নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগসহ ২৪টি দল নাম দিয়েছে, দেয়নি বিএনপিসহ ১৫ দল
বিশেষ প্রতিবেদকঃ নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চারজন নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বাছাইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মোট ২৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অনুসন্ধান কমিটির কাছে নাম প্রস্তাব করেছে।
তবে অনুসন্ধান কমিটি মোট ৩৯টি নিবন্ধিত দলের কাছে চিঠি দিয়ে নামের প্রস্তাব চাইলেও বিএনপিসহ ১৫টি দল কারও নাম দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন প্রক্রিয়া গোড়াতেই হোঁচট খেল। অনুসন্ধান কমিটির কাছে নাম প্রস্তাবের সময় শেষ হয়েছে শুক্রবার বিকাল পাঁচটায়। নাম প্রস্তাবের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর আজ শনিবার ও আগামীকাল রবিবার অনুসন্ধান কমিটি বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত নেবে।
নতুন ইসির অধীনেই আগামী বছরের শেষদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সংসদ নির্বাচনের আগের বছরেই রাজনৈতিক বিভক্তি শুরু হলো ইসি গঠনকে কেন্দ্র করে। যেখানে বিএনপি সহ তাদের মিত্র দলগুলো এরইমধ্যে বলেছে- রাষ্ট্রপতির সংলাপ, অনুসন্ধান কমিটি ও নতুন ইসি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার।
নতুন ইসি গঠনের প্রক্রিয়ায় এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গতবছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে এবছরের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সংলাপ করেন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। ৩২টি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বঙ্গভবন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সহ ২৫টি দল সংলাপে অংশ নেয়। তবে বিএনপিসহ সাতটি দল রাষ্ট্রপতির সংলাপেও যায়নি। রাষ্ট্রপতির সংলাপে সাতটি দল সাড়া না দেওয়ায় এবং অনুসন্ধান কমিটির কাছে ১৫টি দল নাম প্রস্তাব না করায় নতুন ইসি গঠনের শুরুতেই দেখা দিল রাজনৈতিক বিভক্তি।
আওয়ামী লীগসহ যারা নাম দিয়েছে
নাম জমা দেওয়ার শেষদিনে গতকাল আওয়ামী লীগ নেতারা সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গিয়ে ১০ জনের নাম জমা দিয়ে আসেন। আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অধ্যাপক সেলিম মাহমুদ ও উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান প্রস্তাব জমা দিয়ে আসেন। অধ্যাপক সেলিম মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, দলের পক্ষ থেকে তারা বদ্ধ খামে নামগুলো দিয়ে এসেছেন। সেখানে কাদের নাম আছে তা তিনি জানেন না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মধ্যে নিবন্ধিত সবগুলো দল নাম জমা দিয়েছে। শেষদিনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি)সহ অনেকগুলো দল নাম জমা দেয়। আগেরদিন বৃহস্পতিবার জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)সহ অন্তত পাঁচটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অনুসন্ধান কমিটির কাছে নামের তালিকা জমা দেয়।
ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পার্টির পলিটব্যুরোর বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনুসন্ধান কমিটি নির্ধারিত নামসমূহ গণমাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়ে আগামীকাল একটি চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিকল্পধারা প্রস্তাবে যাদের নাম
সিইসি হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁঞার নাম প্রস্তাব করেছে বিকল্পধারা। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দলটি স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ, সাংবাদিক ও লেখক আবু সাঈদ খান, ফেমা’র সাবেক সভাপতি মনিরা খান ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুরের নাম প্রস্তাব করেছে। নামের তালিকাটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছে বিকল্পধারা।
অনুসন্ধান কমিটির কাছে নাম দেয়নি যেসব দল
রাষ্ট্রপতির সংলাপেও যায়নি এবং অনুসন্ধান কমিটির কাছে নামের তালিকাও পাঠায়নি- এমন দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এবং চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (আইএবি)। আর রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেওয়া ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ অনুসন্ধান কমিটির কাছে নাম প্রস্তাব করেনি।
গত ২৭ জানুয়ারি সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ পাশ হয়েছে। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গত ৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। কমিটি প্রথমে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নামের প্রস্তাব আহ্বান করে। বিজ্ঞপ্তিতে কমিটির সাচিবিক সহায়তার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সরাসরি, চিঠির মাধ্যমে কিংবা ই-মেইলে নামের তালিকা পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। পরে অনুসন্ধান কমিটি নামের প্রস্তাব চেয়ে বুধবার ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে চিঠি পাঠানোর নতুন সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বুধবার দলগুলোকে চিঠি পাঠানো হয়। তাতে শুক্রবার বিকাল পাঁচটার মধ্যে নাম প্রস্তাবের অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
ছয়টি পেশাজীবী সংগঠনও নাম প্রস্তাব করেছে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব
গতকাল নামের প্রস্তাব জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষে বিকালে সচিবালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে অনুসন্ধান কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব শফিউল আজিম বলেন, ২৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন। এছাড়া ছয়টি পেশাজীবী সংগঠন থেকে প্রস্তাব এসেছে। এই পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে বিএমএ, কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনও আছে।
তিনি জানান, এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেশ ও বিদেশ থেকে অনেক বড় সংখ্যায় প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এগুলো এসেছে মূলত ই-মেইলে। তবে মোট কতজনের প্রস্তাব এসেছে, সেটি তাৎক্ষণিক জানাতে পারেননি তিনি। এবিষয়ে শফিউল আজিম বলেন, নামগুলোর তালিকা করে এখন অনুসন্ধান কমিটির সামনে উপস্হাপন করা হবে। জানা গেছে, সবমিলিয়ে সিইসি ও চারজন নির্বাচন কমিশন পদের জন্য কয়েকশ নামের প্রস্তাব পড়েছে অনুসন্ধান কমিটিতে।
কে এম নূরুল হুদর নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন গঠনে পাঁচ বছর আগে সার্চ কমিটির কাছে ১২৮ জনের নাম সুপারিশ এসেছিল; যা থেকে বাছাই করে ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছিল তৎকালীন সার্চ কমিটি। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন।
শুক্রবারের মধ্যে সবমিলিয়ে কত সংখ্যক নাম জমা পড়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব শফিউল আজিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘৫টায় তো সময় ছিল, আমরা জাস্ট ক্লোজ করেছি। কম্পাইলেশনে এখনও যাইনি। আরও কাজ রয়ে গেছে, সিস্টেমেটিক ওয়েতে আমাদের মেথডে কম্পাইল করব। আমরা নির্ধারিত পদ্ধতিতে কম্পাইলেশন করে কমিটির সামনে উপস্থাপন করব। কমিটি সিদ্ধান্ত দেবে।’
রয়েছে রাজনৈতিক নেতার স্ত্রীর নামও
জানা গেছে, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে পাঠানো নামের প্রস্তাবে সাবেক বিচারপতি, সাবেক আমলা, সাবেক সেনাপ্রধান, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীরা রয়েছেন। একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে নামের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তাতে দলটির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার স্ত্রীর নামও রয়েছে। নির্বাচন কমিশনার পদে ওই নেতার স্ত্রীর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইসি গঠনে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ে আজ শনিবার দুই দফায় এবং আগামীকাল রবিবার বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠক করবে অনুসন্ধান কমিটি। ইতোমধ্যে বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম মঙ্গলবার জানিয়েছেন, বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আজ ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা, পৌনে ১টা থেকে সোয়া ২টা পর্যন্ত এবং আগামীকাল বৈঠক হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম আইন অনুযায়ী ইসি গঠন হতে যাচ্ছে।