৃতিঃ শক্যা কর্তুং বর্ষশতৈরপি।” (মনুসংহিতা, ২/২২৭)
অনুবাদ:
সন্তান জন্মে পিতামাতা যে ক্লেশ সহ্য করেন পুত্র শত শত বৎসরে, শত শত জন্মেও সেই ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ নয়। এ ছাড়া শাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে মাতৃভক্তি দ্বারা এই ভূলোক জয় করা সম্ভব।
“ইমং লোকং মাতৃভক্ত্যা” (মনুসংহিতা, ২/২৩৩)
অনুবাদ:
মানুষ মাতৃভক্তি দ্বারা এই ভূলোক জয় করতে পারে।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি রামায়ণে ভগবান শ্রীশ্রী রামচন্দ্র বলেছিলেন…
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী।” এতো গেলো হিন্দু ধর্মের কথা।

• আসুন এবার বাইবেল কী বলে-

“Honor your father and your mother, that your days may be long in the land that the Lord your God is giving you.” – Exodus 20:12
• “Her children rise up and call her blessed; her husband also, and he praises her: ‘Many women have done excellently, but you surpass them all.’” – Proverbs 31:28-31
• “Every one of you shall revere his mother and his father.” – Leviticus 19:3
• “The man called his wife’s name Eve, because she was the mother of all living.” – Genesis 3:20
• “Strength and dignity are her clothing, and she laughs at the time to come. She opens her mouth with wisdom, and the teaching of kindness is on her tongue. She looks well to the ways of her household and does not eat the bread of idleness.” – Proverbs 31:25-28
• “And Mary said, ‘My soul magnifies the Lord, and my spirit rejoices in God my Savior, for he has looked on the humble estate of his servant. For behold, from now on all generations will call me blessed.’” – Luke 1:46-48
• “A gracious woman gets honor…” – Proverbs 11:16
• “Hear, my son, your father’s instruction, and forsake not your mother’s teaching, for they are a graceful garland for your head and pendants for your neck.” – Proverbs 1:8-9
• “Only take care, and keep your soul diligently, lest you forget the things that your eyes have seen, and lest they depart from your heart all the days of your life. Make them known to your children and your children’s children…” – Deuteronomy 4:9
• “When Jesus therefore saw his mother, and the disciple standing by, whom he loved, he saith unto his mother, Woman, behold thy son! Then saith he to the disciple, Behold thy mother! And from that hour that disciple took her unto his own home.” – John 19:26-27
• “As one whom his mother comforts, so I will comfort you; you shall be comforted in Jerusalem.” – Isaiah 66:13
• “Above all, keep loving one another earnestly, since love covers a multitude of sins.” – 1 Peter 4:8
• “And his mother treasured up all these things in her heart.” – Luke 2:51
• “I have no greater joy than to hear that my children are walking in the truth.” – 3 John 1:4
• “So now faith, hope, and love abide, these three; but the greatest of these is love.” – 1 Corinthians 13:13
• “Then the mother of the child said, ‘As the Lord lives and as you yourself live, I will not leave you.’ So he arose and followed her.” – 2 Kings 4:30
ত্রিপিটকেও পিতামাতার অনুরূপ সেবার কথা বলা হয়েছে।
এক মা সন্তানকে খুব অভিশাপ দিলেন। সন্তান তখন প্রর্থনা করলেন, মা যদি সত্যি বলেন মন থেকে তাহলে আমার যেন তাই হয়। মন থেকে না বললে, আমার কিছুই হবে না।
পরে দেখা গেলো তার কিছুই হয়নি। বোঝা গেলো মা সন্তানকে কখনো মন থেকে অভিশাপ দেয় না। তাহলে সন্তানকে হতে হবে মায়ের প্রতি নমনীয় এবং ভক্তি থাকতে হবে।

তাই আসুন পিতা-মাতাকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ি দিই। এমন আচরণ না করি যাতে তারা কষ্ট পায়। সময়ের কারণে শিক্ষা দীক্ষার কারণে আপনি এডভান্স হতে পারেন কিন্তু বাবা-মাকে টপকে নয় সাথে নিয়ে যান। আপনি যতো দূর আপনার মা বাবাও ততোদূর ।
এ রমজানে আমরা আমাদের মা-বাবার জন্য প্রার্থনা করি তারা যেন সুস্থ থাকেন, আমৃত্যূ যেন তাদের সেবা করতে পারি। মা-বাবাকে জঞ্জাল মনে না করি।
মা দিবস সফল হোক। বিশ্বের সব মায়ের জন্য অবিরত ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধা রইল।

তথ্য সূত্রঃ কোরান হাদীস,গীতা বাইবেল….
ইন্টার নেট…

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর( সাধারণ)
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top