রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, পাঁচজন নিহত
বিশেষ প্রতিবেদকঃ রাজধানী ঢাকার বায়তুল মোকাররম, চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের সমর্থকদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। নিহতদের তিনজনই হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্র। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন পুলিশসহ শতাধিক ব্যক্তি
ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের গাড়ি ভাঙচুর করে। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন।
পুলিশ জানায়, হেফাজত কর্মীরা হাটহাজারী ভূমি অফিস, ডাকবাংলোসহ সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। অবরোধ করে রাখে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক।
এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজের পর মুসল্লিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ এ সময় ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল বিনিময় চলতে থাকে।
পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। থেমে থেমে চলা এ সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন।
পুলিশ জানায়, ঢাকার এ সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর জের ধরে উত্তপ্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
রেলস্টেশন সহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে হেফাজত কর্মীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে একজন নিহত এবং পুলিশসহ ২০ জন আহত হয়। থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র জানায়, ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজের মোনাজাত শেষে মুসল্লিদের একাংশ বিক্ষোভ শুরু করে। স্লোগান দেওয়ার খানিক পরই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মসজিদের উত্তর পাশের ফটকে মিছিলকারীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। এতে বিক্ষোভকারীরা পিছু হটে মসজিদের ভিতরে ঢুকে পড়ে। এর খানিক পরই বিক্ষোভকারীরা আবার সংগঠিত হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ওপর পাল্টা হামলা চালায়। এ সময় প্রায় ১০ মিনিট ধরে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। এরপর দক্ষিণ পাশের ফটকেও সংঘর্ষ শুরু হয়।
সরকারদলীয় নেতা-কর্মী ও মুসল্লিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশ মসজিদের দিকে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। কিছু সময় পরপর ফাঁকা গুলি ও জলকামান ব্যবহার করে। এতে পুরো এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদের ভিতরে আটকা পড়েন জুমার নামাজ পড়তে আসা সাধারণ মুসল্লিরা। থেমে থেমে চলতে থাকে এ সংঘর্ষ। দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দিতে দেখা গেছে। এ সময় বায়তুল মোকাররম এলাকায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এই সংঘর্ষের ঘটনায় আহতদের মধ্যে প্রায় ৪০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কেউ কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চলে গেছে। সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী চিটাগাং সড়কে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে।
এদিকে, সংঘর্ষের পর থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে হাটহাজারীতে। চট্টগ্রাম হাটহাজারীর ঘটনার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা মিছিল সহকারে এসে থানায় ভাঙচুর করে। পুলিশের ওপর হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এ সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে সাতজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। ’
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা উপজেলা ভূমি অফিস ও ডাকবাংলোতে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর করেছে। ভূমি অফিসের ফাইলপত্র, আসবাবপত্র জড়ো করে আগুন দিয়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। কী পরিমাণ সরকারি সম্পদ ও দলিলপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ’
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘হাটহাজারীর ঘটনায় আহত আটজনকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত চারজনের মধ্যে তিনজন মাদরাসার শিক্ষার্থী এবং একজন পথচারী। তিনি পেশায় দর্জি। আহত বাকি চারজন হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে তারা শঙ্কামুক্
ঘটনার ব্যাপারে পুলিশ জানায়, ঢাকার বায়তুল মোকাররমে মুসল্লি ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকাল ৩টায় মিছিল বের করে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মী ও দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। তারা হাটহাজারী মাদরাসার সামনে থেকে মিছিল সহকারে এসে থানা ঘেরাও করে। এ সময় হেফাজত কর্মীরা বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে থানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। ভাঙচুর করে থানা কম্পাউন্ড। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়লে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় হাটহাজারী সদর এলাকা। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের পর হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা পিছু হটলেও থানার অদূরবর্তী এলাকায় অবস্থান নেয় এবং চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।
এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হামলা চালিয়েছে একদল যুবক। বিকালে হাটহাজারী ঘটনায় আহতদের মৃত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এ হামলার ঘটনা ঘটে। চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল হক ভুইয়া বলেন, ‘হাটহাজারীর ঘটনায় আনা চারজনকে মৃত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন যুবক জরুরি বিভাগে হামলা চালায়। এতে জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড সরদার মো এনায়েত আহত হয়েছেন। হামলার পরপরই পালিয়ে যায় তারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদরাসার ছাত্ররা রেলস্টেশন সহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। সংঘর্ষে একজন নিহত ও পুলিশসহ আহত হয় ২০ জন।
আবার দুপুর আড়াইটায় শহরের প্রধান সড়ক টিএ রোডে মাদরাসার ছাত্ররা ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় তারা প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধরা সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে টায়ারে আগুন লাগিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে বিক্ষুব্ধরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রেলস্টেশনে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেলস্টেশনের সিগন্যাল, মাস্টার রুম, কন্ট্রোল রুমসহ অন্য কর্মকর্তাদের কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর করে। সব মালামাল একত্রিত করে আগুন ধরিয়ে দেয়।
রেললাইনের স্লিপার তুলে ফেলে বিক্ষুব্ধরা। সিগন্যাল বক্স ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর ফলে ঢাকার সঙ্গে সিলেট ও চট্টগ্রামের সব প্রকার ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকাগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে প্রবেশ করার সময় বিক্ষুব্ধরা পাথর নিক্ষেপ করলে ট্রেনটি ফিরে যায়। জেলা পরিষদ কার্যালয়ে বিকাল সোয়া ৫টায় ব্যাপক হামলা চালানো হয়। শহরের কাউতলী, ভাদুঘরে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। সড়কে আগুন ধরিয়ে রাস্তায় অবরোধ করা হয়।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিশ্বরোড, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুর, নন্দনপুর, মজলিশপুর, ঘাটুরাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এ ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে দূরপাল্লার সব যানবাহন বন্ধ রয়েছে। শহরের জেলা পরিষদ, পৌর মুক্তমঞ্চ, পৌর মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভেঙে ফেলে। স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে আলোকসজ্জা ও সড়ক সজ্জিতকরণ ব্যানার ফেস্টুন ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা। শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়। উগ্র বিক্ষুব্ধরা নরেন্দ্র মোদিবিরোধী স্লোগান দেয়। একসময় বিক্ষুব্ধরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা জজের বাসভবনের মূল ফটকে হামলা চালায়। পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে গ্যারেজে থাকা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে ভবনের নিচ তলার জানালা।
বিকালের দিকে শহরের কাউতলী এলাকার দাতিয়ারা গ্রামের সাগর মিয়ার ছেলে আশিক (২৫) গুরুতর আহত হয়। জেলা সদর হাসপাতালে তাকে নিলে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যু হয়। পরে বিক্ষুব্ধরা লাশ নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে লাশ মাদরাসায় নিয়ে যায়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২ নম্বর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নূরে আলম, পুলিশ সদস্যসহ ২০ জন আহত হন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। সারা শহরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে জেলা পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনা জানেন না বলে জানান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।